ETV Bharat / opinion

বৃদ্ধ ও ডায়াবেটিকদের ক্ষেত্রে ক্যানসার কীভাবে খারাপ হয়, আইআইএসসি-র গবেষণায় নতুন দিশা - CANCER RESEARCH IN IISC

বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স (আইআইএসসি)-এর গবেষকরা এই কাজ করেছেন ৷ এই নিয়ে লিখেছেন ইটিভি-এর সিনিয়র সাংবাদিক ড. অনুভা জৈন ৷

CANCER RESEARCH IN IISC
বৃদ্ধ ও ডায়াবেটিকদের ক্ষেত্রে ক্যানসার কীভাবে খারাপ হয়, আইআইএসসি-র গবেষণায় নতুন দিশা (প্রতীকী ছবি)
author img

By ETV Bharat Bangla Team

Published : Jan 11, 2025, 6:01 AM IST

ডায়াবেটিস ও বার্ধক্যের মতো পরিস্থিতিতে মেটাবলিক ডিসঅর্ডার (বিপাকীয় ব্যাধি বা খাদ্য বিপাকে সমস্যা) দেখা যায় ৷ এই পরিস্থিতি ক্যানসারের সম্ভাবনাকে ত্বরান্বিত করে । বার্ধক্যজনিত রোগ বা ডায়াবেটিসের সমস্যা যাঁদের আছে, তাঁরা যদি ক্যানসারে আক্রান্ত হন, তাহলে ফলাফল আরও খারাপ হয় ৷ ক্যানসার কোষ বায়োলজি ও মাইক্রোফ্লুইডিক্সে নিজেদের দক্ষতা ব্যবহার করে বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স (আইআইএসসি)-এর গবেষকরা একটি অভিনব ডুয়াল অর্গান-অন-চিপ তৈরি করেছেন ৷ এটি একটি মাইক্রোফ্লুইডিক কালচার প্ল্যাটফর্ম, যা রক্তনালীর কাছে থাকা টিউমারকে পুনর্গঠন করে মাইক্রোস্কোপিক পর্যবেক্ষণের জন্য উপযুক্ত করতে পারে ।

আইআইএসসি-র বিজ্ঞানীদের দলের এই অভিনব গবেষণার বিষয়ে ‘স্মল’ নামে একটি জার্নালে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে ৷ বিজ্ঞানীদের দলের নেতৃত্বে ছিলেন ডেভেলপমেন্টাল বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক রামরায় ভাট, সেন্টার ফর ন্যানো সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিইএনএসই)-এর অধ্যাপক প্রসেনজিৎ সেন এবং তাঁদের ছাত্র নীলেশ কুমার । চিপ ব্যবহার করে এই বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন যে মিথাইলগ্লায়ক্সাল (এমজি)-এর সংস্পর্শে রক্তনালিতে ক্যানসার কোষের প্রবেশ ত্বরান্বিত হয় । এই ধরনের উদ্ভাবনী ও আন্তঃবিষয়ক গবেষণা ক্যানসার গবেষণায় নতুন দরজা খুলে দেবে ৷

Cancer Research in IISc
বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স (আইআইএসসি)-এর গবেষকদের দল৷ (আইআইএসসি-র অধ্যাপক রামরায় ভাট)

পশ্চিম বিশ্বে একই ধরনের 'লাং-অন-চিপ' মডেল রয়েছে ৷ এই মডেল তৈরি করা হয় মানুষের ফুসফুসের উপর ধূমপানের প্রভাব নিয়ে গবেষণা ও আন্তঃবিষয়ক গবেষণার মাধ্যমের স্বাস্থ্যের উন্নতির দিশা দেখাতে ৷ সেই থেকেই এই বিজ্ঞানীদের মনে এই ধরনের চিপ তৈরির ভাবনা আসে ৷ 2020 সালে বিজ্ঞানীদের মনে এই ভাবনা আসে ৷ তার পর পাঁচবছর কেটে যায় তাঁদের লক্ষ্যপূরণে ৷ ভারতে এই ধরনের চিপ তৈরির প্রযুক্তি মেলে না সাধারণত ৷ সেই কারণে গবেষণার কাজ বিলম্বিত হয় ।

এই অর্গান-অন-চিপ (ওওসি) রোগীদের কোষগুলিকে মাইক্রোস্কোপের নীচে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করবে ৷ আর জানতে সাহায্য করবে যে কীভাবে এবং কেন একটি রোগের ফলাফল এবং এর ব্যবস্থাপনা ব্যক্তি বিশেষে আলাদা হয় । এটাকে 'প্রিসিশন থেরাপি' বলা হয়, যেখানে চিপগুলি ডায়াবেটিসযুক্ত পরিবেশ এবং ডায়াবেটিসবিহীন পরিবেশে বা তরুণ পরিবেশের তুলনায় একটি বয়স্ক টিস্যু পরিবেশের তুলনামূলক ক্ষেত্রে ক্যানসার ছড়িয়ে পড়ার প্রতিলিপি তৈরি ৷

নীলেশ কুমার জানিয়েছেন, জৈবিক গবেষণায় ওওসি একটি কার্যকর বিকল্প তৈরি করেছে ৷ যেকোনও গবেষণায় কোনও প্রাণীকে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে যে নৈতিক উদ্বেগ থেকে যায়, এর ফলে তা দূর হয়েছে ৷ এছাড়া এই প্রযুক্তি মাইক্রোফ্লুইডিক্স ও মানব কোষের ছেদ ব্যবহার করে মানবদেহের জৈবিক অবস্থার অনুকরণ করে ৷ প্রচলিত পদ্ধতিতে যে ফলাফল পাওয়া যায়, এক্ষেত্রে তার তুলনায় আরও সুনির্দিষ্ট ফলাফল মেলে । মাইক্রোফ্লুইডিক্স প্ল্যাটফর্মটি বেশ কিছু সুবিধা প্রদান করে ৷ এর মধ্যে অন্যতম হল টিস্যু আর্কিটেকচারের সমান্তরালকরণের মাধ্যমে মানবদেহের রিয়েল-টাইম সিমুলেশন তৈরি করা ।

ইটিভি-এর সিনিয়র সাংবাদিক ড. অনুভা জৈনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক রামরায় ভাট তাঁর গবেষণা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন ৷ তিনি বলেন, “ক্যানসার এমন একটি রোগ, যেখানে ক্যানসার কোষগুলি শরীরের যেখান থেকে শুরু হয়, সেখান থেকে শরীরের বিভিন্ন অংশে চলে যায় । এই প্রক্রিয়াটিকে মেটাস্ট্যাসিস বলা হয় । স্তন ক্যানসারে, একজন মহিলার মৃত্যু হয় স্তনের কাজ বন্ধ করে দেওয়ার কারণে নয়, বরং ক্যানসার কোষগুলি রক্তে এবং শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে চলে যাওয়ার কারণে ৷”

Cancer Research in IISc
বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স (আইআইএসসি)-এর গবেষকদের দল৷ (আইআইএসসি-র অধ্যাপক রামরায় ভাট)

এখন প্রশ্ন হল, ডায়াবেটিস বা বার্ধক্য কি ক্যানসার কোষের উৎপত্তিস্থল থেকে রক্তে প্রবেশকে আরও খারাপ করে তোলে ? এই প্রশ্নের উত্তরের সন্ধানে আগে ডাক্তাররা গবেষণা করেছেন ৷ কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে স্পষ্ট কোনও উত্তর মেলেনি । অধ্যাপক ভাটের কথায়, এই প্রক্রিয়াটি অধ্যয়ন বা প্রমাণ করার জন্য কোনও প্রাণীর মডেলে ক্যানসারের পুরো প্রক্রিয়াটি অনুকরণ করা সম্ভব ছিল না এবং বিজ্ঞানীরা ইঁদুরের অঙ্গ থেকে তার রক্তনালীতে ক্যানসার কোষের স্থানান্তর প্রত্যক্ষ করতে পারেননি । ফলে ইঁদুরের মধ্যে এই প্রক্রিয়াটি কল্পনা করা তাঁদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে ।

অধ্যাপক ভাট জানিয়েছেন, এই কারণেই তাঁরা একটি হিস্টোপ্যাথোলজি-প্রণোদিত, ইমেজিং-ট্র্যাক্টেবল, মাইক্রোফ্লুইডিক মাল্টি-অর্গান-অন-চিপ প্ল্যাটফর্ম তৈরি করার বিষয়টি ভাবেন, যেখানে স্তন টিউমারের মতো গবেষণা নির্বিঘ্নে করা যায় ৷ এই মডেলের মাধ্যমে, তারা একটি প্ল্যাটফর্মে একটি অঙ্গের অংশগুলি পুনরায় তৈরি করেন, যাতে সেগুলি মাইক্রোস্কোপের নীচে রাখা যেতে পারে এবং তাঁরা প্রক্রিয়াগুলি কীভাবে ঘটে তা দেখতে পারেন । ভারতে এই ধরনের কয়েকটি চিপ তৈরি করা হয়েছে ৷ এই প্রথম এই ধরনের ডুয়াল অর্গান-অন-চিপ তৈরি হয়েছে, যার একটি অঙ্গের মতো অর্থাৎ, রক্তনালিগুলির মতো হুবহু একই রকম শারীরিক গঠন (অ্যানাটমি) রয়েছে ৷ আর অন্যটি স্তন ক্যানসারের মতো পরিবেশে তৈরি করে ৷

এই নিয়ে আরও বিস্তারিত ব্যাখ্যাও করেছেন অধ্যাপক ভাট ৷ তিনি জানিয়েছেন যে এক্ষেত্রে মাইক্রোফ্লুইডিক্স নামক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় ৷ এর সঙ্গে সংযুক্ত পাম্পের মাধ্যমে রক্ত ​​রক্তনালিতে ফ্লুইড প্রবাহিত করা যেতে পারে ৷ যেমন রক্ত ​​আমাদের রক্তনালিগুলির মাধ্যমে প্রকৃত মানবদেহে সঞ্চালিত হয় । এই চিপ বা পুনর্নির্মিত পরিবেশের মাধ্যমে এই বিজ্ঞানীরা এখন মাইক্রোস্কোপের নীচে দেখতে পারেন যে ক্যানসার কোষগুলি কীভাবে উৎপত্তিস্থল থেকে সরে যায় এবং তৈরি করা রক্তনালিতে প্রবেশ করে ।

এছাড়াও, এই মডেলে মিথাইলগ্লায়ক্সাল (এমজি) নামক একটি বিশেষ রাসায়নিক যুক্ত করা হয়েছে, যা ডায়াবেটিস হওয়া একজন ব্যক্তির বা বয়স্ক ব্যক্তিদের দেহে প্রচুর পরিমাণে থাকে । এই রাসায়নিকটি রক্তনালিতে প্রবেশকারী ক্যানসার কোষের সংখ্যা বৃদ্ধি করে ৷ এর থেকে ইঙ্গিত মেলে যে ডায়াবেটিস শরীরে এমন রাসায়নিক তৈরি করতে পারে, যা ক্যানসার কোষের সংখ্যা বাড়িয়ে দেয় ৷ এর ফলে ওই কোষ উৎপত্তিস্থল থেকে সরে রক্তনালিতে প্রবেশ করতে পারে, যার জেরে ক্যানসার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে ৷ মিথাইলগ্লায়ক্সাল (এমজি) হল একটি ডাইকার্বোনিল স্ট্রেসর ৷ এটা ডায়াবেটিক সংবহন পরিবেশের সঙ্গে যুক্ত ৷ এটা ক্যানসার কোষের গাঢ়ত্ব বৃদ্ধি করে অন্তঃকোষীয় চ্যানেলের মাধ্যমে ৷

যখন আমি জিজ্ঞাসা করলাম এই মিথাইলগ্লাইঅক্সাল (এমজি) রাসায়নিক কেন এটি করছে, তখন তিনি জানালেন যে এই রাসায়নিক রক্তনালি এবং ক্যানসার অঞ্চলের মধ্যে উপস্থিত সমস্ত বিভিন্ন কাঠামোকে পরিবর্তন করে । বয়স্ক ব্যক্তি বা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে, শরীর এই রাসায়নিক তৈরি করে, যা এই বাধাগুলিকে ভেঙে দেয় বা দুর্বল করে । আর যদি এই ধরনের ব্যক্তির (বয়স্ক বা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত) ক্যানসার হয়, তাহলে প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকায় ক্যানসার কোষগুলি সহজেই ও দ্রুতগতিতে রক্তনালিতে প্রবেশ করতে পারে । অন্যদিকে, একজন সুস্থ মানুষের শরীরে প্রচুর স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে, যা ক্যানসার কোষগুলিকে শরীরে ছড়িয়ে পড়তে বাধা দেয় ।

আমার সঙ্গে একটি খোলামেলা সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক প্রসেনজিৎ সেন প্রযুক্তিগত দিকটি সম্পর্কে কথা বলেন ৷ তিনি জানান, চিপগুলি অনন্য (ইউনিক) ৷ কারণ, এগুলি একই সমতলে একাধিক অঙ্গ ব্যবস্থার (অরগান সিস্টেম) সিমুলেশনের অনুমতি দেয় । এটা সহজ এবং বিস্তারিত কল্পনা করার অনুমতিও দেয় । এই নিয়ে আরও বিস্তারিতভাবে তিনি আরও বলেন, "বেশিরভাগ অন্যান্য অরগান চিপ ডিভাইসে অরগান টিস্যুগুলি রক্তনালি চ্যানেলের উপরে উল্লম্বভাবে থাকে । এর ফলে তাদের আকার বোঝা কঠিন হয়ে যায় ৷ কারণ, আমাদের চ্যানেল এবং পৃথককারী ঝিল্লির মাধ্যমে তাদের দেখতে হয় ।"

পরিশেষে, আমি বলতে পারি যে এই অত্যাধুনিক পদ্ধতিটি মেটাস্ট্যাসিস মোকাবিলায় উদ্ভাবনী থেরাপিউটিক কৌশলগুলির পথকে প্রশস্ত করবে । মেটাবলিক ডিসঅর্ডার এবং ক্যানসার বায়োলজির এই ছেদ ক্যানসার চিকিৎসা পদ্ধতির অগ্রগতিতে আন্তঃবিষয়ক গবেষণার গুরুত্ব তুলে ধরে ।

ডায়াবেটিস ও বার্ধক্যের মতো পরিস্থিতিতে মেটাবলিক ডিসঅর্ডার (বিপাকীয় ব্যাধি বা খাদ্য বিপাকে সমস্যা) দেখা যায় ৷ এই পরিস্থিতি ক্যানসারের সম্ভাবনাকে ত্বরান্বিত করে । বার্ধক্যজনিত রোগ বা ডায়াবেটিসের সমস্যা যাঁদের আছে, তাঁরা যদি ক্যানসারে আক্রান্ত হন, তাহলে ফলাফল আরও খারাপ হয় ৷ ক্যানসার কোষ বায়োলজি ও মাইক্রোফ্লুইডিক্সে নিজেদের দক্ষতা ব্যবহার করে বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স (আইআইএসসি)-এর গবেষকরা একটি অভিনব ডুয়াল অর্গান-অন-চিপ তৈরি করেছেন ৷ এটি একটি মাইক্রোফ্লুইডিক কালচার প্ল্যাটফর্ম, যা রক্তনালীর কাছে থাকা টিউমারকে পুনর্গঠন করে মাইক্রোস্কোপিক পর্যবেক্ষণের জন্য উপযুক্ত করতে পারে ।

আইআইএসসি-র বিজ্ঞানীদের দলের এই অভিনব গবেষণার বিষয়ে ‘স্মল’ নামে একটি জার্নালে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে ৷ বিজ্ঞানীদের দলের নেতৃত্বে ছিলেন ডেভেলপমেন্টাল বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক রামরায় ভাট, সেন্টার ফর ন্যানো সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিইএনএসই)-এর অধ্যাপক প্রসেনজিৎ সেন এবং তাঁদের ছাত্র নীলেশ কুমার । চিপ ব্যবহার করে এই বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন যে মিথাইলগ্লায়ক্সাল (এমজি)-এর সংস্পর্শে রক্তনালিতে ক্যানসার কোষের প্রবেশ ত্বরান্বিত হয় । এই ধরনের উদ্ভাবনী ও আন্তঃবিষয়ক গবেষণা ক্যানসার গবেষণায় নতুন দরজা খুলে দেবে ৷

Cancer Research in IISc
বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স (আইআইএসসি)-এর গবেষকদের দল৷ (আইআইএসসি-র অধ্যাপক রামরায় ভাট)

পশ্চিম বিশ্বে একই ধরনের 'লাং-অন-চিপ' মডেল রয়েছে ৷ এই মডেল তৈরি করা হয় মানুষের ফুসফুসের উপর ধূমপানের প্রভাব নিয়ে গবেষণা ও আন্তঃবিষয়ক গবেষণার মাধ্যমের স্বাস্থ্যের উন্নতির দিশা দেখাতে ৷ সেই থেকেই এই বিজ্ঞানীদের মনে এই ধরনের চিপ তৈরির ভাবনা আসে ৷ 2020 সালে বিজ্ঞানীদের মনে এই ভাবনা আসে ৷ তার পর পাঁচবছর কেটে যায় তাঁদের লক্ষ্যপূরণে ৷ ভারতে এই ধরনের চিপ তৈরির প্রযুক্তি মেলে না সাধারণত ৷ সেই কারণে গবেষণার কাজ বিলম্বিত হয় ।

এই অর্গান-অন-চিপ (ওওসি) রোগীদের কোষগুলিকে মাইক্রোস্কোপের নীচে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করবে ৷ আর জানতে সাহায্য করবে যে কীভাবে এবং কেন একটি রোগের ফলাফল এবং এর ব্যবস্থাপনা ব্যক্তি বিশেষে আলাদা হয় । এটাকে 'প্রিসিশন থেরাপি' বলা হয়, যেখানে চিপগুলি ডায়াবেটিসযুক্ত পরিবেশ এবং ডায়াবেটিসবিহীন পরিবেশে বা তরুণ পরিবেশের তুলনায় একটি বয়স্ক টিস্যু পরিবেশের তুলনামূলক ক্ষেত্রে ক্যানসার ছড়িয়ে পড়ার প্রতিলিপি তৈরি ৷

নীলেশ কুমার জানিয়েছেন, জৈবিক গবেষণায় ওওসি একটি কার্যকর বিকল্প তৈরি করেছে ৷ যেকোনও গবেষণায় কোনও প্রাণীকে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে যে নৈতিক উদ্বেগ থেকে যায়, এর ফলে তা দূর হয়েছে ৷ এছাড়া এই প্রযুক্তি মাইক্রোফ্লুইডিক্স ও মানব কোষের ছেদ ব্যবহার করে মানবদেহের জৈবিক অবস্থার অনুকরণ করে ৷ প্রচলিত পদ্ধতিতে যে ফলাফল পাওয়া যায়, এক্ষেত্রে তার তুলনায় আরও সুনির্দিষ্ট ফলাফল মেলে । মাইক্রোফ্লুইডিক্স প্ল্যাটফর্মটি বেশ কিছু সুবিধা প্রদান করে ৷ এর মধ্যে অন্যতম হল টিস্যু আর্কিটেকচারের সমান্তরালকরণের মাধ্যমে মানবদেহের রিয়েল-টাইম সিমুলেশন তৈরি করা ।

ইটিভি-এর সিনিয়র সাংবাদিক ড. অনুভা জৈনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক রামরায় ভাট তাঁর গবেষণা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন ৷ তিনি বলেন, “ক্যানসার এমন একটি রোগ, যেখানে ক্যানসার কোষগুলি শরীরের যেখান থেকে শুরু হয়, সেখান থেকে শরীরের বিভিন্ন অংশে চলে যায় । এই প্রক্রিয়াটিকে মেটাস্ট্যাসিস বলা হয় । স্তন ক্যানসারে, একজন মহিলার মৃত্যু হয় স্তনের কাজ বন্ধ করে দেওয়ার কারণে নয়, বরং ক্যানসার কোষগুলি রক্তে এবং শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে চলে যাওয়ার কারণে ৷”

Cancer Research in IISc
বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স (আইআইএসসি)-এর গবেষকদের দল৷ (আইআইএসসি-র অধ্যাপক রামরায় ভাট)

এখন প্রশ্ন হল, ডায়াবেটিস বা বার্ধক্য কি ক্যানসার কোষের উৎপত্তিস্থল থেকে রক্তে প্রবেশকে আরও খারাপ করে তোলে ? এই প্রশ্নের উত্তরের সন্ধানে আগে ডাক্তাররা গবেষণা করেছেন ৷ কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে স্পষ্ট কোনও উত্তর মেলেনি । অধ্যাপক ভাটের কথায়, এই প্রক্রিয়াটি অধ্যয়ন বা প্রমাণ করার জন্য কোনও প্রাণীর মডেলে ক্যানসারের পুরো প্রক্রিয়াটি অনুকরণ করা সম্ভব ছিল না এবং বিজ্ঞানীরা ইঁদুরের অঙ্গ থেকে তার রক্তনালীতে ক্যানসার কোষের স্থানান্তর প্রত্যক্ষ করতে পারেননি । ফলে ইঁদুরের মধ্যে এই প্রক্রিয়াটি কল্পনা করা তাঁদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে ।

অধ্যাপক ভাট জানিয়েছেন, এই কারণেই তাঁরা একটি হিস্টোপ্যাথোলজি-প্রণোদিত, ইমেজিং-ট্র্যাক্টেবল, মাইক্রোফ্লুইডিক মাল্টি-অর্গান-অন-চিপ প্ল্যাটফর্ম তৈরি করার বিষয়টি ভাবেন, যেখানে স্তন টিউমারের মতো গবেষণা নির্বিঘ্নে করা যায় ৷ এই মডেলের মাধ্যমে, তারা একটি প্ল্যাটফর্মে একটি অঙ্গের অংশগুলি পুনরায় তৈরি করেন, যাতে সেগুলি মাইক্রোস্কোপের নীচে রাখা যেতে পারে এবং তাঁরা প্রক্রিয়াগুলি কীভাবে ঘটে তা দেখতে পারেন । ভারতে এই ধরনের কয়েকটি চিপ তৈরি করা হয়েছে ৷ এই প্রথম এই ধরনের ডুয়াল অর্গান-অন-চিপ তৈরি হয়েছে, যার একটি অঙ্গের মতো অর্থাৎ, রক্তনালিগুলির মতো হুবহু একই রকম শারীরিক গঠন (অ্যানাটমি) রয়েছে ৷ আর অন্যটি স্তন ক্যানসারের মতো পরিবেশে তৈরি করে ৷

এই নিয়ে আরও বিস্তারিত ব্যাখ্যাও করেছেন অধ্যাপক ভাট ৷ তিনি জানিয়েছেন যে এক্ষেত্রে মাইক্রোফ্লুইডিক্স নামক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় ৷ এর সঙ্গে সংযুক্ত পাম্পের মাধ্যমে রক্ত ​​রক্তনালিতে ফ্লুইড প্রবাহিত করা যেতে পারে ৷ যেমন রক্ত ​​আমাদের রক্তনালিগুলির মাধ্যমে প্রকৃত মানবদেহে সঞ্চালিত হয় । এই চিপ বা পুনর্নির্মিত পরিবেশের মাধ্যমে এই বিজ্ঞানীরা এখন মাইক্রোস্কোপের নীচে দেখতে পারেন যে ক্যানসার কোষগুলি কীভাবে উৎপত্তিস্থল থেকে সরে যায় এবং তৈরি করা রক্তনালিতে প্রবেশ করে ।

এছাড়াও, এই মডেলে মিথাইলগ্লায়ক্সাল (এমজি) নামক একটি বিশেষ রাসায়নিক যুক্ত করা হয়েছে, যা ডায়াবেটিস হওয়া একজন ব্যক্তির বা বয়স্ক ব্যক্তিদের দেহে প্রচুর পরিমাণে থাকে । এই রাসায়নিকটি রক্তনালিতে প্রবেশকারী ক্যানসার কোষের সংখ্যা বৃদ্ধি করে ৷ এর থেকে ইঙ্গিত মেলে যে ডায়াবেটিস শরীরে এমন রাসায়নিক তৈরি করতে পারে, যা ক্যানসার কোষের সংখ্যা বাড়িয়ে দেয় ৷ এর ফলে ওই কোষ উৎপত্তিস্থল থেকে সরে রক্তনালিতে প্রবেশ করতে পারে, যার জেরে ক্যানসার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে ৷ মিথাইলগ্লায়ক্সাল (এমজি) হল একটি ডাইকার্বোনিল স্ট্রেসর ৷ এটা ডায়াবেটিক সংবহন পরিবেশের সঙ্গে যুক্ত ৷ এটা ক্যানসার কোষের গাঢ়ত্ব বৃদ্ধি করে অন্তঃকোষীয় চ্যানেলের মাধ্যমে ৷

যখন আমি জিজ্ঞাসা করলাম এই মিথাইলগ্লাইঅক্সাল (এমজি) রাসায়নিক কেন এটি করছে, তখন তিনি জানালেন যে এই রাসায়নিক রক্তনালি এবং ক্যানসার অঞ্চলের মধ্যে উপস্থিত সমস্ত বিভিন্ন কাঠামোকে পরিবর্তন করে । বয়স্ক ব্যক্তি বা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে, শরীর এই রাসায়নিক তৈরি করে, যা এই বাধাগুলিকে ভেঙে দেয় বা দুর্বল করে । আর যদি এই ধরনের ব্যক্তির (বয়স্ক বা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত) ক্যানসার হয়, তাহলে প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকায় ক্যানসার কোষগুলি সহজেই ও দ্রুতগতিতে রক্তনালিতে প্রবেশ করতে পারে । অন্যদিকে, একজন সুস্থ মানুষের শরীরে প্রচুর স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে, যা ক্যানসার কোষগুলিকে শরীরে ছড়িয়ে পড়তে বাধা দেয় ।

আমার সঙ্গে একটি খোলামেলা সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক প্রসেনজিৎ সেন প্রযুক্তিগত দিকটি সম্পর্কে কথা বলেন ৷ তিনি জানান, চিপগুলি অনন্য (ইউনিক) ৷ কারণ, এগুলি একই সমতলে একাধিক অঙ্গ ব্যবস্থার (অরগান সিস্টেম) সিমুলেশনের অনুমতি দেয় । এটা সহজ এবং বিস্তারিত কল্পনা করার অনুমতিও দেয় । এই নিয়ে আরও বিস্তারিতভাবে তিনি আরও বলেন, "বেশিরভাগ অন্যান্য অরগান চিপ ডিভাইসে অরগান টিস্যুগুলি রক্তনালি চ্যানেলের উপরে উল্লম্বভাবে থাকে । এর ফলে তাদের আকার বোঝা কঠিন হয়ে যায় ৷ কারণ, আমাদের চ্যানেল এবং পৃথককারী ঝিল্লির মাধ্যমে তাদের দেখতে হয় ।"

পরিশেষে, আমি বলতে পারি যে এই অত্যাধুনিক পদ্ধতিটি মেটাস্ট্যাসিস মোকাবিলায় উদ্ভাবনী থেরাপিউটিক কৌশলগুলির পথকে প্রশস্ত করবে । মেটাবলিক ডিসঅর্ডার এবং ক্যানসার বায়োলজির এই ছেদ ক্যানসার চিকিৎসা পদ্ধতির অগ্রগতিতে আন্তঃবিষয়ক গবেষণার গুরুত্ব তুলে ধরে ।

ETV Bharat Logo

Copyright © 2025 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.