পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / opinion

নতুন অস্ত্রের উৎপাদনে জোয়ার এনেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বদল এসেছে প্রযুক্তিতেও - RUSSIA UKRAINE WAR

গত তিন বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে এসেছে একাধিক বদল। রণকৌশল থেকে সমারাস্ত্র-প্রতিটি ব্যাপারেই লেগেছে নতুনের ছোঁয়া।

Russia Ukraine War
পুতিন ও ট্রাম্প (ফাইল চিত্র)

By Major General Harsha Kakar

Published : Feb 12, 2025, 6:47 PM IST

আর মাত্র কয়েকটি দিন পর আসতে চলেছে 24 ফেব্রুয়ারি। তিন বছর আগে ঠিক এদিনই রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে সংঘাতের শুরু হয়েছিল। সংঘাতের চতুর্থবর্ষ শুরু হচ্ছে। আমেরিকায় রাজনৈতিক পালাবদল ঘটে গিয়েছে। এমতাবস্থায় শান্তির বার্তা দিয়েছেন ইউক্রেনে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কি । ব্রিটিশ সাংবাদিক পিয়ের্স মর্গানকে দেওয়া সক্ষাৎকারে তিনি জানান, রাশিয়া এবং ইউক্রেনের সংঘাত শেষ করার একমাত্র পথ যদি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করা হয় তাহলে তাতে তিনি রাজি । তবে ওই বৈঠকের আগে তিনি হোয়াইট হাউজের নতুন বাসিন্দা ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলতে চান বলেও জানিয়েছেন ।

ট্রাম্প অবশ্য জানিয়েছেন, তাঁর সঙ্গে টেলিফোনে পুতিনের কথা হয়েছে। সেখানেও তিনি যুদ্ধ শেষ করার বার্তা দিয়েছেন। ঠিক কতবার দুই নেতার কথা হয়েছে তা অবশ্য বলেননি ট্রাম্প। তবে তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছে, "প্রতিদিন মানুষের প্রাণ যাচ্ছে। ইউক্রেনের জন্য এই যুদ্ধ ভালো নয় । আমি যে কোনও উপায় এই যুদ্ধ শেষ করতে চাই।" অন্যদিকে, জেলেনস্কি মনে করেন, তাঁদের বাদ রেখে যুদ্ধকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া সংঘাত শেষ করার চেষ্টা হচ্ছে । তাঁর কথায়, "আমাদের সমস্যা আমাদের অন্ধকারে রেখে অন্য কেউ সমাধান করে দেবে সেটা হতে পারে না।"

তিন বছর ধরে চলতে থাকা যুদ্ধে অনেক পরিবর্তন এসেছে। প্রযুক্তির দিক থেকেও এসেছে বিরাট বদল। বদলেছে কৌশলও। ভারত-সহ বেশ কয়েকটি দেশের এই যুদ্ধ এবং তার হাত ধরে থাকা পরিবর্তন থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। তাছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম দুটি রাষ্ট্র এভাবে একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হল।

রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করতে ইউক্রেনের সেনা বাহিনীকে আমেরিকা এবং ন্যাটো বাহিনী প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। রাশিয়া জানত, আফগানিস্তান এবং জর্জিয়ায় তারা যেভাবে যুদ্ধ করেছে তার থেকে ইউক্রেনের অভিজ্ঞতা আলাদা হতে চলেছে। রাশিয়ার প্রথমে মনে হয়েছিল ইউক্রেনের বাহিনী প্রশিক্ষিত নয় বলে তাদের পক্ষে রাজধানী কিভে পৌঁছে যাওয়া তেমন সমস্যার বিষয় হবে না। কিন্তু তা হয়নি । প্রথম থেকেই ইউক্রেন রাশিয়াকে প্রতিহত করতে তৎপর ছিল। আর তার জেরে দু'পক্ষের বহু মানুষের প্রাণ যায় ।

শুরুর সময় থেকেই দু'পক্ষ নানা শিক্ষা পেয়েছে । রাশিয়া বুঝতে পেরেছিল, তাদের ভাবনায় বদল আনার সময় এসেছে। অস্ত্র ব্যবহার ক্ষেত্রে বদল আনা দরকার মানসিকতায়। কারণ,শুধুমাত্র কৌশলের সাহায্যে প্রতিপক্ষ অ্য়ান্টি ট্যাঙ্ক হাতিয়ারের সাহায্য়েই বড় ধরনের ক্ষতি করে দিতে পারে। এই ভাবনা থেকেই যুদ্ধের কৌশলে বদল আনে তারা। যুদ্ধে ব্যবহৃত ট্যাঙ্কে বদল আসে । পাশাপাশি সেনা বাহিনীর প্রয়োজন এমন বেশ কিছু সামগ্রী উৎপাদনেও মন দিতে হয় তাদের। ইউক্রেনকে অস্ত্র দিয়েছিল ন্যাটো। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে জেলেনস্কিরা বুঝলেন, সেই সব অস্ত্রের বেশিরভাগই তাঁদের ব্যবহারের উপযুক্ত নয়। পাশাপাশি রাশিয়ার কৌশলও মাঝেমধ্যে ইউক্রেনের অস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করেছে।

ড্রোন-প্রযুক্তির দিক থেকে রাশিয়া আমেরিকার থেকে অনেকটা পিছিয়ে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় এই বিষয়টি প্রভাব ফেলেছিল। আমেরিকা আফগানিস্তানে উচ্চ-প্রযুক্তির ড্রোন ব্যবহার করত। রাশিয়ায় সেই সমস্ত ড্রোন ব্যবহার করে সাফল্য পেয়েছে ইউক্রেন। রাশিয়া 2019 সালে ল্যানসেট ড্রোন তৈরি করেছিল । 2022 সালে যুদ্ধ শুরুর সময়ও ড্রোনের উপর পরীক্ষার কাজ চলছিল। অতএব ড্রোনের সংখ্যা খুব একটা বেশি ছিল না। কিন্তু এর ব্যবহার ছাড়া যে যুদ্ধে সুবিধেজনক অবস্থায় থাকা যাবে না তা বুঝতে পুতিনদের খুব একটা বেশি সময় লাগেনি। তারা ল্যানসেট ড্রোনের উৎপাদন একলপ্তে অনেকটা বাড়িয়ে দেয় । তার আগে পর্যন্ত ইরানের ড্রোন কাজে লাগাচ্ছিল রাশিয়া ।

ইউক্রেন এস300 অ্য়ান্টি এয়ারক্র্যাফ্ট মিসাইল নিয়ে যুদ্ধ করছিল। তার ফলে রাশিয়াকে বাধ্য হয়ে অনেকটা দূর থেকে গ্লাইড বোমা নিক্ষেপ করতে হয়েছে। যুদ্ধ শুরুর বেশ কয়েক বছর আগে শব্দ-তরঙ্গের সাহায্যে 2018 সাল থেকে রাশিয়া পেনিসিলিন কাউন্টার ব্যাটারি আর্টিলারি সিস্টেমের পরীক্ষা চালিয়ে আসছিল। এমতাবস্থায় গ্লাইড বোমা সব প্রয়োজন মেটাতে পারছিল না। বাধ্য হয়ে আর্টিলারি সিস্টেমের ব্যবহার বাড়ায় রাশিয়া। পাশাপাশি বাড়ে পরীক্ষাও । 2023 সাল থেকে এই অস্ত্রের ব্য়বহার হচ্ছে যুদ্ধে ।

যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে অন্যত্র ওয়ার রুম তৈরি করেছে ন্যাটো। উপগ্রহ চিত্রের সাহায্যে রাশিয়ার বাহিনীর গতিবিধির উপর নজরদারি চলছে । সেই তথ্য সঙ্গে সঙ্গে পৌঁছে যাচ্ছে ইউক্রেনের কাছে। পাশাপাশি মোবাইলের লোকেশন ট্র্যাক করেও তথ্য পাচ্ছে ন্যাটো । সেটাও কাজে লেগেছে ইউক্রেনের। পাশাপাশি কোন কোন অস্ত্রের ক্ষতি হয়েছে তা জানতে থ্রিডি পিন্টার্সও ব্যবহার করেছে ইউক্রেন। তার ফলে এই ধরনের তথ্য জানতে সময়ও অনেক কম লাগে।

রাশিয়াও কৌশল দিয়ে মাত করার চেষ্টা করে আসছে সেই প্রথম থেকে। তারা জানে, তাদের কাছে থাকা ড্রোন অত্যাধুনিক নয়। ঠিক সেখান থেকে তারা নিজেদের সস্তার ড্রোন ইউক্রেনের বিভিন্ন এলাকার উপর দিয়ে ওড়ায়। বিপদ রুখতে সেই সমস্ত সস্তার ড্রোনের জন্য মোটা টাকা খরচে তৈরি মিসাইল ব্যবহার করতে হয়েছে ইউক্রেনকে । আমেরিকা ইউক্রেনকে হাই মবালিটি আর্টালারি রকেট সিস্টেম দিয়েছিল। তাতে রাশিয়ার সমস্যা বেড়েছিল অনেকটা। পাল্টা জিপিএস সিস্টেম জ্যাম করে দেয় রাশিয়া। আর তার ফলে এই অস্ত্র ব্যবহারের উপযুক্ত থাকেনি ।

এরপর আমেরিকা আর্মি ট্যাকটিকাল মিসাইল সিস্টেম দিয়ে সাহায্য করেছিল ইউক্রেনকে । সাধারণ মিসাইল বা রকেটের থেকে এই মিসাইলের ক্ষমতা অনেক বেশি । অনেক দূর থেকে নিক্ষেপ করে ফলও পাওয়া যায়। এই মিসাইলে কাজ হয়। আর তার ফলে রাশিয়া তাদের বিমান অন্যত্র সরাতে বাধ্য হয়। অন্যদিকে, রাশিয়াকেও এই সমস্ত মিসাইলকে ধবংস করতে উদ্যোগ নিতে হয়েছে ।

ন্যাটো বুঝতে পেরেছিল রাশিয়া ইউক্রেনকে হারাতে পারলে সেখানেই থেমে থাকবে না। ইউরোপের অন্য দেশের দিকে হাত বাড়াবে। জেলেনস্কিও তাঁর নানা ভাষণে এই বিষয়টির উপর গুরুত্ব দিতে শুরু করেন। আর তার ফলে বিভিন্ন দেশ ইউক্রেনকে সামরিক দিক থেকে সাহায্য করেছে । আমেরিকরা রিপাবলিকানরা অবশ্য জেলেনক্সির এই কথায় বিশ্বাস করেনি। তারা টানা দাবি করছিল, ইউক্রেনকে যে পরিমাণ অর্থ সাহায্য করা হচ্ছে তা কমিয়ে আনতে হবে। রাশিয়া আমেরিকার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেও যুদ্ধ বন্ধ করতে পারেনি। যুদ্ধের ফলে রাশিয়ার অর্থীনীতি ধাক্কা খেয়েছে ঠিকই কিন্তু ভেঙে পডার মতো জায়গায় যায়নি।

জেলেনস্কি শুরু থেকে বলে আসছেন, ইউক্রেনকে ন্যাটোয় অন্তর্ভুক্ত করলেই সংঘাতের সমাপ্তি হবে। ন্যাটোয় থাকা দেশ গুলি এই যুক্তি মানতে রাজি হয়নি। কারণ, তারা জানত ইউক্রেনকে ন্যাটোয় নিলে পুতিন ক্ষুব্ধ হবেন। তাই তারা রাজি হয়নি। আর সেদিক থেকে এই লডাই ইউক্রেনের কাছে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার হয়ে উঠেছে । 2023 সালে প্রায় একই কথা বলেছিললেন ইউক্রেনের তৎকালীন সেনা প্রধান ভালেরি ঝালুজনি। তাঁর মনে হয়েছিল, যুদ্ধ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে সেখান থেকে প্রতিপক্ষ নতুন করে আক্রমণ শুরু করলে ইউক্রনের বিপদ বাড়বে। এরপরই তাঁকে পদ থেকে সরিয়ে দেওযা হয়।

আমেরিকায় ট্রাম্প আসার পর বদল এসেছে। আমেরিকার চাপে জেলেনস্কিও সংঘাত শেষের ব্যাপারে চিন্তা করতে বাধ্য হয়েছেন। পাশাপাশি ট্রাম্প নিজে বারবার বলেছেন, তিনি চান যুদ্ধ শেষ হোক আর সেই কারণে পুতিনের সঙ্গে কথাও বলবেন। জেলেনস্কি জানেন, ইউক্রেনের প্রায় 20 শতাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ তাঁর হাত থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। সেই এলাকায় তিনি আগামী কোনওদিন নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাবেন এমন সম্ভাবনাও বেশ কম। সবমিলিয়ে তিন বছরের বেশি সময় ধরে চলতে থাকা যুদ্ধ এই বছর শেষ হতে পারে। তবে তারা আগে চরম ক্ষতি হয়েছে দু'পক্ষের। ইউক্রেন কার্যত ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।

(ডিসক্লেইমার: এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব । এখানে প্রকাশিত তথ্য এবং বিশ্লেষণ ইটিভি ভারতের মতামতকে প্রতিফলিত করে না)

ABOUT THE AUTHOR

...view details