গত 3 থেকে 5 সেপ্টেম্বর ব্রুনেই ও সিঙ্গাপুরে দ্বিপাক্ষিক সফর করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ৷ এমন একটা সময়ে এই সফর হয়েছে, যখন বাংলাদেশ এবং মায়ানমারে সংঘাত ও গোলযোগের পরিস্থিতি তৈরি হয়ে রয়েছে এবং দক্ষিণ চিন সাগরে উত্তেজনা ছড়াচ্ছে চিনা ও ফিলিপিন্সের জাহাজের মধ্যে ঘন ঘন সংঘর্ষের জেরে ৷ এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী মোদির এই সফর ভারতের অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি বাস্তবায়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল ৷ এই সফরে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ব্রুনেই এবং সিঙ্গাপুরের সঙ্গে প্রতিরক্ষা, শক্তি, বাণিজ্য এবং বিনিয়োগের মতো খাতে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং সমর্থনকে প্রসারিত করা হয়েছে ৷ এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ককে উন্নীত করার জন্য একটি কূটনৈতিক উদ্যোগ হিসাবে বৃহত্তর ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে অ্যাক্ট ইস্ট পলিসির কৌশলগত গুরুত্বের উপর জোর দেওয়া হয়েছে ৷
ব্রুনেই সফরের ফলাফল কী
বুধবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বৈঠক করেন ব্রুনেইয়ের সুলতান হাজি হাসানাল বলকিয়ার সঙ্গে ৷ সেই আলোচনায় প্রতিরক্ষা, মহাকাশ গবেষণা, দীর্ঘমেয়াদী এলএনজি সরবরাহ এবং বাণিজ্য-সহ পারস্পরিক স্বার্থের সমস্ত ক্ষেত্রে অংশীদারিত্ব আরও জোরদার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন দু’জনেই ৷ ফলে ভারত ও ব্রুনেই বুধবার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে বর্ধিত অংশীদারিত্বের দিকে উন্নীত করেছে ৷
উভয় নেতা প্রধানত আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং সামুদ্রিক সুরক্ষার প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে একসঙ্গে কাজ করতে সম্মত হয়েছে ৷ সেই জন্য প্রতিরক্ষা সহযোগিতার সুবিধার্থে একটি জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করতে সম্মত হন দু’জনে । ভারত ও ব্রুনেই এই অঞ্চলের সামুদ্রিক নিরাপত্তা ও সুরক্ষা, নৌ-চলাচল ও ওভারফ্লাইটের স্বাধীনতা, বাধাবিহীন আইনি বাণিজ্য, আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে । বিশেষ করে সমুদ্রের আইন সংক্রান্ত রাষ্ট্রসংঘের কনভেনশন 1982-র ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ।
ব্রুনেইয়ের সঙ্গে 2018 সালের মহাকাশ চুক্তি এই অঞ্চলে চিনের বাধা সত্ত্বেও নয়াদিল্লির জন্য একটি কৃতিত্ব ছিল । এবারের বৈঠকে মহাকাশ চুক্তির আরেকটি ঘোষণা প্রত্যাশিত ছিল ৷ তবে দুই নেতা মহাকাশ সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে আলোচনা করেছেন । সেখানে মহাকাশ গবেষণা ও উপগ্রহ প্রযুক্তি নিয়ে সহযোগিতায় উভয়ের স্বার্থরক্ষার বিষয়টি রয়েছে ৷
এর আগে ব্রুনেই-ভারত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সাম্প্রতিক বছরগুলিতে 500 মিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাছাকাছি হ্রাস পেয়েছে ৷ কারণ, ভারত রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করতে শুরু করেছে৷ ব্রুনেই থেকে তেল আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে ৷ এছাড়াও ভারত বর্তমানে কাতার থেকে তার দীর্ঘমেয়াদী এলএনজি সরবরাহের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আমদানি করে । দুই দেশের নেতাদের বৈঠকের সময় ভারত ও ব্রুনেই ভারতে দীর্ঘমেয়াদী এলএনজি সরবরাহের বিষয়ে সম্মত হয়েছে । বাণিজ্য সম্পর্ক ও বাণিজ্যিক সংযোগ প্রসারিত করতে তাঁরা বিনিয়োগ খাতে সহযোগিতার জন্য নতুন উপায় খোঁজার বিষয়ে সম্মত হয়েছেন । তাঁরা খাদ্য নিরাপত্তাকে আলাদা করে গুরুত্ব দিয়েছেন এবং কৃষি ও খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খলে সহযোগিতা বাড়াতে সম্মত হয়েছেন । তাঁদের আলোচনার সময় উভয় নেতা সক্ষমতা বৃদ্ধি, যোগাযোগ, সংস্কৃতি, অর্থ, স্বাস্থ্য ও ওষুধ, প্রযুক্তি এবং পর্যটনের ক্ষেত্রে শক্তিশালী সম্পর্কের আহ্বান জানিয়েছেন ।
ব্রুনেই ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের কেন্দ্রে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বোর্নিও দ্বীপে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থিত ৷ এই দ্বীপ ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ফিলিপিন্স ও ভিয়েতনাম দ্বারা পরিবেষ্টিত ৷ সেই কারণে ব্রুনেই সফর ভারতের অ্যাক্ট ইস্ট পলিসির জন্য গুরুত্বপূর্ণ । ব্রুনেইতে ভারতের একটি নৌ স্টেশন ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যপূরণ হবে ৷ কারণ, ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চিনকে মোকাবিলা করার জন্য সেখানকার দেশগুলির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন হবে ।
সিঙ্গাপুর সফর থেকে কী ফল পাওয়া গেল
বিগত 15 বছরে ভারত ও সিঙ্গাপুরের মধ্যে সম্পর্ক বিভিন্ন ক্ষেত্রে উর্ধ্বমুখী অবস্থায় রয়েছে ৷ একটি অর্থনৈতিক সহযোগিতা চুক্তিকে আপগ্রেড করে এখন নয়াদিল্লি ও সিঙ্গাপুর তাদের 'বিস্তৃত কৌশলগত অংশীদারিত্ব' বৃদ্ধির কাজ করছে ৷ এই চুক্তি ভারতে সিঙ্গাপুরে রফতানির 81 শতাংশের উপর শুল্ক অপসারণ করেছে ৷ এখন দুই দেশ ডিজিটাল প্রযুক্তি, সেমিকন্ডাক্টর, স্বাস্থ্য সহযোগিতা ও শিক্ষাগত সহযোগিতা এবং দক্ষতা উন্নয়নের ক্ষেত্রে 4টি মূল মউ স্বাক্ষর করেছে । এছাড়াও, উভয় নেতাই উন্নত উৎপাদন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, যোগাযোগ, সাইবার-নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা, শিক্ষা, ফিনটেক, গ্রিন করিডোর প্রকল্প, জ্ঞানের অংশীদারিত্ব, মেরিটাইম ডোমেন সচেতনতা, নতুন প্রযুক্তি ডোমেন, জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং স্থায়িত্ব সংক্রান্ত বিদ্যমান ক্ষেত্রগুলির ব্যাপক মূল্যায়ন করেছেন ।
সহযোগিতার একটি নতুন দিকের অংশ হিসাবে দুই দেশ সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তি ও স্বাস্থ্য খাতে নিজেদের মধ্য়ে যোগাযোগ বৃদ্ধি করেছে । যেহেতু সিঙ্গাপুর বিশ্বব্যাপী সেমিকন্ডাক্টর সাপ্লাই চেইনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, বিশ্বব্যাপী উৎপাদিত সমস্ত চিপের 10 শতাংশ এবং সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদন সরঞ্জামের বৈশ্বিক উৎপাদনের প্রায় 20 শতাংশ সরবরাহ করে ৷ সেমিকন্ডাক্টর ইকোসিস্টেম অংশীদারিত্বের উপর যে মউ সাক্ষরিত হয়েছে,তা ভারতের সেমিকন্ডাক্টর বাজার সম্প্রসারণের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে । যা ভারতে 2026 সালের মধ্যে 63 বিলিয়ন মার্কিন ডলার হবে বলে আশা করা হচ্ছে । এটি ভারতে সিঙ্গাপুরের বিনিয়োগকেও সহজ করবে এবং টাটা গ্রুপ ও সিজি পাওয়ার-সহ ফার্মগুলির দ্বারা 15 বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের তিনটি সেমিকন্ডাক্টর প্ল্যান্ট নির্মাণের মাধ্যমে ভবিষ্যতে তাইওয়ানের মতো দেশগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার জায়গায় পৌঁছানো যাবে ৷