পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / opinion

ভারতকে অসন্তুষ্ট করে কি ভুল করল কানাডা ?

ভারত-কানাডার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক তলানিতে ৷ কানাডা কি ভারতকে অসন্তুষ্ট করে ভুল সিদ্ধান্ত নিল ? এখানে সেই ব্যাখ্যাই দেওয়া হয়েছে ৷

INDIA CANADA ROW
ভারতকে অসন্তুষ্ট করে কি ভুল করল কানাডা ? (এপি)

By Vivek Mishra

Published : Oct 17, 2024, 4:13 PM IST

গত 14 অক্টোবর ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক পদক্ষেপ নেয় ৷ কানাডার সঙ্গে ক্রমবর্ধমান কূটনৈতিক দ্বন্দ্বের জেরে ভারত সেখান থেকে হাই কমিশনার-সহ সব গুরুত্বপূর্ণ কূটনীতিকদের প্রত্যাহার করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় । হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ কী ছিল ? খালিস্তানি বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে পরিচিত হরদীপ সিং নিজ্জরের হত্যার তদন্ত ও সেই বিষয়ে দিল্লিতে কানাডিয়ান কূটনীতিকদের বহিষ্কার করা । ট্রুডো প্রশাসন এই তদন্তে কিছু ভারতীয় কূটনীতিককে ‘আগ্রহী ব্যক্তি’ হিসাবে ঘোষণা করেছে । এই পরিস্থিতির জেরে ভারত-কানাডা সম্পর্ক একেবারে তলানিতে এসে পৌঁছয় এবং আগামিদিনেও দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে ৷

মূল ইস্যুটি হল কানাডার অভিযোগ, যেখানে তারা নিজ্জর হত্যায় ভারতের জড়িত থাকার অভিযোগ করছে ৷ যাই হোক, ভারত অবিচলভাবে এই অভিযোগগুলি অস্বীকার করেছে ৷ জোর দিয়ে জানিয়েছে যে কানাডা এখনও কোনও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ দিতে পারেনি । ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, যদি এই ধরনের কোনও প্রমাণ থাকে, তবে তা কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে ভাগ করা উচিত ছিল । পরিবর্তে, কানাডার জনসাধারণের আচরণ প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর থেকে অনুপ্রাণিত বলে মনে হচ্ছে ৷ আর তা যথেষ্ট উদ্বেগের৷ কানাডার অভ্যন্তরীণ রাজনীতির স্পর্শকাতর অবস্থাও এর একটা কারণ ।

গত 14 অক্টোবর বিদেশমন্ত্রক থেকে বেরি আসছেন কানাডার চার্জ ডি’অ্যাফেয়ার্স স্টুয়াট হুইলার৷ (এএনআই)

ট্রুডোর রাজনৈতিক পরিকল্পনা

যদিও পঞ্জাবের খালিস্তান আন্দোলন কয়েক দশক আগে হ্রাস পেয়েছে ৷ কিন্তু কানাডার রাজনৈতিক পরিসরে এর একটা ছাপ রয়ে গিয়েছে ৷ সেখানে শিখ সম্প্রদায়ের কিছু অংশ বিচ্ছিন্নতাবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য চাপ অব্যাহত রেখেছে । এটা প্রশ্ন তোলে: কেন এই সমস্যাটিকে এখন প্রসারিত করা হচ্ছে ? উত্তর সম্ভবত কানাডার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে রয়েছে, যেখানে ট্রুডোর লিবারেল সরকার জগমিত সিংয়ের নেতৃত্বে নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি)-র সমর্থনের উপর অনেক বেশি নির্ভর করে । জগমিত সিং খালিস্তানিদের একজন সমর্থক হিসেবে পরিচিত এবং এই ইস্যুতে ভারতের সমালোচক । ট্রুডোর অনিশ্চিত রাজনৈতিক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে এটা বলা যেতে পারে যে ক্ষমতায় তাঁর দখল বজায় রাখার জন্য ভারতের প্রতি তাঁর সরকারের ক্রমবর্ধমান বিরোধিতামূলক অবস্থানের লক্ষ্য হল এনডিপি থেকে সমর্থন কমানো ৷

বর্তমান কূটনৈতিক সঙ্কট বোঝার জন্য কানাডার রাজনীতির অবস্থা সম্পর্কে জানতে হবে । ট্রুডোর লিবারেল পার্টি, 2015 সাল থেকে ক্ষমতায় রয়েছে ৷ কিন্তু তাঁদের বারবার হোঁচট খেয়েই চলতে হচ্ছে ৷ তাঁর সরকার বর্তমানে সংসদে মাত্র 150-এর বেশি আসন ধরে রেখেছে এবং পিয়েরে পোইলিভরের নেতৃত্বে কনজারভেটিভ পার্টি তাঁর সরকারকে বারবার চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে । সমীক্ষা বলছে যে কনজারভেটিভ পার্টি লিবারেলদের অনেকটা পিছনে ফেলে দিয়েছে ৷ তাদের প্রতি সমর্থন এখন 45 শতাংশ ৷ আর লিবারেলদের প্রতি এখন 23 শতাংশ সমর্থন রয়েছে ৷ 2025 সালের কানাডায় নির্বাচন রয়েছে ৷ তাই ট্রুডো তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানকে স্থিতিশীল করার জন্য প্রচুর চাপের মধ্যে রয়েছেন ।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো৷ (এএনআই)

কানাডার রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন যে চারটি ‘আই’ এর উপর নির্ভর করে ট্রুডোর জনপ্রিয়তা কমে যাচ্ছে ৷ সেগুলি হল - ইমিগ্রেশন (অভিবাসন), ইনকাম্বেন্সি (ক্ষমতা), আইডেনটিটি (পরিচয়) ও ইনফ্লেশন (মুদ্রাস্ফীতি) । ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি তাঁর সরকারের অর্থনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে ৷ অন্যদিকে অনিয়ন্ত্রিত অভিবাসন কানাডার জনবিন্যাসের পরিবর্তন নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করেছে ৷ এক সময়, কানাডা তার উন্মুক্ত-দ্বার অভিবাসন নীতির জন্য পরিচিত ছিল ৷ কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিততে এটাকে আর লাভজনক হিসেবে দেখা হয় না ৷ ট্রুডো আন্তর্জাতিক বিতর্ক তৈরি করে এই অভ্যন্তরীণ সঙ্কট থেকে সরে আসতে চাইছেন, যা তাঁর রাজনৈতিক কেরিয়ারকে বাঁচানোর একটি চেষ্টা হতে পারে ।

খালিস্তান ইস্যু একটি অতীত যুগের একটি অবশেষ

কানাডা দীর্ঘদিন ধরে খালিস্তানি সক্রিয়তার জন্য একটি উর্বর ক্ষেত্র এবং সেখানকার শিখ প্রবাসীদের যথেষ্ট রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে । এই প্রভাব খালিস্তানিদের অবস্থান কানাডিয়ান সমাজে সুসংহত করতে, রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে এবং তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষার স্বীকৃতির জন্য চাপ দিতে সক্ষম করেছে ।

মর্মান্তিক পরিহাস হল যে খালিস্তান ইস্যুটি একটি বিগত যুগের একটি স্মৃতিচিহ্ন, যা মূলত পঞ্জাবের তরুণ শিখ জনগোষ্ঠীর জন্য অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গিয়েছে ৷ তাঁরাও এসব পিছনে ফেলে এগিয়েও গিয়েছে । যাই হোক, কানাডায় এই ইস্যুকে জিইয়ে রাখা হয়েছে ৷ এর মাধ্যমে জগমিত সিং-এর মতো রাজনীতিবিদরা শিখ প্রবাসীদের ভোট সুরক্ষিত করার বিষয়টিকে নিশ্চিত করেছেন ৷ ট্রুডোর সরকার এই বিষয় সম্পর্কে গভীরভাবে সচেতন ৷ আর তারা ভারতের সঙ্গে একটি গঠনমূলক সম্পর্ক গড়ে তোলার চেয়ে দেশীয় রাজনৈতিক বিবেচনাকে অগ্রাধিকার দেওয়াকেও বেছে নিয়েছে । এটা করার মাধ্যমে লিবারেল পার্টি কেবল দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককেই বিপন্ন করেনি ৷ বরং ইন্দো-প্যাসিফিকের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারকে বিচ্ছিন্ন করার ঝুঁকিও নিয়েছে ।

ভারতের সার্বভৌমত্বের উপর সরাসরি আক্রমণ

এই বিরোধের মূলে রয়েছে সার্বভৌমত্বের ইস্যু । ভারত এখন বিশ্বে বড় শক্তি হিসেবে উঠে আসছে ৷ তাছাড়া ভারতের বিশ্ব মঞ্চে বৃহত্তর ভূমিকা নেওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে ৷ ফলে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে, বিশেষত বিচ্ছিন্নতার ইস্যুতে কোনও বহিরাগত হস্তক্ষেপ ভারতের তরফে সহ্য করার সম্ভাবনা কম । ভারতের জন্য কানাডায় খালিস্তানি বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রচারকে তার সার্বভৌমত্বের উপর সরাসরি আক্রমণ হিসাবে দেখা হয় । এই ইস্যুতে নয়াদিল্লির দৃঢ় অবস্থান কেবল নিজ্জরের হত্যার বিষয়ে নয়, এটা একটা স্পষ্ট বার্তা পাঠানোর চেষ্টা ৷ সেই বার্তা হল - যে দেশেই হোক, তা সে যত দূরেই হোক না কেন, যারা ভারতের আঞ্চলিক অখণ্ডতা নষ্ট করতে চায়, তাদের জন্য সেই দেশ নিরাপদ আশ্রয় দিতে পারে না ।

হরদীপ সিং নিজ্জরের হত্যার পর দল খালসার সদস্যদের অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে বিক্ষোভ (এএনআই)

কানাডা খালিস্তানিদের কাজ করার অনুমতি দিয়ে দায় ঝেড়ে ফেলেছে ৷ ফলে বিশ্বমঞ্চে তার অবস্থানের সঙ্গে আপস করেছে । ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের অবনতির পরিণতি দীর্ঘস্থায়ী হবে ৷ কারণ, কানাডা একটি ক্রমবর্ধমান জটিল আন্তর্জাতিক পরিবেশে নিজেদের রাখতে চাইছে ৷ যদিও দেশীয় রাজনীতি প্রায়শই একটি দেশের বিদেশনীতি তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে৷ আর কানাডা এই বিষয়টিকে চরমে নিয়ে গিয়েছে ।

ট্রুডোর পদক্ষেপের ফলে ভারত ও কানাডার মধ্যে বাণিজ্য আলোচনা স্থগিত হয়ে যায় এবং ভবিষ্যতে সহযোগিতার সম্ভাবনা কমে যায় । গ্লোবাল সাউথ ও ইন্দো-প্যাসিফিকের প্রধান খেলোয়াড় ভারতের বিরোধিতা করার ক্ষেত্রে কানাডার ভুল হিসাব অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হতে পারে । চিনের সঙ্গে কানাডার সম্পর্ক ইতিমধ্যেই উত্তেজনাপূর্ণ হওয়ায় কানাডা এশিয়া থেকেই হারিয়ে যেতে পারে ।

নয়াদিল্লিতে কানাডার হাইকমিশন৷ (পিটিআই)

ট্রুডো যেহেতু 2025 সালের নির্বাচনের মুখোমুখি হচ্ছেন, তাই প্রশ্ন এটা নয় যে তিনি জিতবেন না হারবেন, তবে দেশে সন্ত্রাসবাদ নিয়ে তিনি কী অবস্থা রেখে যাবেন, সেটাই আসল প্রশ্ন ৷ ভারত-কানাডা সম্পর্কের যে ক্ষতি হয়েছে, তা মেরামত করা কঠিন হবে এবং বছরের পর বছর ধরে তৈরি হওয়া কাজের অগ্রগতির বেশিরভাগই এখন থেমে গিয়েছে ।

ABOUT THE AUTHOR

...view details