173 মিলিয়ন জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশ একটি ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে রয়েছে । এই দেশ একটি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে গিয়েছে এবং এখন সংস্কারের দিকে তাকিয়ে আছে ৷ যা হল - অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক । বাংলাদেশ গণতন্ত্র ও বিশৃঙ্খলার মধ্যে অনিশ্চিতভাবে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করছে ।
বাংলাদেশ একটি গুরুতর রাজনৈতিক উত্থান, অর্থনৈতিক ভঙ্গুর পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে । ভারত ও চিন থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত আন্তর্জাতিক শক্তি ও দেশের অভ্যন্তরের একটি জটিল আন্তঃক্রিয়া প্রদর্শিত হচ্ছে ৷
উৎখাত এবং তার ফলাফল
2024 সালের 5 অগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসাবে থেকে যাবে । শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে স্বৈরাচারী শাসনের অভিযোগে ছাত্রদের নেতৃত্বে বিক্ষোভ শুরু হয় । এই বিক্ষোভ দুর্নীতি, রাজনৈতিক হিংসা এবং পদ্ধতিগত অবিচারের উপর হতাশা থেকেও প্রভাবিত হয়েছিল । হাসিনা পুলিশকে আন্দোলনকারীদের উপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেন। ফলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় ৷ পুলিশ স্টেশনগুলি পরিত্যক্ত হয় এবং হিংসা ছড়িয়ে পড়ে । অপ্রতিরোধ্য প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়ে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে রাজনৈতিক শূন্যতার মধ্যে ফেলে ভারতে পালিয়ে যান ।
নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপক মুহাম্মদ ইউনুস, যিনি ক্ষুদ্রঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালনের জন্য পরিচিত, তাঁকে তত্ত্বাবধায়ক নেতার দায়িত্ব দেওয়া হয় । তিনি দুর্নীতিমুক্ত স্থিতিশীলতা ও 'নতুন বাংলাদেশ' এবং শীঘ্রই সুষ্ঠু নির্বাচনের ভিত্তি তৈরির প্রতিশ্রুতি দেন । এটা ক্ষমতার কোনও সাধারণ পরিবর্তন ছিল না ।
ইউনুস সরকারের কোনও সাংবিধানিক বৈধতা নেই ৷ শেখ হাসিনা 2011 সালে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিধান বাতিল করেছিলেন । ইউনুসের কর্তৃত্ব শুধুমাত্র তাঁর জনপ্রিয়তা এবং নৈতিক অবস্থানের উপর নির্ভর করে । জাতির জন্য এই ভঙ্গুর ভিত্তি গভীরতম বিভাজনের দিকে দেশকে নিয়ে যাচ্ছে ৷
শাসন ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ
ইউনুসের কৃতিত্ব যে তিনি পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল করতে পেরেছেন । নিরাপত্তা বাহিনী তাদের পদে ফিরে এসেছে ৷ রেমিট্যান্স আসাও শুরু হয়েছে ৷ যা বাংলাদেশের জিডিপির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, 5 শতাংশ ৷ তৈরি পোশাকের রফতানি অক্টোবরে বছরে 21 শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে । কিন্তু সামনের রাস্তা অবিশ্বাসের ।
খাদ্য মূল্যস্ফীতি একটি বিস্ময়কর 13 শতাংশ রয়ে গিয়েছে ৷ বিদ্যুৎ সরবরাহ অনিশ্চিত হয়ে রয়েছে ভারতের আদানি গ্রুপের সঙ্গে অর্থপ্রদানের বিরোধের কারণে বৃদ্ধি পেয়েছে ৷ মারাত্মক বন্যা ধান উৎপাদনকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে । ইউনুসের 24 জন উপদেষ্টার মন্ত্রিসভা, যাঁদের মধ্যে অনেকেই তরুণ এবং অনভিজ্ঞ, শেখ হাসিনার অধীনে থাকায় 36 সদস্যের দলের তুলনায় অনেকটাই নিষ্প্রভ । ইউনুস নিজেই প্রতিরক্ষা, জনপ্রশাসন ও খাদ্য-সহ একাধিক পোর্টফোলিওর দায়িত্ব নিয়ে রেখেছেন ৷ তবে তাঁর পরিচালনা করার অভিজ্ঞতার অভাব স্পষ্ট হয়ে উঠছে ।
এদিকে তাঁর সমর্থকদের দাবি আরও বাড়ছে । বিপ্লবের নেতৃত্বদানকারী ছাত্ররা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে শেখ হাসিনার বিচার-সহ আমূল সংস্কার চান । অন্যদিকে আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন চায় । বিএনপি তার অনিশ্চিত অবস্থান সম্পর্কে সচেতন ৷ কারণ, তারাও ক্ষমতায় থাকাকালীন অপব্যবহারের অভিযোগের সম্মুখীন হয়েছে । বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর 2025 সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন করানোর দাবি তুলেছেন ৷ না-হলে ব্যাপক বিক্ষোভের হুমকি দিয়ে রেখেছেন ৷
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা বিচ্ছিন্নভাবে ঘটছে না । বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান এই দেশকে আঞ্চলিক ও বিশ্বব্যাপী প্রতিদ্বন্দ্বিতার কেন্দ্রে রাখে । বাংলাদেশের স্থিতিশীলতায় ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে । শেখ হাসিনার শাসনকালে ভারত ঢাকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে, বিশেষ করে জ্বালানি ও সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধের মতো ক্ষেত্রে । তবে, মোদির সরকার এখন ইউনুসের অন্তর্বর্তীকালীন শাসনের অধীনে ইসলামপন্থী শক্তির পুনরুত্থানের ফলে যে ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তা সতর্কতার সঙ্গে দেখছে ।
আদানি গ্রুপের বিতর্ক জটিলতার আরেকটি স্তর যোগ করেছে । বাংলাদেশ বিদ্যুতের চাহিদার ক্ষেত্রে প্রায় 10 শতাংশ ভারতের ওপর নির্ভরশীল । বকেয়া পরিশোধ নিয়ে বিরোধের কারণে ইতিমধ্যেই বিদ্যুৎ সরবরাহ কমে গিয়েছে । ইউনুস এসব সমস্যা সমাধানের অঙ্গীকার করেছেন । আন্তঃসীমান্ত জল বণ্টন এবং ভারতে হাসিনাকে ঠাঁই দেওয়া নিয়ে উত্তেজনা এখনও অমীমাংসিত ।
এদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প ফের প্রেসিডেন্ট পদে বসতে চলায় নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে ৷ বিদেশি সহায়তা এবং জলবায়ু সংক্রান্ত পদক্ষেপ নিয়ে ট্রাম্পের সংশয়ী মনোভাবের ফলে আমেরিকা যে প্রায় 1.2 বিলিয়ন মার্কিন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তার উপর প্রভাব পড়তে পারে । বাংলাদেশও চিনের সঙ্গে অতিরিক্ত ঋণ ও অনুদানের জন্য আলোচনা করছে । ইউনুসকে অবশ্যই এই সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রাখবে হবে । বেজিং ইতিমধ্যে 2 বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, আরও 5 বিলিয়ন ডলারের জন্য আলোচনা চলছে । তবে ঋণের ফাঁদে পড়ার ঝুঁকি অনেক বেশি রয়েছে ।
পশ্চাদপসরণের ঝুঁকি রয়েছে
প্রাথমিক আশাবাদ যখন রাজনৈতিক অচলাবস্থার পথ দেখায়, তখন বিপ্লব প্রায়ই স্তব্ধ হয়ে যায় । ইউনুস এখন এই ঝুঁকির সম্মুখীন । তিনি যদি অকাল নির্বাচনের দাবি মেনে নেন, তাহলে তিনি যে বিচার ব্যবস্থা ঠিক করা এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার মতো কাঠামোগত সংস্কারের কথা ভাবছেন, সেটা কখনই বাস্তবায়িত হবে না । একটি ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন আওয়ামী লীগ বা বিএনপির কাছে ক্ষমতা ফিরে যেতে পারে, যা আবার দুর্নীতিযুক্ত ও গুন্ডামিপূর্ণ শাসনের চক্রকে স্থায়ী করতে পারে ।