বিদেশনীতি প্রায়ই জাতীয় নির্বাচনের প্রচারে পিছনের সারিতে থেকে যায় ৷ পরিবর্তে অর্থনীতি, স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং অভিবাসনের মতো অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলি আলোচনায় প্রাধান্য পায় । তবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশনীতি সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলি অভ্যন্তরীণ গতিশীলতার উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে, যা জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনীতির উপর ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করে । কমলা হ্যারিস ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কোনও ব্যতিক্রম নয় ৷ কারণ, বিদেশনীতি ভোটারদের মনোভাবকে প্রভাবিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ।
দুই প্রার্থীর মধ্যে সাম্প্রতিক যে বিতর্ক অনুষ্ঠানটি হয়েছে, সেখানে বিদেশনীতির বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রকে তুলে ধরা হয়েছিল ৷ যা নিয়ে পরবর্তী প্রশাসন এগিয়ে যেতে পারে ৷ রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বন্দ্ব থেকে মার্কিন-চিন সম্পর্ক পর্যন্ত, বর্তমান অস্থির বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কোন পথে চালিত হওয়া উচিত, তা নিয়ে দুই প্রার্থী ভিন্ন মতামত প্রকাশ করেছেন । যেহেতু বিশ্বের নেতৃত্ব স্থানীয় হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে, তাই পরবর্তী প্রশাসনের বিদেশনীতি আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব ও বিশ্বমঞ্চে আমেরিকার অবস্থানের জন্য সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে ।
ঐতিহাসিকভাবে, মার্কিন বিদেশনীতি বিশ্বব্যাপী আধিপত্য বজায় রাখার উপর কেন্দ্রীভূত হয়েছে । এটি প্রায়শই একতরফা পদক্ষেপ ও সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে অনুসরণ করা হয়েছে । তবে, বিশ্বের পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত বদলাতে থাকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরও বহুপাক্ষিক পন্থা অবলম্বন করতে বাধ্য হয়েছে ৷ আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করে বৈশ্বিক সমস্যাগুলির সমাধান করতেও বাধ্য হয়েছে তারা । সারা বিশ্ব এখন অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে ৷ সেগুলি হল - ইউক্রেনের যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি, সাইবার যুদ্ধের উত্থান এবং বৈশ্বিক নিরাপত্তায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্রমবর্ধমান প্রভাব ।
এই প্রেক্ষাপটে, পরবর্তী মার্কিন প্রশাসনের বিদেশনীতি এই দ্বন্দ্বগুলির গতিপথ নির্ধারণে এবং নেতৃত্বের ভূমিকা বজায় রাখার জন্য আমেরিকার সক্ষমতা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ হবে । সমালোচকদের যুক্তি হল যে মার্কিন বিদেশনীতি প্রায়শই নিজেদের কথা ভাবে, সর্বোপরী মার্কিন স্বার্থ সংরক্ষণের উপর বেশি নজর দেয় । তবে, বিশ্বায়ন ক্রমবর্ধমান সুরক্ষাবাদের দ্বারা পিছিয়ে যাচ্ছে এবং আধুনিক যুদ্ধের জটিলতাগুলি বিকশিত হচ্ছে, এর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই এই চ্যালেঞ্জগুলিকে সতর্কতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে এবং দেখতে হবে যাতে বিশ্বব্যাপী উত্তেজনা বৃদ্ধি না হয় ।
মূল বিতর্ক
হ্যারিস-ট্রাম্প বিতর্কের সময় বিদেশনীতি সংক্রান্ত যে বিষয়গুলি তুলে ধরা হয়, তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার ৷ এটা একটি বিতর্কিত বিষয় ৷ যা নিয়ে মানুষের মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে ৷ এর ফলে সারা বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতা ও ভবিষ্যতের নিরাপত্তার ঝুঁকির সমস্যা নিরসনে যে প্রশ্ন উঠেছে, তার প্রেক্ষিতে উভয় প্রার্থীকেই সেনা প্রত্যাহারের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবের বিষয়টিকে মোকাবিলা করতে হয়েছে ৷ কমলা হ্যারিস এখন চলতে থাকা দ্বন্দ্বগুলি মোকাবিলা করার জন্য একটি পরিমাপক, কৌশলগত পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছেন ৷ অন্যদিকে ট্রাম্প বিদেশনীতির অর্থনৈতিক দিকগুলির উপর জোর দিয়েছেন ৷ বিশেষ করে বাণিজ্যের অর্থনৈতিক দিকগুলির কথা তুলে ধরেছেন ৷
ট্রাম্পের বিদেশনীতির অ্যাজেন্ডা অর্থনৈতিক বিষয়গুলি দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত । এর আগেরবার প্রেসিডেন্ট থাকার সময় ট্রাম্প বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে নতুন করে আলোচনা করার উপর জোর দিয়েছিলেন । বিশেষ করে চিনের সঙ্গে তিনি জোর দিয়েছিলেন উল্লেখযোগ্যভাবে ৷ তিনি যদি ফের প্রেসিডেন্ট হন, তাহলে শুল্কের বিষয়ে তাঁর অবস্থান মার্কিন বিদেশনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা হচ্ছে ৷ ট্রাম্প চিনা আমদানির উপর 30 শতাংশ শুল্ক আরোপের পরামর্শ দিয়েছেন ৷ এটা এমন একটি পদক্ষেপ, যা সম্ভবত বাণিজ্যে উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলবে এবং সম্ভাব্যভাবে চিন থেকে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে । এটা মার্কিন অর্থনীতির জন্য উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটাবে ৷ সেই সঙ্গে ভারতের মতো দেশগুলির জন্যও পরিস্থিতির বদল হবে, যাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে ৷ যেকোনও বড় শুল্ক ভারতের জন্য রাজস্ব ক্ষতির কারণ হতে পারে এবং দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ককে চাপে ফেলতে পারে ।
অন্যদিকে, হ্যারিস বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আরও ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছেন ৷ জোট গঠন ও অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব জোরদার করার দিকে জোর দিয়েছেন । যদিও তিনি অর্থনৈতিক পরিকল্পনার বিস্তারিত রূপরেখা দেননি ৷ তাঁর প্রশাসন সম্ভবত ট্রাম্পের পক্ষ থেকে সুরক্ষাবাদী নীতিগুলি এড়াতে আরও বহুপাক্ষিক পদ্ধতি গ্রহণ করবে । এটা আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে আরও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক তৈরি করতে পারে ৷ বিশেষ করে এশিয়ায় এটা বেশি দেখা যেতে পারে ৷ কারণ, এখানে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা প্রধান অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে । এই বিষয়টি চিনের বিপক্ষে কীভাবে ব্যবহার করা হবে, সেটাই দেখার বিষয় ।
মধ্য প্রাচ্য