পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / opinion

ছাব্বিশে গেরুয়া ভারতের স্বপ্ন হয়তো অধরাই - ASSEMBLY ELECTIONS 2026

27 বছর বাদে দিল্লিতে ক্ষমতায় এলো বিজেপি। 2026 সালের বাংলার বিধানসভা নির্বাচনে জিতে দেশে গেরুয়া-আধিপত্য কায়েম করতে চান মোদি-শাহরা।

bjps
বিজেপি (ইটিভি ভারত)

By Dipankar Bose

Published : Feb 24, 2025, 9:37 PM IST

দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নিলেন রেখা গুপ্তা। 8 ফেব্রুয়ারি দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণার শুরু থেকেই বোঝা গিয়েছিল অরবিন্দ কেজরিওয়ালের পক্ষে আর বিজেপিকে রুখে দেওয়া সম্ভব নয় । 70 আসনের দিল্লি বিধানসভায় পদ্ম ফুটল। আপ-কংগ্রেসকে হেলায় হারাল বিজেপি। 2013 সাল থেকে বিজেপির মোকাবিলা করে এসেছেন কেজরি । এবার আর তা হল না। 27 বছর পর দিল্লির ক্ষমতায় বিজেপি ।

দিল্লির ফলাফল দেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে বড় বদল এনেছে। একঝলকে গেরুয়ার দাপট চোখে পড়ে এই মানচিত্রে । দেশের দক্ষিণ দিকে অবশ্য বিষয়টি আদালা। কর্ণাটক, তেলেঙ্গানা, তামিলনাড়ু এবং কেরলা বিজেপি শাসিত নয়। দক্ষিণের পর পূর্ব ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খণ্ডে বিজেপি ক্ষমতায় নেই। উত্তর ভারতের মধ্যে হিমাচল প্রদেশ,জম্মু ও কাশ্মীর এবং পঞ্জাবে ক্ষমতায় নেই বিজেপি বা তাঁর কোনও সহযোগী দল। 2026 সালে অবশ্য এই সমীকরণে বদল আনতে চাইবে বিজেপি । পশ্চিমবঙ্গ তামিলনাড়ু ও কেরলে আগামী বছর বিধানসভা নির্বাচন। ফল ভালো করতে তৎপর গেরুয়া শিবির।

কেরল এবং তামিলনাডুর জন্য বিষয়টি আলাদা। 1980 সালে কেরলে তৈরি হয়েছে লেফট ডেমক্র্যাটিক ফ্রন্ট। তারপর থেকে বামেদের এলডিএফ এবং কংগ্রেসের ইউডিএফ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ক্ষমতায় থেকেছে । জোট রাজনীতি কেরলে একেবারেই নতুন নয়। 1960 সাল থেকে কখনও বাম আবার কখনও কংগ্রেসের সরকার ছিল ভগবানের আপন দেশে। সেখানে বিজেপি বা এনডিএ কোনওদিনই প্রভাব ফেলতে পারেনি । বামেরা অবশ্য কেরলের ভোটারদের উপর প্রভাব ধরে রাখতে পেরেছে। সাধারণত পাঁচ বছর পরপর সরকার বদলায় কেরলে। প্রায় চার দশক বাদে 2016 সালে পরপর দু'বার বামেরা কেরলে ক্ষমতায় আসে। পিনরাই বিজয়নের নেতৃত্বে ক্ষমতা ধরে রাখতে সক্ষম হয় তারা। বিজেপি এই রাজ্যে কোনওদিন নিজের সংগঠন শক্ত করতে পারেনি।

কেরলের প্রতিবেশী রাজ্য তামিলনাড়ুর রাজনীতি সেই প্রথম দিন থেকেই রঙিন। একটা সময় কংগ্রেসের দাপট ছিল। দলের সর্বভারতীয় সভাপতি কে কামরাজ ছিলেন মুখ্য়মন্ত্রী। তারপর শুরু দ্রাবিড় রাজনীতির যুগ। প্রথমে ডিএমকের প্রভাব ছিল । এরপর ডিএমকে ভেঙে এআইএডিএমকে তৈরি হয়। কামরাজের পাশাপাশি তামিলনাড়ুর আরেক প্রবাদপ্রতিম নেতা পেরিয়ারের কথা বলতেই হবে আলাদা করে । একইসঙ্গে আছেন ইভি রামস্বামী থেকে শুরু করে সিএন আন্নাদুরাইয়ের মতো নেতারাও । যাঁরা তামিল ভাবাবেগের কথা বলে ক্ষমতায় এসেছেন। তামিল-রাজনীতির সঙ্গে মিশে রয়েছেন আরও বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। তাঁদের সঙ্গে সিনে দুনিয়ার নিবিড় যোগাযোগ। প্রথমেই বলতে হবে এমজি রামাচন্দ্রনের কথা। ডিএমকে ভাঙার পর নতুন দলের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। পরে তাঁর স্ত্রী জানকি রামাচন্দ্রনও মুখ্যমন্ত্রী হন। আরও পরে জয়ললিতার হাত ধরে আমূল বদলে যায় রাজ্য-রাজনীতি।

অন্যদিকে, করুণানিধি পেরিয়ার থেকে শুরু করে আন্নাদুরাইয়ের সময় থেকে নিজেকে তামিল রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন । তাঁকে কেন্দ্র করেই তামিল-রাজনীতি আবর্তীত হয়েছে দীর্ঘদিন । মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে এমকে স্ট্য়ালিনের হাতে আছে দলের রাশ। 2019 সালের লোকসভা নির্বাচনের সময় থেকে তামিলনাডুর রাজনীতিতে নিজের প্রভাব ফেলতে শুরু করেছেন তিনি। তাঁকে সামনে রেখেই গড়ে উঠেছে সেকুলার প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স (এসপিএ) । 2019 সালের লোকসভা নির্বাচনে যেখানে দেশের প্রায় সব জায়গায় বিজেপি দাপট দেখিয়েছিল সেখানে চমকে দেওয়া ফল করেছিলেন স্ট্যালিনরা । 2021 সালের বিধানসভা নির্বাচনে 234টি আসনের মধ্যে এসপিএ পায় 159টি আসন ।

দ্রাবিড় রাজনীতির মধ্যে থাকা জাতীয়তাবাদকে কাজে লাগিয়ে তামিলনাড়ুতে সংগঠন বৃদ্ধির সুযোগ বিজেপির ছিল। তবে তা বাস্তবে হয়নি । গত ছ'দশক ধরে দ্রাবিড় ভাবাবেগকে নিয়ে পথ চলা রাজনৈতিক দলগুলি হিন্দি-বিরোধী তামিল জাতিয়তাবাদের কথা বলে গিয়েছে । আর তাই তামিলভূমেও বিজেপি হিন্দি বলয়ের দল হয়েই থেকে গিয়েছে। তামিল ভাবাবেগ আর বিজেপিকে একসারিতে বসাতে পারেনি তামিলনাড়ুর একটা বড় অংশ। সেই প্রেক্ষাপট ধরে বলাই যায় 2026 সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির খুব ভালো কিছু আশা করা উচিত নয়। সে রাজ্যের রাজনীতি এখন যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে তা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় শাসক বিরোধী ভোট কোনওভাবে ভাগাভাগি হলে তাতে লাভ শুধু স্ট্যালিনের। বিশিষ্ট তামিল সুপারস্টার বিজয় তামিলাগা ভেটরি কাজাঘাম (টিভিকে) নামে নতুন দল তৈরি করেছেন। এই দলও যদি স্ট্যালিন-বিরোধীদের ভোটে ভাগ বসায় তাহলে ডিএমকে লাভবান হবে ।

সবমিলিয়ে এটা মোটের উপর স্পষ্ট যে 2026 সালের নিরিখে বিজেপির একমাত্র সম্ভাবনার রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর রাজনীতির সৌজন্যে একদা বঙ্গ রাজনীতিতে কার্যত অস্তিত্বহীন বিজেপি এখন বিধানসভার প্রধান বিরোধী দল। 1982 সালে বাংলার রাজনীতির মানচিত্রে বিজেপির আত্মপ্রকাশ। ওই বিধানসভা নির্বাচনে একটি মাত্র আসনে জয়ী হয় গেরুয়া শিবির। 2016 সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে পর্যন্ত মাত্র একবারই ভোটের হার দু' সংখ্যায় নিয়ে যেতে পেরেছে গেরুয়া শিবির। সেটা হল 1991 সালের লোকসভা নির্বাচনে। 2016 সালে এসে বিজেপির সঙ্গে পাহাড়ের রাজনৈতিক দল গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার জোট হয়। তার ফলে তিনটি আসনে জেতে বিজেপি।

2019 সালের লোকসভা নির্বাচনে বাংলার 18টি আসনে পতপত করে উড়েছিল গেরুয়া পতকা। নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহ চেয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কড়া চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে। পাশাপাশি তৃণমূল ছেড়ে অনেক নেতা বিজেপিতে যোগ দেন। সেটাও গেরুয়া শিবিরকে নতুন অক্সিজেন দেয়। তৎাকালীন রাজ্য় বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ এবং তৃণমূলের একদা সেকেন্ড ইন কমান্ড মুকুল রায়ের কৌশলী নেতৃত্ব বিজেপিকে 18টি আসনে জিতিয়ে দেয়। শুধু 18টি আসনে জেতা নয় 40.25 শতাংশ ভোটও পায় গেরুয়া শিবির। এত ভোট বিজেপি পেল কী করে তা নিয়ে সে সময় একটি রসিকতাও চালু হয়েছিল বাংলায়। তা হল,'বামের ভোট রামে...।' এখান থেকেই স্পষ্ট বামপন্থী ভোটের একটা বড় অংশ বিজেপিতে গিয়েছে। তবে বাংলায় ক্ষমতা দখলের লক্ষ্য নিয়ে চলা বিজেপি বুঝতে ভুল করেছিল কোণঠাসা মমতা একদিকে বিপজ্জনক এবং কৌশলী। ঠিক সেভাবেই 2021 সালে বিধানসভা নির্বাচনে নীরবে নিজের কাজটাই করেছেন তিনি।

বাংলায় 18টি লোকসভায় জেতা মানে 126টি বিধানসভা নির্বাচনে এগিয়ে থাকা। এই সাধারণ অঙ্ক বিজেপিকে আশা জুগিয়েছিল তাতে কোনও সংশয় নেই। তাছাড়া ভোটের আগে সিএএ পাশ হয়েছিল । নতুন এই নাগরিকত্ব আইন উদ্বাস্তু ভোটার তাঁদের কাছে আনতে সাহায্য করবে বলে মনে করেছিলেন বিজেপির শীর্ষনেতারা। এই উদ্বাস্তু ভোট দীর্ঘদিন ধরেই বামেরা পেয়ে এসেছে । পরে তা যায় তৃণমূলের ঘরে।

তবে মমতা অন্য পরিকল্পনা করেছিলেন । বিধানসভা নির্বাচনের সময় লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের ঘোষণা হয়। ভোটের ফল বলে দিয়েছে, মমতার সেই পদক্ষেপ আসলে ছিল মাস্টার স্ট্রোক। তাছাড়া করোনা কালের অনিশ্চয়তা থেকে শুরু করে সিএএ নিয়ে বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব-সবই বিজেপির বিপক্ষে যায়। লোকসভার স্বপ্নের দৌড় বিধানসভা নির্বাচনে এসে 77টি আসনে থেমে যায়। তিন থেকে 77 আসনে পৌঁছে যাওয়া সববিচারেই দারুণ। তবে ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন অধরাই থেকে গিয়েছে। তৃণমূলের 'খেলা হবে' স্লোগান ভোটারদের মধ্যে আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল । এই নয়া স্লোগানের দাপটে কোথাও যেন তৃণমূলের চিরাচরিত স্লোগান মা-মাটি-মানুষ ঢাকা পড়ে গিয়েছিল ।

2024 সালের লোকসভা নির্বাচনে আলাদা কিছু দেখা যায়নি। বিজেপি জেতে 12টি আসনে। সন্দেশখালি বা সিএএ-র মতো ঘটনাও রুখতে পারেনি তৃণমূলকে। 2019 সালে 22 আসন পাওয়া তৃণমূল এবার পায় 29টি আসন। ভোটের নিরিখে তৃণমূল পায় 46 শতাংশ ভোট । আর বিজেপি পায় 38 শতাংশ ভোট। এখান থেকেই 2026 সালের লড়াই শুরু করবেন মমতা আর স্ট্যালিন। তামিলনাড়ুতে থাকা একাধিক বিরোধী দল স্ট্যালিনকে সাহায্য় করবে। মমতার জন্য বিষয়টা তাই । তিনি ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন, 2026 সালের বিধানসভা নির্বাচনে একাই লড়বে তৃণমূল । তার মানে বিজেপি, কংগ্রেস, বাম ও পাহাড়ের স্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলির বিরুদ্ধে একাই লড়বে তৃণমূল।

বিজেপির স্বপ্ন 2026 সালের মধ্যে গোটা দেশে গেরুয়া পতাকা ওডা়নো। তার আগে দিল্লি জয় নিশ্চয় তাদের কাছে বড প্রাপ্তি। আলাদা আলাদা লড়াই করা আপ এবং কংগ্রেসকে হারিয়ে বাংলায় ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখছে বিজেপি। সেই স্বপ্ন হয়তো অধরাই থেকে যাবে।

ABOUT THE AUTHOR

...view details