হায়দরাবাদ, 24 জুন: সুইজারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হয় 2 দিনের ইউক্রেন শান্তি সম্মেলন ৷ এই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিল 92টি দেশের প্রায় 60টি সরকারের প্রধান এবং 8টি আন্তর্জাতিক সংস্থা ৷ সম্মেলনে যুদ্ধের অবসানের জন্য কিয়েভের প্রস্তাবিত 10-দফা পরিকল্পনার সঙ্গে আরও তিনটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছিল ৷ সেগুলি হল-পারমাণবিক হুমকি, ইউক্রেনে খাদ্যের যোগান এবং মানবিক চাহিদা ৷
তবে এই শান্তি সম্মলনে বিশেষ লাভ হয়নি ৷ কারণ ইউক্রেনে শান্তি বজায় রাখার প্রচেষ্টার বিষয়ে সকলে একমত না হওয়ায় সেটি অমীমাংসিত থেকে যায় । সেই অবস্থায় 16 জুন ইউক্রেন শান্তি সম্মেলন শেষ হয় ৷ ভবিষ্যতে কখন এবং কীভাবে রাশিয়াকে যুক্ত করা উচিত এই প্রশ্নে একটি স্পষ্ট পদ্ধতিতে একমত পোষন করতে পারেননি শান্তি সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্র ও সরকারের প্রধানরা ।
80টি দেশ এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কয়েকটি প্রধান প্রতিষ্ঠান ইউরোপিয়ান কমিশন, ইউরোপিয়ান কাউন্সিল, ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট এই ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেছে । আর্মেনিয়া, বাহরাইন, ব্রাজিল, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, কলম্বিয়া, লিবিয়া, মেক্সিকো, সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকা, সুরিনাম, থাইল্যান্ড এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহি-সহ বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র এই ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করা থেকে বিরত থেকেছে ।
এই ঘোষণাপত্রে ইউক্রেনের যুদ্ধের জন্য রাশিয়ার তীব্র নিন্দা করা হয়েছে, যা ব্যাপক ধ্বংস ও মানবিক যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ৷ পাশাপাশি রাষ্ট্রসংঘ সনদের অনুচ্ছেদ 2-এর ভিত্তিতে ইউক্রেনের আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি সম্মান জানানোর আহ্বান জানানো হয়েছে এই ঘোষণাপত্রে । এতে ইউক্রেনের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাশিয়ান অধিকৃত জাপোরিঝিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ফিরিয়ে আনা, ব্ল্যাক ও আজভ সাগরে ইউক্রেনের বন্দরগুলিতে প্রবেশাধিকার, সমস্ত যুদ্ধবনিদীর মুক্তি এবং সমস্ত নির্বাসিত ইউক্রেনীয় শিশুদের ফিরিয়ে আনা ও ইউক্রেনে খাদ্য পণ্য সরবরাহের যোগান নিশ্চিত করারও আহ্বান জানানো হয়েছে ।
এই নথিতে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে পারমাণবিক অস্ত্রের কোনও হুমকি বা ব্যবহার অনুমোদিত নয় এবং জাহাজ ও বেসামরিক বন্দরে হামলা অগ্রহণযোগ্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে । তবে এই ঘোষণাপত্রে রাশিয়াকে ইউক্রেনের ভূখণ্ড থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করার আহ্বান জানানো হয়নি । শীর্ষ সম্মেলনের পরে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, এই ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরকারীরা পরবর্তী পদক্ষেপ হিসাবে এতে নির্দেশিত বিষয়গুলিতে দল বেধে কাজ করবে এবং যখন নথিতে ঘোষিত প্রতিটি পয়েন্ট বাস্তবায়নের জন্য একটি কর্ম পরিকল্পনা প্রস্তুত হবে তখন দ্বিতীয় শান্তি সম্মেলন করা যেতে পারে । পাশাপাশি এই পরিকল্পনাটি দ্বিতীয় শীর্ষ সম্মেলনে রাশিয়ার কাছে উপস্থাপন করা যেতে পারে ।
যদিও শীর্ষ সম্মেলনের ঘোষণাপত্র কাজে লাগতে শুরু করেছে এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য একটি শক্তিশালী বার্তা পাঠিয়েছে ৷ তবে এই ঘোষণাপত্রে রাশিয়া এবং চিনের মতো মূল খেলোয়াড়দের অনুপস্থিতি অগ্রগতির পথে বাধা এবং এই অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি অর্জনের জটিলতা ও চ্যালেঞ্জগুলিকে তুলে ধরে । তাদের অনুপস্থিতির কারণে আরও কিছু দেশ শীর্ষ সম্মেলন থেকে দূরে থাকছে । এর পিছনে ব্রিকসের দেশগুলি এবং সৌদি আরবের সমর্থনের অভাব একটি উল্লেখযোগ্য কারণ ।
ব্রাজিল, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা শীর্ষ সম্মেলনে ছিল ৷ কিন্তু কোনও রাষ্ট্রপ্রধান আসেননি । ব্রাজিল পর্যবেক্ষক হিসেবে এসেছিল এবং দক্ষিণ আফ্রিকা প্রতিনিধি পাঠিয়েছিল । সৌদি আরব তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল বিন ফাহরাদ আল-সৌদকে পাঠায় । ভারত পবন কাপুরকে পাঠিয়েছিল ৷ তবে শান্তি সম্মেলনে ভারত মুখ্য ভূমিকা পালন করবে বলে ইউক্রেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব পর্যায়ের সিনিয়র কর্মকর্তারা আশা করেছিলেন ।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সাম্প্রতিক সময় বৈঠক হয়েছে ৷ সেই বৈঠকের পরিপ্রেক্ষিতে জেলেনস্কি ব্যক্তিগতভাবে মোদিকে শান্তি সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য বোঝানোর চেষ্টা করেছেন । মস্কোর সঙ্গে ভারতের কৌশলগত সম্পর্ক রয়েছে এবং প্রতিরক্ষা সরবরাহের জন্য রাশিয়ার উপর নির্ভরতা রয়েছে ।
তবে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ভারতও কম দামে রাশিয়ান তেল কিনছে । রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনকে বিশ্বব্যাপী বিচ্ছিন্ন করা এবং মোদির মতো গ্লোবাল সাউথের নেতাদের রাশিয়ার বিরুদ্ধে সম্মেলনে যোগ দিতে রাজি করানো নিয়ে নয়াদিল্লিও সংশ্রয়ে ছিল । ফলস্বরূপ এই কারণগুলির পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রী মোদি সম্মেলনে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন । বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর বা পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রাকে সুইজারল্যান্ডে পাঠানো হয়নি ৷ যদিও তারা ইতালিতে জি-7 শীর্ষ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গেই ছিলেন ।
প্রধানমন্ত্রী মোদি সম্মেলনের জন্য সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা পবন কাপুরকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ৷ তিনি রাশিয়ায় ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন ৷ তিনি সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ, যৌথ অস্ত্র উৎপাদন এবং রাশিয়া থেকে তেল আমদানির ধারাবাহিকতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন । পবন কাপুরের মাধ্যমে শীর্ষ সম্মেলনে ভারত রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘর্ষের সময় তার কূটনৈতিক ভারসাম্যমূলক আচরণকে তুলে ধরে ।
ভারত রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে কূটনৈতিক ভারসাম্য বজায় রেখেছে । ভারত ক্রমাগত ইউক্রেনের যুদ্ধ বন্ধ করার এবং সংলাপ ও কূটনীতির পথে সমস্য সামাধানের আহ্বান জানিয়েছে ৷ যদিও নয়াদিল্লি স্পষ্টভাবে রাশিয়ান আক্রমণের নিন্দা করেনি এবং রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভারত একটি পরিমার্জিত ভূমিকা নিয়ে বেশ কিছু রেজল্যুশনে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে ।
ভারত ইউক্রেনকে সম্মান জানিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে ক্রমাগত একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে হাঁটার জন্য চাপ দিয়েছে ৷ পাশাপাশি বুচা হত্যাকাণ্ডের আন্তর্জাতিক তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে ভারত এবং রাশিয়ান নেতাদের দ্বারা জারি করা পারমাণবিক হুমকির বিষয়ে নয়াদিল্লি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে । ভারত মানবিক দুর্দশার কথা স্বীকার করেছে এবং ইউক্রেনে মানবিক সহায়তা প্রদান করেছে । ভারত 117 মেট্রিক টন ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম, কম্বল, তাঁবু, ত্রিপল, সোলার ল্যাম্প, কিট, ঘুমানোর ম্যাট এবং ডিজেল জেনারেটর সেট-সহ ইউক্রেনে মানবিক সহায়তার 15টি রকমের জিনস পাঠিয়েছে । ভারত কিয়েভের একটি স্কুল ফের চালু করার জন্য অর্থনৈতিক সহায়তা এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অর্থায়নের প্রস্তাব দিয়েছে ।
রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের সরাসরি প্রভাব না পড়লেও তেল, গম এবং ধাতুর মূল্যের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি-সহ বিশ্বব্যাপী জ্বালানি ও পণ্যের বাজারে এর প্রভাবের কারণে উন্নয়নশীল বিশ্ব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে । আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারত একটি বিশ্বস্ত বন্ধু হিসাবে রাশিয়ার সঙ্গে কথা বলার ক্ষমতা রয়েছে ৷ পাশাপাশি নয়াদিল্লির নিরপেক্ষ অবস্থান এবং ইউক্রেন-রাশিয়ার সঙ্গে গভীর কূটনৈতিক সম্পর্ক এটিকে উন্নয়নশীল দেশগুলির পক্ষে নেতৃত্ব দেওয়ার ও সমস্যার সমাধান করার যোগ্য করে তুলেছে ৷
হর্ষ পান্থের মতো বিশেষজ্ঞরা আশা করেছিলেন যে, শীর্ষ সম্মেলনে মোদির উপস্থিতি শক্তি সংকট, খাদ্যের নিরাপত্তাহীনতা এবং খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খলের ব্যাহত-সহ উদীয়মান অর্থনীতির উদ্বেগের বিষয়গুলিতে ভারতের অবস্থান তুলে ধরতে সহায়তা করবে ৷ যার সবকটিই ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে বেড়েছে ।"
আমেরিকার নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোট দ্বারা সমর্থিত রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে আটকে পড়েছে নয়াদিল্লি ৷ উভয়ই ভারতের বন্ধু ৷ তাই ভারত শান্তি সম্মেলনে সেক্রেটারি পর্যায়ের কর্মকর্তাকে প্রতিনিধি হিসাবে পাঠিয়েছে ৷ তবে ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেনি । অন্যদিকে শীর্ষ সম্মেলন এড়িয়ে গিয়ে এবং ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর না করে মোদি এই বার্তা দিতে চেয়েছেন যে, তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে বিচ্ছিন্ন করার পশ্চিমা প্রচেষ্টার পক্ষে নন ৷ যদিও কূটনীতি এবং আলোচনার মাধ্যমে ইউক্রেনে একটি প্রাথমিক শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে ভারত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ।