হায়দরাবাদ, 3 এপ্রিল: চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের (সিপিইসি) নির্মেয়মান প্রকল্পে এবং শ্রমিকদের উপর হামলার ঘটনা বৃদ্ধি দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা এবং দূরত্ব বাড়িয়েছে । এর মধ্যে রয়েছে গোয়াদরে হামলা (চিনাদের নির্মিত) এবং তুরবাতে পাকিস্তানের নৌ ঘাঁটি, পাশাপাশি ওই দেশের উত্তর-পশ্চিমে খাইবার পাখতুনখোয়ার (কেপি) একটি জেলা শাংলায় চিনা ইঞ্জিনিয়ারদের উপর বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মির (বিএলএ) আত্মঘাতী হামলা । হামলার সময় চিনা ইঞ্জিনিয়াররা ইসলামাবাদ থেকে দাসুতে হাইডেল পাওয়ার প্রজেক্টের কাজে যাচ্ছিলেন ।
আত্মঘাতী হামলায় 5 চিনা ইঞ্জিনিয়ার আর তাদের স্থানীয় গাড়ির চালকরা নিহত হয় । গোয়াদর ও তুর্বতে হামলার দায় বিএলএ স্বীকার করলেও, কোনও জঙ্গি গোষ্ঠী চিনাদের ওপর হামলার দায় স্বীকার করেনি । পাকিস্তানের জন্য, সবচেয়ে গুরুতর ঘটনাটি ছিল চিনা ইঞ্জিনিয়ারদের উপর হামলা ৷ কারণ, এই হামলার ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয় বেইজিং ৷ চিনা ইঞ্জিনিয়ারদের নিশানা করায় বেজিং থেকে কড়া প্রতিক্রিয়া মেলে । পাকিস্তানে চিনা নাগরিকদের প্রতিনিয়ত টার্গেট করা হচ্ছে ।
খাইবার পাখতুনখোয়ার (কেপি) শাংলায় এই হামলার ঘটনায় পাকিস্তানের পক্ষ থেকে পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত এবং দোষীদের কঠোর শাস্তির দাবি তুলেছে চিন ৷ বেইজিংয়ে চিনা মুখপাত্র বলেন, 'সিপিইসিতে অন্তর্ঘাতের কোনও চেষ্টা কখনওই সফল হবে না ।' এই ঘটনার পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং প্রেসিডেন্ট ইসলামাবাদে চিনা দূতাবাস পরিদর্শন করেন এবং বেইজিংয়ের ক্রমবর্ধমান অস্বস্তি কমানোর আশায় শোক প্রকাশ করেন ।
প্রত্যাশিত ভাবেই, পাকিস্তান এই হামলার জন্য দায়ী বলে 'চিন-পাক বন্ধুত্ব বিরোধী'দেরই দায়ী করেছে । পাকিস্তানের সেনা একটি বিবৃতি প্রকাশ করে জানিয়েছে, 'কিছু বিদেশী শক্তি তাদের স্বার্থে পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদে সহায়তা ও মদত দিচ্ছে ।' এই হামলায় পাক সেনা আফগান তালেবান দ্বারা সমর্থিত একটি জঙ্গি গোষ্ঠী টিটিপির (তেহরীক-ই-তালেবান পাকিস্তান) রিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে ৷ যদিও টিটিপি এই হামলার দায় অস্বীকার করেছে ।
সম্প্রতি, পাকিস্তান দাবি করেছে যে, টিটিপি কাবুলের মাধ্যমে ভারতের সমর্থন পাচ্ছে ৷ চিন-ভারত সম্পর্কের অচলাবস্থার কথা মাথায় রেখে এই হামলায় ভারতের পরোক্ষ যোগের ইঙ্গিত দিয়েছে পাকিস্তান । হামলার প্রভাব ইতিমধ্যেই অনুভূত হচ্ছে । ইতিমধ্যেই চিনা গোয়েন্দারা এই হামলার তদন্তে যোগ দিয়েছে ৷ এর থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট, এই ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তে পাকিস্তানের উপর তেমন আস্থা নেই চিনের । চিনা কোম্পানিগুলি দাসু বাঁধ, দিয়ামার-বাশা বাঁধ এবং তারবেলা পঞ্চম এক্সটেনশনে কাজ স্থগিত করেছে ৷ এর পাশাপাশি, হাজার হাজার স্থানীয় শ্রমিককে ছাঁটাই করেছে ।
এই হামলার পর সিপিইসি প্রকল্পে নিযুক্ত চিনা নাগরিকরা নড়েচড়ে বসেছে এবং অনেকেই ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছে । 2021 সালের জুলাই মাসে দাসু প্রকল্পে নিযুক্ত ইঞ্জিনিয়ারদের উপর হামলায় 9 জন নিহত হওয়ার পরে চিনা শ্রমিকদের কাজ ছাড়ার ঘটনা ঘটেছে । এই হামলার পর দাসু প্রকল্পে চিনা কর্মীদের ফিরে এসে ফের কাজে যোগ দিতে অনেকটা সময় লেগে গিয়েছিল ।
চিন বারবার পাকিস্তানে কর্মরত তাদের নাগরিকদের জন্য বাড়তি সুরক্ষার দাবি জানিয়ে এসেছে । 2021 সালে, চিন তার 9 জন নিহত ইঞ্জিনিয়ারের জন্য 38 মিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিল, যা দেওয়া আসলে ইসলামাবাদের সামর্থের বাইরে ছিল । পাকিস্তান এই ক্ষতিপূরণের অংক পুনর্বিবেচনার আর্জি জানিয়েছিল ৷ যদিও চূড়ান্ত ক্ষতিপূরণের অংক অজানাই রয়ে গিয়েছে ।
2023 সালের এপ্রিলে, একজন চিনা ইঞ্জিনিয়ারের বিরুদ্ধে ব্লাসফেমির অভিযোগ আনা হয়েছিল । তাকে পুলিশ উদ্ধার করে পরে দেশে ফেরত পাঠায় । গত বছরের অগস্টে ২৩ জন চিনা ইঞ্জিনিয়ার বহনকারী একটি বাসে হামলা চালানো হয় । এই হামলা পাক সেনারা প্রতিহত করে, ফলে কোনও চিনা নাগরিকের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি । এর আগে 2021 সালে, কোয়েটার একটি হোটেল, যেখানে চিনা রাষ্ট্রদূতের থাকার ব্যবস্থা হবে বলে আশা করা হয়েছিল, সেখানে জঙ্গি হামলা চালানো হয় । তবে ঘটনাচক্রে চিনা রাষ্ট্রদূত তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন না । এক মাস পর একটি বাসে আত্মঘাতী বোমার হামলায় করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে চিনের তৈরি কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটের 3 জন চিনা কর্মীর মৃত্যু হয় । এই সব ঘটনায় প্রতিবারই চিন এর পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত দাবি করেছে ।
এই সব ঘটনায় পাকসেনারা বিনা বিচারে স্থানীয়দের তুলে নিয়ে যায় এবং জেলে বন্দি করে তাদের উপর নানা ভাবে চাপসৃষ্টি করে স্বীকারোক্তি আদায় করে । পাকিস্তান বরাবরই চিনাদের ওপর হামলার পিছনে বিদেশি শক্তি যোগের ইঙ্গিত দিয়েছে । প্রতিবারই বেইজিং তার নাগরিকদের হত্যার ঘটনায় আটকে পড়ে । তবে তা সত্ত্বেও সিপিইসি ছাড়তে পারে না ৷ কারণ, চিন এই প্রকল্পে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে যা তার বিআরআই (বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভ) এর মূল অংশ । তাই, সমস্ত ক্ষতি এবং হামলার ঘটনা সত্ত্বেও, তারা পাকিস্তানের সঙ্গে 'তোতা নৈকট্য' অব্যাহত রাখে । পাশাপাশি, পাকিস্তানের ঋণ শোধ করার সামর্থ নেই এমনটাই মনে করে বাধ্য হয়েই চিনা প্রকল্পগুলি শামুকের গতিতে কাজ এগিয়ে নিয়ে চলেছে । আমেরিকা-সহ তার বন্ধুপ্রতীম দেশগুলোর কাছ থেকে পাকিস্তান এই দিক থেকে কিছুটা সহানুভূতি পেয়েছে ।
ফলে এই হামলার জেরে চিন আবারও সিপিইসি প্রকল্পে কাজ করা তার নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য নিজস্ব সেনা নিয়োগের জন্য জোর দেবে । এই ধরনের দাবি মেনে নিয়ে সিদ্ধান্ত নিলে পাকিস্তানের খরচ অনেকটা বেড়ে যাবে ৷ কারণ, নিজেদের সুরক্ষায় নিয়োজিত চিনা নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য তখন টাকা খরচ করতে হবে পাকিস্তানকেই । শুধু তাই নয়, চিনের এই দাবি মেনে নেওয়ার অর্থ, পাকসেনাবাহিনী তাদের নিজের দেশের নিরাপত্তাই নিশ্চিত করতে অক্ষম, সেই বিষয়টিতে পরোক্ষ সম্মতি দেওয়া ।