নীরেন্দ্র দেব
মণিপুরে রাষ্ট্রপতি শাসন লাগু হয়েছে। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই অবসান হয়েছে এন বীরেন সিংয়ের সরকারের। দীর্ঘদিন ধরে তাঁর পাশে ছিল কেন্দ্রীয় সরকার। তাঁকে সুরক্ষাও দিয়েছে। কিন্তু শেষমেশ যা হওয়ার তাই হয়েছে। কংগ্রেস অনাস্থা আনতে পারে এমন সম্ভাবনার আবহে 9 ফেব্রুয়ারি ইস্তফা দেন বীরেন । এরপর 13 তারিখ লাগু হয় রাষ্ট্রপতি শাসন ।
রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করে এক বিবৃতিতে রাষ্ট্রপতি বলেন, "আমি মণিপুরে রাজ্যপালের থেকে একটি রিপোর্ট পেয়েছি। অন্য কয়েকটি জায়গা থেকেও আমার কাছে তথ্য় এসেছে। তা থেকে আমি নিশ্চিত সংবিধানের দেখিয়ে দেওয়া পথ অনুসরণ করে সরকার পরিচালন করতে মণিপুরের সরকার ব্যর্থ হয়েছে।"
2023 সালের মে মাসের 3 তারিখ থেকে শুরু হওয়া হিংসা বীরেন সিংয়ের ইস্তফার সঙ্গে শেষ হয়ে গিয়েছে, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই । এখনও মণিপুর অশান্ত। তার জেরে কুকি সম্প্রদায়ের লোকজন এখনও রাজধানী ইম্ফলের দিকে আসতে পারছেন না। আবার মেইতেই এবং হিন্দুরা চূড়াচাঁদপুরে যেতে পারছেন না।
13 ফেব্রুয়ারি লাগু হয় রাষ্ট্রপতি শাসন (ইটিভি ভারত) কোনও সঙ্কটের পরিস্থিতিতে একজন মুখ্যমন্ত্রীর থেকে কয়েকটি জিনিস আশা করা হয়। ধরে নেওয়া হয় তিনি সমস্যা সমাধানের জন্য কৌশল তৈরি করবেন। এখানেই ব্যর্থ বীরেন সিং। বীরেন সিংয়ের ইস্তফার সঙ্গে সঙ্গে মণিপুরে রাজনীতিতে শূন্যস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া কয়েকটি প্রশ্নও উঠে গিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের সংরক্ষণ পাওয়া বীরেন সিং নিজেকে মেইতি সম্প্রদায়ের পুরধা হিসেবে তুলে ধারার চেষ্টা করেছিলেন। তার সেই পরিকল্পনা কাজে আসেনি। 2017 সালে কংগ্রেসের বড় নেতা ওকরাম আইবোবি সিংয়ের পরাজয়ের পর অনেকেই মনে করেছিলেন বীরেন সিং সেই জায়গা নেবেন। কিন্তু তা হয়নি।
মণিপুরের এক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, "বীরেন সিংয়ের কিছু সমস্যা আছে। কখনও তিনি নিজের মেইতেই সম্প্রদায়ের লোকেদের বিরোধিতা করেছেন । কারণ তাঁরা তফশিলি উপজাতির মর্যাদা চেয়ছিলেন। কখনও আবার অশান্তির জন্য দায়ী করেছেন বিদেশের শক্তিকে। এসবই আসলে নিজের দোষ ঢাকার উপায়। " প্রজাতন্ত্র দিবসের সময় বেশ কয়েকজন সাংবাদিক মণিপুরে গিয়েছিলেন। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে তাঁরা দেখেছেন এখনও রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় যথেষ্ট উত্তেজনা আছে। সেই দলে আমিও ছিলাম।
ইম্ফলের বাজার এলাকায় বিকেলের দিকে পরিস্থিতি বেশ স্বাভাবিক। আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল দুই মহিলা বিক্রেতার। তাঁদের একজন ইমিটেশনের গয়না বিক্রি করছিলেন। অন্যজনের নাম মেইমা। বয়স প্রায় 70। তিনি যা বললেন তা রাজনৈতিক দিক থেকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁর কথায়, "মণিপুরে কংগ্রেস আর বিজেপি দুটি দলই ব্যর্থ হয়েছে। আমি কমিউনিস্ট। সিপিআইকে সমর্থন করি। আমার প্রিয় দলের এখানে আরও বেশি করে কাজ করা উচিত।"
নির্মলা দেবী নামে এক কমবয়সি মহিলা বিক্রেতাও বিজেপি সরকারের কাজে অখুশি। তিনি বলেছিলেন, "বীরেন সিং যদি অশান্তি রুখতে ব্যর্থ হন তাহলে কেন তাঁকে ক্ষমতায় রেখে দেওয়া হয়েছে। কেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ তাঁর বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করছেন না! কেন তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে না।" তবে অন্য কয়েকটি ব্যাপারে বীরেন সিংকে সমর্থন করেছেন নির্মলা। তিনিও মনে করেন, মায়ানমার থেকে বহু মানুষ মণিপুরে চলে আসছেন। তার জেরে কুকি সম্প্রদায়ের সদস্য-সংখ্যা বাড়ছে।
সরকার পড়ার নেপথ্যে
বীরেন সিংয়ের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা অন্যত্র। তাঁর সময়ে রাষ্ট্রযন্ত্র ভেঙে পড়েছে। সরকারি আধিকারিকদের সঙ্গে সঠিক ব্যবহারও করতে পারেননি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। পরিস্থিতি কেমন ছিল তা ব্যাখ্যা করে প্রশাসনের এক আধিকারিক বলেন, "আমাদের প্রায়শই মনে হত আমরা হিটলারের নির্দেশ পালন করছি। "
একটা সময় মনে করা হত, মুখ্যমন্ত্রী (অধুনা প্রাক্তন) নিজেকে ক্ষমতার কেন্দ্রে রাখতে ভালোবাসেন । তবে ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার আগে আগে এই ভাবনায় বদল এসেছিল। সমাজ কর্মী থেকে শুরু করে কুকি সম্প্রদায়ের অনেকেই মনে করতে শুরু করেছিলেন বীরেন প্রশাসন বা সরকার পরিচালন নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখাতেন না। তাঁর শুধু লক্ষ্য ছিল নিজের আশাপাশে কী হচ্ছে সেটা দেখা। তাঁকে দিল্লির সরকার ক্ষমতায় রাখবে নাকি সরিয়ে দেবে সেটা নিয়েই ভাবিত ছিলেন। চূড়াচাঁদপুরে কর্মরত এক কুকি পুলিশ আধিকারিক বলেছেন, "মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে যা যা খারাপ হয়েছে তার জন্য তিনি নিজেই দায়ী।"
অবসান হয়েছে এন বীরেন সিংয়ের সরকারের (ইটিভি ভারত) ইম্ফলে বসবাসকারী মেইতেই সম্প্রদায়ের লোকেদের জন্য কয়েকটি বড় সমস্যা ছিল। সালিশি সভা বসিয়ে বিচার করা ছিল তার অন্যতম। আইনের শাসন না মেনে এভাবে সভা ডেকে বিচার করার বিষয়টি মেইতই সম্প্রদায়ের লোকজন মেনে নিতে পারেননি। সম্প্রতি ধর্ষণের শিকার এক বছর আঠাশের যুবতী পুলিশে অভিযোগ দায়ের করেননি। কিন্তু অভিযুক্তর বিচার হয়েছিল। ইউএনএলএফ নামে একটি সংগঠন বিবৃতি জারি করে জানায়, ধর্ষণের বিচার হয়েছে। 30 বছর বয়সি যুবকের হাত ও পায়ে গুলি করে বিচার করা হয়েছে। যুবতী জানান, 10 জানুয়ারি ইম্ফলের এক হটেলে এই ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এর ঠিক চারদিন পর বিচার দেওয়ার কথা জানায় ইউএলএফ।
এমন সমস্ত সংগঠনের শক্তি বৃদ্ধির বিষয়টি একদমই নতুন নয়। মণিপুরের 37 জন বিধায়ক এবং দু'জন সাংসদ মেইতেই সম্প্রদায়ের। 2024 সালে তাঁদের 'ডেকে পাঠায়' আরামবি তেনগল নামে একটি সংগঠন। 2023 সালে সংঘর্ষের পর থেকে এই সংগঠনটি তৈরি হয়। নাগরিকদের অস্ত্র পরিচালনার প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে সংগঠনটি গড়ে ওঠে। তাদের অনেক লক্ষ্যের মধ্যে একটি হল প্রাচীন সনমহি ধর্মের প্রসার ঘটানো।
2024 সালের জানুয়ারি মাসের 25 তারিখ কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ এক্স হ্যান্ডেলে লেখেন, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর নজরদারিতে ইম্ফলের কাঙ্গালে আয়োজিত সর্বদল বৈঠকে আক্রান্ত হলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি। আমরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করি। আইনি নিয়ম-কানুন না মেনে যে সভায় বিচারের ব্যবস্থা করা হয় সেটাকেই আমরা সালিশি সভা বলে জানি। দেশের বিভিন্ন রাজ্যে এই ধরনের সভার আয়োজন করার একটাই মানে- আর তা হল অরাজকতাকে উৎসাহ দেওয়া। আইন ব্যবস্থার উপরে মানুষের মনে নিরন্তর অনাস্থা তৈরি করা।
কোথায় কোথায় ব্যর্থ রাজ্য সরকার ?
প্রাক্তন কংগ্রেস নেতা বীরেন সিং বিজেপিতে যোগ দেন 2017 সালে । 2022 সালে সহযোগীদের নিয়ে নির্বাচন জেতায় সবিশেষ পারদর্শিতা দেখিয়েছেন তিনি। একটা বড় সময়ের জন্য তাঁকে মেইতেই সম্প্রদায়ের উন্নয়নের প্রতীক হিসেবে দেখা হচ্ছিল। পাশাপাশি মণিপুর হাঁটতে শুরু করেছিল উন্নয়নের সরণিতে। বিজেপির ডবল ইঞ্জিনের সরকার উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
2023 সালের হিংসার পর থেকে পরিস্থিতি বদলে যায়। প্রধানমন্ত্রী মোদি মণিপুর সফরে যাননি। লোকসভা নির্বাচনের প্রচারেও তাঁকে মণিপুরে দেখা যায়নি । পাশের রাজ্য় মিজোরামে 2023 সালে বিধানসভা নির্বাচন হয় । সেখানেও প্রচার করতে যাননি প্রধানমন্ত্রী। অনেকেই মনে করেছিলেন কুকি সম্প্রদায়ের প্রতি মিজোরামের বেশিরভাগ মানুষের সমবেদনা আছে । আর তাই প্রধানমন্ত্রীর সভার সময় তাঁরা বিক্ষোভ দেখাতে পারেন। লোকসভা নির্বাচনে মণিপুরের পাশাপাশি নাগাল্যান্ড এবং মিজোরামেও বিজেপির ফল বেশ খারাপ হয়েছে।
বীরেন সিংকে সরাতে মোদি বাধ্য হয়েছিলেন। তাই তাঁকে সরালেন। এবার রাজ্যপাল অজয় কুমার ভাল্লাকে প্রত্যাশার চাপ সামলাতে হবে। কুকিদের এক নেতা বলেন, "শেষমেশ বীরেন সিংকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি আর ক্ষমতায় নেই । আমরা বিষয়টিকে স্বাগত জানাই। তবে প্রশাসন চালাতে তিনি যে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন তাতে আইনের আদালতে অথবা জনতার আদালতে তাঁর বিচার হওয়া উচিত।"
- 2017 সালে প্রথমবার কংগ্রেসকে হারিয়ে মণিপুরে ক্ষমতায় আসে বিজেপি । পাঁচ বছর বাদে আবারও ক্ষমতায় আসে বিজেপি ।
- 2023 সালের মণিপুরে সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পরও ক্ষমতায় থেকে গিয়েছিলেন বীরেন সিং। তাঁকে সমালোচনা শুনতে হয়েছিল। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক শ্রেণিও ডবল ইঞ্জিনের সরকারের সমালোচনায় সরব হয়েছিলেন।
- মণিপুরের দুটি আসনের একটিতে বিজেপি পরাজিত হয় । অন্য আসনে পরাজিত হয় বিজেপির সহযোগী দল এনডিপিপি। নাগাল্যান্ডেও একটি আসনে হেরে যায় এনডিপিপি।
- সামাজিক অস্থিরতার জেরে মণিপুরের সমাজের বিন্যাস নষ্ট হয়ে যায়। সমাজের এই প্রবল অস্থিরতা সমাজের বহু মানুষকে তীব্র মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছে। প্রাণও গিয়েছে বহু মানুষের।
18 জানুয়ারি গাড়ি করে ইম্ফল থেকে চূড়াচাঁদপুরে যাওয়ার সময় দেখা হয়েছিল এক নিরাপত্তা রক্ষীর সঙ্গে । তিনি জানালেন, আপনি দিল্লি থেকে আসুন আর মুম্বই থেকে আসুন দশবার তল্লাশি হবে। শুধু তাই নয়, আপনার স্ত্রী মেইতেই না কুকি সম্প্রদায়ের সেটাও জানতে চাই আমরা।
(ডিসক্লেইমার: এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব । এখানে প্রকাশিত তথ্য এবং বিশ্লেষণ ইটিভি ভারতের মতামতকে প্রতিফলিত করে না)
ছাব্বিশে গেরুয়া ভারতের স্বপ্ন হয়তো অধরাই