2019 সালে অবলুপ্ত করা হয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ 370 ৷ পাঁচ বছরের শিথিলতার পর কাশ্মীর সাক্ষী হচ্ছে এক নতুন পরিস্থিতির ৷ যেখানে ভোটে অংশগ্রহণ, সে ভোটদানই হোক কিংবা প্রার্থী হওয়া, কোনোটাকেই প্রাণহানির আশঙ্কার কারণ হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে না ৷ আগে এই উভয় কাজই উপত্যকায় আগে নিষিদ্ধ ছিল এবং বিশ্বাসঘাতকতার কাজ হিসাবে বিবেচিত হতো । 2024 সালের লোকসভা নির্বাচনে ভোটদানের হারে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছিল ৷ তার আগে গত তিন দশক ধরে ভোটারদের উপস্থিতি অত্যন্ত কম ছিল । সংসদীয় নির্বাচনের এই সাফল্যের পর বিধানসভা নির্বাচনে আত্মবিশ্বাসী রাজনৈতিক প্রচার দেখা গিয়েছে ৷ যার মধ্যে রয়েছে বাড়ি বাড়ি প্রচার, রোড শো ৷ তাছাড়া উপত্যকায় ফিরে এসেছে সমাবেশও ।
নির্বাচনী ব্যবস্থা
কাশ্মীরে একটি সময় ছিল যখন বিপদের আশঙ্কা করে কর্মীরা তাঁদের নাম নির্বাচনী দায়িত্ব এড়াতে নিজেদের রাজনৈতিক এবং আমলাতান্ত্রিক যোগাযোগ ব্যবহার করতেন, যাতে ভোটের দায়িত্ব সংক্রান্ত তালিকায় নাম না থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করা যায় ৷ তাঁদের ভয় ভিত্তিহীন ছিল না৷ কারণ, অনেক মানুষ দায়িত্ব পালনে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ৷ নিহতরা কেউই ভোটে লড়ছিলেন না বা নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন না ৷ তবে বিভিন্ন বিভাগের কর্মচারীরা তাঁদের নিয়মিত পরিষেবার অংশ হিসাবে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব পেতেন ।
অতীতের নির্বাচনী সমীকরণ
প্রতিদ্বন্দ্বিতার অভাবের কারণে আঞ্চলিক দলগুলো সবসময়ই নির্বাচনী রাজনীতিতে সুবিধা পেত । প্রাক্তন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের থেকে প্রতিশোধের ভয়ে ভোটাররা ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকতেন । ন্যাশনাল কনফারেন্স (এনসি) ও জম্মু কাশ্মীর পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি)-এর মতো দলগুলির জন্য মাঠ উন্মুক্ত রেখে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী ও তাদের সহযোগীরা ভোট বয়কটের ডাক দিত৷ যাই হোক, বড় শক্তি হিসেবে পরিচিত এনসি ও পিডিপি, যারা উল্লেখযোগ্য জনসমর্থন নিয়ে গর্ব করেন, পরিস্থিতি এবার তাদের বিরুদ্ধে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে । এছাড়াও, যেহেতু আরও বেশি লোক বেরিয়ে আসতে ও ভোট দিতে আত্মবিশ্বাসী বোধ করছেন, তাই পরিস্থিতি আবদুল্লা ও মুফতিদের পছন্দের বিরুদ্ধে যেতে পারে, অন্যথায় তারা নিজেদের দুর্গে প্রায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হবেন ।
'কাশ্মীরের ধারণা'
ন্যাশনাল কনফারেন্স, পিপলস কনফারেন্স (পিসি) এবং পিডিপি-র মতো ঐতিহ্যবাহী দলগুলি একে অপরের সঙ্গে বা কিছু নির্দল, যারা আগে বয়কট শিবিরের প্রতিনিধিত্ব করেছিল, তাদের সঙ্গে বিরোধী অবস্থানে রয়েছে ৷ মূল প্রার্থীদের মধ্যে একজন শেখ রশিদ, যিনি স্থানীয়ভাবে ইঞ্জিনিয়র রশিদ নামে পরিচিত, তিনি এই বছরের শুরুতে উত্তর কাশ্মীরের বারামুল্লা লোকসভা আসনে ওমর আবদুল্লা ও সাজাদ লোনকে হারিয়েছেন ৷
মঙ্গলবার কিশতওয়ারে বুথের উদ্দেশে রওনা দিচ্ছেন ভোটকর্মী ও নিরাপত্তাকর্মীরা৷ (পিটিআই) এখন যেহেতু তিনি অন্তর্বর্তীকালীন জামিনে তিহাড় জেল থেকে মুক্তি পেয়েছেন, তাই রশিদ নিষিদ্ধ জামায়েত-ই-ইসলামী সমর্থিত প্রার্থীদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে বিধানসভা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন । লোকসভা নির্বাচনে রশিদের জয় নিঃসন্দেহে আবদুল্লা, লোন ও মুফতিদের চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল । সম্ভবত, ভোটারদের আনুগত্যকে দলগুলি ছোট করে দেখেছিল ৷ তারা মনে করেছিল ভোটাররা তাদের সঙ্গেই রয়েছে, 'কাশ্মীরের ধারণা'র সঙ্গে নেই ৷ ইঞ্জিনিয়র 'কাশ্মীরের ধারণা' তৈরি করছেন এবং এখন পর্যন্ত সেই কাঙ্ক্ষিত মাইলফলক অর্জনে সফল হয়েছেন, যা তিনি নির্বাচনী রাজনীতির মাধ্যমে অর্জন করতে চেয়েছিলেন ।
ইঞ্জিনিয়র রশিদ
আবদুল্লা, মুফতি ও লোন সকলেই পূর্বে বিজেপির সঙ্গে জোট করেছেন ৷ সেই কারণে তাঁরা মানুষের কাছে দ্বিতীয় পছন্দ হয়ে গিয়েছেন ৷ মানুষের প্রথম পছন্দ হয়ে গিয়েছে জামায়েত বা ইঞ্জিনিয়র সমর্থিত নির্দল প্রার্থীরা ৷ জম্মুর বিপরীতে, কাশ্মীরের লোকেরা বিশেষ করে যাঁরা বিশ্বাস করেন যে নির্বাচনে বাস্তবে পরিবর্তন আনার একটি সম্ভাব্য হাতিয়ার, তাঁরা এমন প্রার্থীদের সন্ধান করছেন, যাঁরা 'কাশ্মীরের ধারণা'-র সঙ্গে নিজেদের মিলিয়ে নিতে পেরেছেন । রশিদ এর জন্য উপযুক্ত ৷ কারণ, তিনি ঐতিহাসিকভাবে এই নিয়ে সরব, জেলে গিয়েছেন ও শিক্ষিত, পড়তে ও লিখতে পারেন । একই সঙ্গে কাশ্মীরের মানুষের মধ্যে সংশয় ছড়িয়ে রয়েছে ৷ কারণ, অনেকেই রশিদের মতো ব্যক্তিদেরকে বিজেপির এজেন্ট হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং টার্গেট করেন ।
মঙ্গলবার কিশতওয়ারে বুথের উদ্দেশে রওনা দিচ্ছেন ভোটকর্মী ও নিরাপত্তাকর্মীরা৷ (পিটিআই) বিজেপি কাশ্মীরের অনেক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে না ৷ কারণ, তারা সম্ভবত ছায়াযুদ্ধের মাধ্যমে খেলছে ৷ এর কারণ, তারা জানে যে আঞ্চলিক দলগুলির মধ্যে ভোট সম্ভবত ভাগ হয়ে যাবে এবং এর ফলে নতুন প্রার্থীদের জন্য পথ তৈরি হতে পারে, যারা পরে বিজেপির সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক ঘোষণা করতে পারে । এমনটাই অভিযোগ ফারুক আবদুল্লার মতো রাজনীতিবিদদের ।
উত্তরাধিকারের জন্য লড়াই
দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের অনেক রাজনীতিবিদদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার হুমকির মুখে । নিজেদের কেরিয়ার বাঁচাতে, লোন এবং আব্দুল্লারা দু’টি করে আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন । পিসি এবং এনসি-র অন্য দুই উত্তরাধিকারী নেতাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার অভিপ্রায়ে মেহবুবা নিজেকে নির্বাচন থেকে দূরে রেখেছেন এবং তাঁর মেয়ে ইলতিজা মুফতিকে তাঁর নিজের এলাকা বিজবেহারা থেকে প্রার্থী করেছেন ৷ ইলতিজাকে নির্বাচনী ময়দানে নামানোর এটাই সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা বলে তিনি মনে করেছেন ৷ বিজবেহারা তাঁর নিজ নির্বাচনী এলাকা, যেখান থেকে তাঁর বাবা মুফতি সঈদ একবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হয়েছিলেন । সেখানেই সঈদকে কবর দেওয়া হয় । শ্রীনগর জম্মু জাতীয় সড়কের মুখোমুখি মুফতির কবর জুনিয়র মুফতিকে কিছু সমর্থন জোগাড় করতেও সাহায্য করতে পারে, যা তাঁর ভোটের ভিত্তিতে পরিণত হতে পারে ।
মঙ্গলবার কিশতওয়ারে বুথের উদ্দেশে রওনা দিচ্ছেন ভোটকর্মী ও নিরাপত্তাকর্মীরা৷ (পিটিআই) মুফতিদের একেবারে বিপরীতে, ওমর আবদুল্লার সোনওয়ার (শ্রীনগরে), যেখানে তিনি থাকেন, সেই এলাকা তাঁর নির্বাচনী এলাকা হিসেবে যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি । বর্তমান পরিস্থিতিতে এই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেছেন তিনি ৷ ওমর গান্ডেরওয়ালের সঙ্গে ভোটে লড়ার জন্য দ্বিতীয় আসন হিসেবে বুডগামকেও বেছে নিয়েছেন৷ কারণ, তিনি বিশ্বাস করেন যে শ্রীনগরের সাংসদ আগা রুহুল্লাহ তাঁকে বুডগামে জিততে সাহায্য করবেন নিজের ভোটব্যাংকের মাধ্যমে ৷
মঙ্গলবার কিশতওয়ারে বুথের উদ্দেশে রওনা দিচ্ছেন ভোটকর্মী ও নিরাপত্তাকর্মীরা৷ (পিটিআই) দুই দশক পর গান্ডেরওয়াল থেকে লড়ছেন ওমর আবদুল্লা । 2002 সালে তিনি সেই সময় অপরিচিত মুখ পিডিপি-র কাজি আফজালের কাছে পরাজিত হন ৷ সমস্ত উত্তরাধিকারী দল তাদের অস্তিত্ব ধরে রাখতে ও টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করছে এটা জেনে যে ভোট ভাগ হয়ে যাবে এবং তারা একটি জোট সরকার গঠন করবে । বিষয়গুলি কীভাবে এগোয় এবং কোন শক্তি শেষ পর্যন্ত জয়ী হয় এবং তার পর তারা কী পদক্ষেপ করে, তা অত্যন্ত আকর্ষণীয় হবে । অনিবার্যভাবে, ভোটারদের অংশগ্রহণ ইঞ্জিনিয়র রশিদ এবং যাঁরা তাঁকে সমর্থন করেন, তাঁদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে ৷ কারণ, কম ভোটারের উপস্থিতি সম্ভবত পুরনো প্রহরীদের উপকার করতে পারে ।