প্রকৃতি আমাদের সবাইকে আলাদাভাবে তৈরি করেছে । চোখের মণি থেকে শুরু করে হাতের ছাপ, চিন্তাভাবনার গভীরতা থেকে মানসিক প্রস্তুতি বা প্রতিভা থেকে প্রাপ্তির নিরিখে আমরা সবাই একে অপরের থেকে আলাদা । প্রকৃতিগত ভাবে আলাদা হওয়াই আমাদের সমাজ-ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট। প্রতিটি মানুষের এভাবে স্বতন্ত্র হওয়ার প্রতিফলন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় থাকা অবশ্যই দরকার । প্রতিটি শিশু এক ভাবলে ভুল হবে । কেউ হয়তো পড়াশুনোয় ভালো । কেউ আবার দারুণ চিন্তাশক্তির অধিকারী, কারও মন আবার পড়ে থাকে খেলার মাঠে । ঠিক এই প্রসঙ্গেই স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, “শিক্ষা হল মানুষের মননে থাকাা প্রতিভার প্রকাশ।”
কোনও এক পড়ুয়া কী চাইছে এবং কীভাবে এগোলে তার সবথেকে বেশি ভালো হবে তা উপলব্ধি করে সেভাবে পথের দিশা তৈরি করা যে কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষক বা নীতি নির্ধারক হিসেবে আমাদেরও কাজ প্রতিটি শিশুর মধ্যে থাকা এই বিশেষ প্রতিভাকে খুঁজে বের করা। কারণ, একমাত্র সেভাবেই সে নিজের প্রতিভার সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটাতে পারবে। নিজেকে নিয়ে যেত পারবে সাফল্যের শিখরে । 2020 সালে লাগু হওয়া নয়া শিক্ষা নীতি প্রতিভার অন্বেষণ করে । প্রতিভাকে সেরার আসনে প্রতিষ্ঠা করে। প্রায়োগিক দিকের পাশাপাশি দার্শনিক দিক থেকেও প্রতিটি প্রতিভাকে আলাদা করে চিহ্নিত করা এবং পড়ুয়াকে সেরার মঞ্চে পৌঁছে দেওয়াই এই নীতির লক্ষ্য। এভাবে এগিয়ে যেতে পারলেই প্রতিটি পড়ুয়া দেশের উন্নতির জন্য সবচেয়ে বেশি অবদান দিতে পারবে ।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দূরদর্শী নেতৃত্বে আমরা শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনছি । শিক্ষা প্রাপ্তি এবং তার সঙ্গে জুড়ে থাকা প্রতিটি অভিজ্ঞতা যেন ভালো হয় সেটা মাথায় রেখেই আমরা কাজ করছি । শিক্ষা যদি পড়ুয়ার কাছে বোঝা হয়ে ওঠে তাহলে তা কোনও কাজে লাগবে না । কারও কোনও ভালো হবে না । শিক্ষার পাশাপাশি পরীক্ষা ব্যবস্থাও আমরা একইভাবে তৈরি করেছি । সেখানে কোনও নেতিবাচক মনোভাবের স্থান নেই । সদর্থক মনোভাব নিয়ে শিক্ষা গ্রহণের এই প্রক্রিয়া প্রাথমিক থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে । উচ্চশিক্ষার পর যাঁরা গবেষণা করতে যাচ্ছেন তাঁরাও এই পরিবর্তন বুঝতে পারছেন ।
খেলার মাধ্যমে শিক্ষা প্রাপ্তির বিষয়টি কয়েক বছর আগে পর্যন্ত সমালোচিত হত। কিন্তু নয়া শিক্ষা নীতি শিক্ষাদানের এই পদ্ধতিকে জনপ্রিয় করেছে। শুধু তাই নয়, জীবনের একেবারে শুরুর দিকে পড়াশোনাতেও আসছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। আবারও মনে রাখা দরকার, এই নয়া শিক্ষা নীতি প্রতিটি পড়ুয়ার প্রতিভা অন্বেষণ করতে সক্ষম।
একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মূল্যায়ন অন্যটির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা । এই বিষয়টি অবশ্যই শিক্ষায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার জন্ম দেয়। পাশাপাশি এটাও বুঝিয়ে দেয় জীবনের চলার পথের মতো শিক্ষা প্রাপ্তির পথও সর্পিল । চিরাচরিত পদ্ধতির বাইরে গিয়েও শিক্ষা পাওয়া সম্ভব । পড়ুয়া তার জীবনের কোনও এক বিশেষ সময় পদ্ধতিগত শিক্ষা থেকে বিরতি নিতে পারে । সে সময় সে কোনও ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা অর্জনে মন দিতে পারে । অথবা পারিবারিক প্রয়োজনে উপার্জন করতে পারে। এরপর আবারও সে যখন প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনোয় ফিরবে তখন তার কাজের সূত্রে পাওয়া ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা যাতে শিক্ষাকে আত্মস্থ করতে সাহায্য করে সেই ব্যবস্থাই করে দিয়েছে নয়া শিক্ষা নীতি । এই নীতি আসলে একটা কথা সবসময় বোঝাতে চায়- তা হল, শেখার ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয় । আর তাই পড়াশুনো দুনিয়ায় ফিরে আসার ব্যাপারে বয়স কোনও বাধা নয় ।
আমাদের সরকার সব সময় চেষ্টা করে এমন এক পরিবেশ তৈরি করতে যেখানে পরীক্ষার সাফল্য সামগ্রিক উন্নতিকে ছাপিয়ে যাবে না । অথবা পরীক্ষায় সাফল্য পেতে মানসিক স্বাস্থ্যকে বিসর্জন দিতে হবে না । আর সেই কারণে আমরা শুরু করেছি ‘পরীক্ষা পে চর্চা’ অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানে পরীক্ষার্থী থেকে শুরু করে তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। আর তাই পরীক্ষা ঘিরে থাকা উদ্বেগ এখন সংলাপের রূপ নিয়েছে। যে কথা পড়ুয়ারা আগে কখনও বলতে পারেনি আজ তা নিয়েই তারা মন খুলে আলোচনা করছে। বছরের পর বছর ধরে প্রধানমন্ত্রীর এই পরিশ্রম দেশকে পরীক্ষা-উদ্বেগ থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করেছে।
পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি । পরীক্ষার্থীরাও তাঁর এই উপদেশ ভালোভাবে নিয়েছে । তাতে ভয় কেটে গিয়েছে। প্রতিটি পড়ুয়া এখন নিজের সেরা দিতে পারছে । আমরা সকলে এমন এক নেতাকে সামনে থেকে দেখছি যিনি নিজের হাতে দেশের ভবিষ্যৎ তৈরি করছেন এমন প্রজন্ম যারা দেশের উন্নতিতে ইতিবাচক ভূমিকা নেবে ।
‘পরীক্ষা পে চর্চা’ এমন একটি অনুষ্ঠান যেখানে ছাত্রদের মধ্যে পড়াশোনা সম্পর্কে ইতিবাচক মানসিকতার জন্ম হয় । দেশের প্রতিটি ক্লাসরুমে এই মানসিকতার সঞ্চার হওয়া একান্ত প্রয়োজন। শুধুমাত্র দ্বাদশ বা দশম শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রী নয় সমস্ত পড়ুয়ার পড়াশোনা সম্পর্কে এই সদর্থক মনোভাব প্রয়োজন। সকলকে বুঝতে হবে পড়াশোনা কোনও বোঝা নয় ।
ঠিক এই কারণেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনে করতেন, কোনও শিশুকে নির্দিষ্ট পড়াশুনার মধ্যে আবদ্ধ রাখা উচিত নয় । কারণ সে এক অন্য সময় পৃথিবীতে এসেছে। আমাদের শিক্ষানীতির এটাই মূল ভিত্তি। আমাদের লক্ষ্য পড়ুয়াদের মধ্যে প্রকৃত শিক্ষার বিস্তার ঘটানো। এখানেই আমরা মনে করি স্কুলের শিক্ষক থেকে শুরু করে পরিবারের সদস্য সকলেরই ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আশপাশের পরিবেশে বদল আনা প্রয়োজন। মুক্ত মনে শিশুরা যাতে প্রকৃত শিক্ষা লাভ করতে পারে এবং জীবনে সাফল্যের শিখরে পৌঁছতে পারে তা নিশ্চিত করাই আমাদের কাজ।
ক্লাসরুম থেকে খেলার মাঠ, বৃত্তি শিক্ষা থেকে গবেষণাগার- সর্বত্র প্রতিভা যাতে নিজেদের তুলে ধরার সুযোগ পায় সে ব্যবস্থাই করা আছে এই শিক্ষা নীতিতে। একটা সময় এত ভাবনা চিন্তা না করে একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। কিন্তু তাতে কাজের কাজ হয়নি। এখন সেই পুরনো ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে নতুন পদ্ধতি চালুর সময় এসেছে ।
‘বিকশিত ভারত’ তৈরির লক্ষ্যে আমরা পরিশ্রম করছি। দেশের এই বদলে যাওয়ার অনেকটাই নির্ভর করে শিক্ষার উপর। আমরা মনে করি, প্রতিটি প্রতিভার গুরুত্ব আছে। প্রতিটি ছাত্র তার জীবনে যে পথ পেরিয়ে উন্নতির দিকে অগ্রসর হচ্ছে সেই যাত্রার আলাদা গুরুত্ব আছে। আর তাই কীভাবে তার নিজের উন্নতি সম্ভব তা বেছে নেওয়ার অধিকারও প্রতিটি ছাত্রের আছে । সমাজের ভিত্তি শক্ত করতে এবং দেশকে এক নয়া রূপ দিতে আমরা সকলেই বদ্ধপরিকর।
এই মহান দেশের কাছে আজ আমার আহ্বান, শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন শুধুমাত্র সরকারি উদ্যোগে সম্ভব নয়। কার্যকরী শিক্ষা ব্যবস্থা আসলে এক ‘ন্যাশনাল মিশন’। আমাদের সকলের পরিশ্রম দায়বদ্ধতা এবং সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া এই পরিবর্তন হবে না। নাগরিক সমাজ এবং সরকারের যৌথ অংশীদারিত্বে ভাবনায় বদল আসবে, শিক্ষা ব্যবস্থা বদলাবে। দেশের পড়ুয়ারা নিজেদের প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়ে দেশকে গর্বিত করবে । প্রতিটি ছাত্রের অনন্য সাধারণ প্রতিভার মধ্যেই দেশের গৌরব লুকিয়ে আছে। ভার-মুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের এক নতুন দিনে পৌঁছে দেবে। ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের প্রতিভা দিয়ে বিকশিত ভারতের স্বপ্নকে সার্থক করবে।