দুবাইতে ভারতের বিদেশসচিব বিক্রম মিস্রী ও আফগানিস্তানের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী মৌলবী আমির খান মুত্তাকির মধ্যে সাম্প্রতিক বৈঠক দক্ষিণ এশিয়ার পরিবর্তিত পরিস্থিতির সর্বশেষ উদাহরণ । গত বছরের অগস্টে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকে এই দৃশ্যপট বদলে যেতে শুরু করে । তারপর থেকে বাংলাদেশ ভারতকে চাল ও অব্যাহত সহায়তার জন্য অনুরোধ করলেও, তারা পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকে পড়তে শুরু করে ।
পাকিস্তান থেকে গোলাবারুদ ও খাদ্যশস্য আমদানি এবং পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইশাক দারের আসন্ন বাংলাদেশ সফর এই অঞ্চলের পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির ইঙ্গিত দেয় । ইশাক দার উল্লেখ করেছেন যে বাংলাদেশ পাকিস্তানের 'হারানো ভাই' । বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতা মোহাম্মদ ইউনুস ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের মধ্যে ধারাবাহিক বৈঠকে উভয়েই সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছেন । তার প্রেক্ষাপটেই পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করতে চলেছেন ৷
বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুসের সঙ্গে ভারতের বিদেশসচিব বিক্রম মিস্রী ৷ গত 10 ডিসেম্বর ঢাকায়৷ (এএনআই) সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য ইউনুসের নিয়মিত দাবি নয়াদিল্লির জন্য একটি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে । ভারত ইউনুসের এই দাবি উপেক্ষা করেও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক পুনর্নির্মাণের আশায় ঢাকায় যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে ।
পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলেও খবর পাওয়া গিয়েছে । তথ্য অনুযায়ী, ভারতের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হিসেবে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে স্বল্প-পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র আবদালি ও তুরস্ক থেকে ট্যাঙ্ক কেনার কথা বিবেচনা করছে ।
এছাড়াও, এই বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করবে । এই প্রশিক্ষণ বাংলাদেশের চারটি সেনানিবাসে পরিচালিত হবে । নেতৃত্বে থাকবেন পাকিস্তানি সেনার একজন মেজর জেনারেল পদমর্যাদার আধিকারিক ।
যদিও পাকিস্তানি সেনাদের বাংলাদেশে প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিষয়টি ভারতের জন্য বড় উদ্বেগের নয় ৷ উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো বিষয় হল বাংলাদেশে মৌলবাদের ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়া । পাকিস্তান এই বিষয়টিতে ইন্ধন দিতে পারে ৷ এজেন্ডায় ভারত-বিরোধিতাও যুক্ত হতে পারে ৷ এর ফলে ভারত-বাংলাদেশ সামরিক সম্পর্ক অপ্রত্যাশিত মোড় নিতে পারে ৷ ভারত ছাড়া বাংলাদেশের আর কোনও হুমকি নেই । পাকিস্তান বাংলাদেশে প্রবেশ করলেও চিনও শীঘ্রই সেখানে আসবে । সেটা আরও উদ্বেগের বিষয় হবে ।
রাষ্ট্রসঙ্ঘের সদর দফতরে চিনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই-এর সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুস৷ 2024-এর 26 সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে৷ (এএনআই) তাছাড়া, পাকিস্তানের আইএসআই-এর জন্য ভারত-বিরোধী জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য নতুন শিবির তৈরির পথ খুলে যাবে । তারা আগে থেকেই এই কাজ করে আসছে ৷ কাশ্মীরি জঙ্গিদের ভারতে পাঠানোর জন্য বাংলাদেশও একটি পথ হয়ে উঠতে পারে । তবে এই ধরনের কাজ ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে বলে অসমর্থিত সূত্রে খবর পাওয়া যাচ্ছে ৷
ভারতের বিদেশসচিব ও আফগানিস্তানের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে বৈঠকটি ইসলামাবাদের কাছে একটি সতর্কবার্তা পাঠানোর একটি উপায় ছিল ৷ এর মাধ্যমে ভারত কার্যত বোঝাতে চেয়েছে যদি বাংলাদেশ ভারতকে প্ররোচিত করার সিদ্ধান্ত নেয়, তবে তার ফলাফল কী হতে পারে । বর্তমানে, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক ভালো নয় ৷ যদিও আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সময় পাকিস্তান তালিবানকে সমর্থন করেছিল ।
রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুস। 2024-এর 26 সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে৷ (এএনআই) আফগানিস্তানে ঘাঁটি তৈরি করে থাকা টিটিপি (তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান) ও বালুচ মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আক্রমণের ঝাঁঝ বাড়িয়েছে ৷ এর ফলে পাক সেনাবাহিনী বিপদের মুখে পড়ে যাচ্ছে ৷ হতাশায় পাকিস্তান আফগানিস্তানে টিটিপির একটি আস্তানায় বিমান হামলা চালায় । এর ফলে প্রায় 50 জন নিহত হয়, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু ৷ তাঁরা মূলত পাকিস্তান থেকে ফিরে আসা শরণার্থী । এর পর কাবুল থেকে পালটা হামলা চালানো হয় ৷
বিমান হামলা নিয়ে পাকিস্তানের দাবি ছিল যে তারা নিজেদের নাগরিকদের রক্ষা করার জন্যই এটা করেছে ৷ কিন্তু ভারত আফগানিস্তানের পাশে থাকার বার্তা দেয় ও বিমান হামলার সমালোচনা করে৷ ভারতের বিদেশমন্ত্রক এই নিয়ে বিবৃতি দেয় ৷ সেখানে বলা হয়, ‘আমরা দ্ব্যর্থহীনভাবে নিন্দা জানাই । পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যর্থতার জন্য প্রতিবেশীদের দোষারোপ করা একটি পুরনো অভ্যাস ।’ ভারতই একমাত্র দেশ, যারা এই হামলার বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছে ৷
দুবাইয়ে বৈঠকের ঠিক আগে সংহতির এই প্রদর্শন তাৎপর্যপূর্ণ ছিল । এতে প্রমাণিত হয়েছে যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভারত আফগানিস্তানকে সমর্থন করছে । আফগানিস্তানে ভারতের একটি দুর্দান্ত অবস্থান রয়েছে । সাহায্য ও সমর্থনের জন্য ভারতকে তারা সম্মান করে ৷ ব্যাঙ্গাত্মক হলেও সত্যি, আফগানিস্তানে এখন সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করা হয় পাকিস্তান ও আইসিস-কে৷ রাওয়ালপিন্ডি আইসিস-কে সমর্থন করে, তাই তাদের না-পসন্দ আফগানিস্তানের । ভারত এই সদিচ্ছার উপর ভিত্তি করেই তার সাম্প্রতিক পদক্ষেপ করছে ৷
দুবাইয়ের বৈঠকে মানবিক সাহায্য ও উন্নয়নমূলক প্রকল্প নিয়ে আলোচনা হয়েছে ৷ এছাড়া কথা হয় চাবাহার বন্দরের শোষণের বিষয়টি নিয়েও ৷ কারণ, পাকিস্তান অর্থনৈতিক চাপ, স্বাস্থ্য সহায়তা ও ক্রিকেট সহযোগিতার অংশ হিসেবে করাচির ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছে । বিশ্বব্যাপী চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতি সত্ত্বেও আফগানিস্তানের প্রতি ভারতের সমর্থন ও অঙ্গীকার বজায় রাখার জন্য আফগানরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে ।
ভারতে আফগান দূতাবাস বন্ধ রয়েছে ৷ অন্যদিকে কাবুলে ভারতীয় দূতাবাসে কেবলমাত্র সাধারণ কর্মীদের সাহায্য তদারকি করার জন্য কাজ করা হচ্ছে । ভারত এখনও তালিবান শাসনকে স্বীকৃতি দেয়নি ।
পাকিস্তান ভারতের পদক্ষেপের সমালোচনা করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে । কারণ, কাবুলে ভারতীয় উপস্থিতি বৃদ্ধির অর্থ হল ভারত আফগানিস্তানের সমস্ত কনস্যুলেট বন্ধ থাকা সত্ত্বেও ওই দেশের ভূখণ্ড থেকে পাকিস্তানের মাটিতে আক্রমণ আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে ।
আফগানিস্তানে পাকিস্তানের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত মনসুর আহমেদ খান উল্লেখ করেছেন, ‘যখনই পাক-আফগান সম্পর্কের মধ্যে মতপার্থক্য ও উত্তেজনা দেখা দেবে, তখনই ভারত তার নিজের অবস্থান মজবুত করার এবং পাকিস্তানের সঙ্গে আফগানিস্তানের ভ্রাতৃপ্রতিম প্রতিবেশী সম্পর্ককে বাধা তৈরি করার সুযোগ খুঁজে পাবে ।’ তিনি আরও যোগ করেছেন যে এগিয়ে যাওয়ার একমাত্র উপায় হল ‘আমাদের পারস্পরিক উদ্বেগের সমাধানের জন্য আফগানিস্তানের সঙ্গে জড়িত থাকার উপায় খুঁজে বের করার’ উপর মনোনিবেশ করা ।
এখনও পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরোক্ষভাবে আফগানিস্তানে টাকা দিয়ে আসছিল । গত বছরের মে মাসে মার্কিন বিদেশ বিষয়ক কমিটির এক বিবৃতিতে চেয়ারম্যান মাইকেল ম্যাককলের উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে ৷ ওই উদ্ধৃতিতে ম্যাককল উল্লেখ করেন, ‘2021 সালের অগস্টে আফগানিস্তান থেকে বাইডেন প্রশাসনের বিপর্যয়কর সেনা প্রত্যাহারের পর তালিবানদের দখলে চলে যায় ওই দেশ ৷ ফলে সেখানে মানবিক সংকট তৈরি হয় ৷ সেই সংকট মোকাবিলা করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র 2.8 বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি টাকা খরচ করেছে ।’
সেখানে আরও বলা হয়েছে, ‘তালিবানদের উপকারের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনও তহবিল গ্রহণযোগ্য নয় । মার্কিন করদাতাদের ডলার তালিবানের কাছে যাওয়া রোধে বাইডেন প্রশাসনকে অবিলম্বে পদক্ষেপ করতে হবে ।’
তালিবানরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে কোনও সাহায্য পাওয়ার কথা অস্বীকার করেছে । তাদের মুখপাত্র উল্লেখ করেছেন, ‘বাস্তবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসলামিক আমিরশাহীকে এক পয়সাও দেয়নি । বরং, তারা কোটি কোটি ডলার বাজেয়াপ্ত করে রেখে দিয়েছে, যা ন্যায্যভাবে আফগানিস্তানের জনগণের ।’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্দরে ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে তিনি আফগানিস্তানে এই ধরনের সমস্ত সাহায্য বন্ধ করে দেবেন ৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেকেই বিশ্বাস করেন যে এই সাহায্য আফগানিস্তানে বেড়ে ওঠা অন্যান্য জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে অর্থের যোগান দিচ্ছে ৷
সত্য হোক বা না হোক, পরিসংখ্যান যাই হোক না কেন, এখন ভারতই আফগানিস্তানকে সমর্থন করার জন্য এগিয়ে আসবে । যদিও ভারতের সাহায্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করার লক্ষ্যে নয়, তবে এটা পাকিস্তানের জন্য একটি সতর্কবার্তা হিসেবে কাজে লাগানো হবে ।
সাম্প্রতিক বৈঠক ও আফগানিস্তানে ভবিষ্যতের সাহায্য একটি নীরব বার্তা ৷ তা হল - পাকিস্তান যদি বাংলাদেশকে ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে, তাহলে ভারতও কাবুলকে ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে টিটিপি এবং বালুচদের আরও কাজে লাগানোর জন্য চাপ দেবে ৷ এর ফলে পাকিস্তানের জন্য পরিস্থিতি কঠিন করে তুলতে পারে । ভৌগোলিক নৈকট্যের প্রেক্ষিতে ভারত এখনও বাংলাদেশকে সামলাতে ও এই দেশের সঙ্গে জড়িত হতে পারে ৷ তবে পাকিস্তান আফগানিস্তানের কাছ থেকে ক্রমবর্ধমান চাপের মুখোমুখি হবে ।
(এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব । এখানে প্রকাশিত তথ্য এবং মতামত ইটিভি ভারত-এর মতামতকে প্রতিফলিত করে না ৷)