কলকাতা, 27 ডিসেম্বর: 'অঙ্কুর এখন পূর্ণ গাছ হওয়ার পথে'। সম্ভাবনার দ্রুত সফল বিকাশের উজ্জ্বল ছবি। এ কোনও বিজ্ঞাপনী লাইন নয়। একটি প্রতিভাবান টেবিল টেনিস খেলোয়াড়ের দ্রুত উত্তরণের গল্প। অঙ্কুর ভট্টাচার্য, বাংলার টেবিল টেনিসের বর্তমান পোস্টার বয়।
কেন অঙ্কুর পোস্টার বয়?
রাজ্য, জাতীয় এমনকী আর্ন্তজাতিক টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতায় অঙ্কুর ভট্টাচার্য মানেই পোডিয়ামের একটি জায়গা বরাদ্দ। রাজ্যস্তর হলে পদকের রঙ সোনালি। জাতীয় স্তরে রং বদলায়। আর্ন্তজাতিক স্তরেও অঙ্কুর সাফল্যে। রাজারহাটের ছেলে হলেও হাওড়া জেলার হয়ে রাজ্যস্তরে প্রতিনিধিত্ব করেন। জেলা বদলালে অঙ্কুরের খেলার ধার কমে না। বরং যে প্রতিযোগিতায় তিনি অংশ নেন সেখানে পোডিয়ামের একটি জায়গা নিশ্চিত হয়ে যায়।
বাঁ-দিক থেকে ও অংশুমান ভট্টাচার্য ও অঙ্কুর ভট্টাচার্য (ইটিভি ভারত) টেবিল টেনিসে দেশের দ্বিতীয়স্থানে অঙ্কুর
গতকালই অঙ্কুর 17 পেরিয়ে আঠারোতে পা দিল। আগেই অঙ্কুর টেবিল টেনিস বোর্ডে প্রাপ্তবয়স্ক। যার স্পর্ধার সামনে অন্যরা কার্যত বহু দূরে সরে যেতে বাধ্য হয়েছে। সেটা চলতি বছরে শুধুমাত্র হয়নি। বেশকিছু বছর ধরেই হয়ে চলেছে। চলতি বছরে দেশের সবকটা জাতীয় ক্রমপর্যায়ের টুর্নামেন্টে সাফল্যের সংগৃহীত পয়েন্টে ছেলেদের মধ্যে শীর্ষে 345 পয়েন্ট নিয়ে জ্ঞানশেখরণ সাথিয়ান। দ্বিতীয়স্থানে 330 পয়েন্ট নিয়ে বাংলার অঙ্কুর ভট্টাচার্য।
অঙ্কুরের ঝুলিসম্মান
গত 3 বছর ধরে যুব পর্যায়ে অবিশ্বাস্য সাফল্যের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। সিনিয়র পর্যায়েও দাপট দেখাতে শুরু করেছেন। চলতি বছরে অঙ্কুর পাঁচটি জাতীয় ক্রমপর্যায়ে মিটে যুব পর্যায়ে নেমেছিলেন এবং 5টি বিভাগেই সোনা পেয়েছেন। সিনিয়র বিভাগে সোনা, রুপো, ব্রোঞ্জ পেয়ে উঠে এসেছেন দুইয়ে।
আসন্ন প্রতিযোগিতা ও অঙ্কুর
নতুন বছরে 19 জানুয়ারি থেকে সুরাতে জাতীয় সিনিয়র চ্যাম্পিয়নশীপ খেলতে নামবেন। তার আগে ভদোদরায় তিনি নামবেন জাতীয় যুব মিটে। সেখানে তিনবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার লক্ষ্যে নামবেন। প্র্যাকটিসের ফাঁকে অঙ্কুর বলছিলেন, "নতুন বছরে যুব বিভাগের সঙ্গে সিনিয়র বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হতে চাই। বাবার কাছে ট্রেনিং করছি।"
পিতা-পুত্রের দাঁত চাপা লড়াই
- ভারতীয় ক্রীড়াজগত পিতা পুত্রের উত্তরণের লড়াই বলতে ভেস পেজ এবং লিয়েন্ডার পেজের কথা বলে। বছর পঁয়ত্রিশ আগে হকিতে ব্রোঞ্জ পদকজয়ী অলিম্পিয়ানের লড়াইটা ছিল অনুপ্রেরণা। কাঠিন্যের আগুনে পুড়িয়ে পুত্র লিয়েন্ডারকে কিংবদন্তি টেনিস তারকা হতে সাহায্য করেছিলেন পিতা ভেস পেজ। আজও কলকাতার সাউথ ক্লাব কিংবা ভারতীয় লন টেনিস সার্কিটে পিতা-পুত্রের দাঁত চাপা লড়াইয়ের গল্প শোনা যায়।
- ঠিক একই রকমের গল্পের পটভূমি জমাট বাঁধতে শুরু করেছে বাংলা তথা ভারতীয় টেবিল টেনিস সার্কিটে। অংশুমান এবং অঙ্কুরের লড়াইয়ের গল্প বোধহয় ভেস পেজ-লিয়েন্ডারের গল্পকেও হার মানাবে। অলিম্পিয়ানের পরিচিতি অংশুমানের নেই। তবুও অংশুমানের লড়াই একইরকমের কঠিন, হয়তো অনেকটা বেশি।
অঙ্কুরের সাফল্যের কারণ
রাজারহাট থানার কাছে অঙ্কুরের বাড়ি। যে কোনও ব্যক্তি যদি ওখানে যান তাহলে রাস্তা থেকেই নিরন্তর বল পেটানোর আওয়াজ শুনতে পাবেন। অঙ্কুরের কার্যত 'টোয়েন্টি ফোর ইন্টু সেভেন' বল মেরে যাওয়াই বোধহয় এত অল্প বয়সে সাফল্যের কারণ। শুরুর দিন থেকে অন্য সকলের থেকে আলাদা। টেকনিক, আগ্রাসন এবং গেম রিডিংয়ে সমসাময়িকদের থেকে অন্তত দু'ধাপ এগিয়ে থাকেন তিনি। ফলে বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টে শুরু থেকেই অঙ্কুরের দাপট এবং তা অব্যাহত।
অঙ্কুরের কোচ বাবা অংশুমান
ভদোদরায় তিনি নামবেন জাতীয় যুব মিটে। এবারের বাংলা দলের কোচের দায়িত্ব অংশুমান ভট্টাচার্যের উপর ন্যস্ত। বাবা কোচ, ছেলে সেই দলেরই সদস্য এমন ঘটনা খুব কমই ঘটে। "বাবা এবার কোচ হিসেবে আমাদের সঙ্গে থাকবে এতে আমার কোনও বাড়তি অনুভূতি নেই। কারণ, আমার খেলার সময় বাবাই থাকত। আমার খেলার খুঁটিনাটি বাবাই সবচেয়ে ভালো জানে। তাই যাবতীয় উন্নতি, সংশোধন বাবার হাত ধরেই আমার সম্ভব, "বলছিল অঙ্কুর।
অংশুমানের দায়িত্ব 'বড়'
- ছেলের সাফল্যে বাবা অংশুমান ভট্টাচার্যের মুখে স্বস্তির সুর। "ভেস পেজ এবং লিয়েন্ডারের লড়াইয়ের কথা জানি। তবে আমাদের লড়াইটা একটু বেশি কঠিন। এখনও আরও কিছু দরকার গড়ে তোলার জন্য। তা পাচ্ছি কোথায়। অঙ্কুরের পারফরম্যান্স দেখে সকলেই নিতে আগ্রহী। কিন্তু আমাকে ছেড়ে অঙ্কুর যেতে রাজি নয়। নতুন কোচের কাছে মানিয়ে নেওয়ার প্রাথমিক সমস্যা থাকে। এখনও পর্যন্ত আমার কাছে খেলেই তো সাফল্য এসেছে। ছোট থেকে সার্কিটে ঘুরে পাশে থেকেছি। অঙ্কুর নিজেও সার্কিটের ছবিটা বুঝে গিয়েছে। বোর্ডের পাশে আমি থাকলে নিশ্চিন্ত বোধ করে"।
- এবার বাংলা দলের দায়িত্ব। নিজের ছেলেকে পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি দলকেও দেখতে হবে যাতে সাফল্য পায়। "ওটা কোনও অসুবিধা নয়। 35 বছর ধরে কোচিং করাচ্ছি। আমি সব প্যাডলারদের চিনি। ছোট থেকে দেখে আসছি। তাই কোচের দায়িত্ব পালনে অসুবিধা হবে না, "বলছিলেন অংশুমান ৷
অঙ্কুরের মা প্রাক্তন টিটি প্লেয়ার
বাংলাদেশের টেবিল টেনিস দলের কোচিংয়ের দায়িত্ব সামলেছেন। প্রথমবার রাজ্য দলের দায়িত্ব। বাবা ছেলের জয়যাত্রায় আরও একটি নাম অনুঘটকের মতো কাজ করে চলেছে। কুন্তলী ভট্টাচার্য, অঙ্কুরের মা। নিজে টেবিল টেনিস খেলোয়াড় ছিলেন। ছেলের সাফল্যের পিছনে নিঃশব্দ অবদান রেখে যাচ্ছেন।
এদিকে, অংশুমানকে দায়িত্ব দেওয়ার কারণ জানালেন, বেঙ্গল স্টেট টেবিল টেনিস অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সচিব শর্মি সেনগুপ্ত। তাঁর মতে, "অঙ্কুরকে কোচিং করানোর সুবাদে অংশুমান সব প্যাডলারদের চেনে। তাই সুবিধা হবে। টেবিল টেনিসে বাবা ছেলের যুগলবন্দি এবার রাজ্য দলের সাজঘর থাকবে।"