নয়াদিল্লি, 1 অগস্ট: পশ্চিম ঘাটের অংশ উত্তর-পূর্ব কেরালার পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল ওয়েনাড় জেলাকে সংরক্ষণ করার জন্য শীর্ষস্তরের পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বহুবার সতর্ক করেছেন ৷ তার পরও চলতি সপ্তাহে সেখানে ভূমিধসের ঘটনা ঘটেছে ৷ সেই ঘটনায় এখনও পর্যন্ত 292 জনের প্রাণহানি হয়েছে বলে খবর ৷
ওয়েনাড় কেরলের একমাত্র মালভূমি এবং এটি দাক্ষিণাত্য মালভূমির দক্ষিণ অংশ, যা মহীশূর মালভূমি থেকে তৈরি হয়েছে ৷ এটি পশ্চিম ঘাটে 700 থেকে 2100 মিটার পর্যন্ত উচ্চতায় অবস্থিত ।
ওয়েনাড় পরিবেশগতভাবে একটি সংবেদনশীল এলাকা হিসাবে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত । এর সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য, অনন্য বাস্তুতন্ত্র, জটিল জলসম্পদ এবং মানুষের ক্রিয়াকলাপ ও পরিবেশগত পরিবর্তনের ফলে যে চ্যালেঞ্জগুলি তৈরি হয়, তা থেকেই এই পার্থক্য় তৈরি হয়েছে ৷ অঞ্চলটি উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতির একটি অসাধারণ বৈচিত্র্যের আবাসস্থল । এর বনভূমিতে অসংখ্য স্থানীয় ও বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী রয়েছে । এই অঞ্চলের গাছপালা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রেইনফরেস্ট থেকে শুরু করে পর্ণমোচী বন পর্যন্ত বিস্তৃত৷ প্রত্যেকটি অনন্য জীবন গঠনের উদাহরণ রয়েছে এখানে ৷
পশ্চিমঘাটের যেখানে ওয়েনাড় অবস্থিত, বিশ্বের জীববৈচিত্র্যের হটস্পটগুলির মধ্যে একটি । ওয়েনাড় এই মর্যাদায় উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রেখেছে, সেখানকার উচ্চস্তরের স্থানীয় প্রজাতিগুলির জন্য । অনেক প্রজাতির গাছপালা, স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি, উভচর ও কীটপতঙ্গ ওয়েনাডে পাওয়া যায় না ।
তবে দ্রুত নগরায়ণ, কৃষি ও বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম ওয়েনাড়ে বাসস্থানকে উল্লেখযোগ্যভাবে ভাগ করেছে ৷ এই বিভাজনের কারণে অনেক প্রজাতি সংকটে পড়েছে ৷ বিশেষ করে যে প্রজাতিগুলির থাকার জন্য বেশি জায়গা দরকার, সেই প্রজাতিগুলির সমস্যা বেশি হয়েছে ৷ গাছ কাটা, কৃষির জন্য বনভূমি রূপান্তর এবং মানুষের দ্বারা অন্যান্য কর্মকাণ্ড জঙ্গলকে শেষ করে দিয়েছে ৷ বনভূমির এই ক্ষতির ফলে জীববৈচিত্র্য কমেছে, মাটির ক্ষয় হয়েছে ও হাইড্রোলজিক্যাল সাইকেল পরিবর্তিত হয়েছে ।
সেই কারণেই ওয়েনাড়-সহ পশ্চিম ঘাটের পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল অঞ্চলগুলির সুরক্ষা নিশ্চিত করার কাজ শুরু করে কেন্দ্র । ওয়েস্টার্ন ঘাটস ইকোলজি এক্সপার্ট প্যানেল তৈরি হয় ৷ এর চেয়ারম্যান মাধব গাডগিল ৷ পরে এটা গাডগিল কমিশন নামেও পরিচিত হয় ৷ এই কমিশন ভারতের পরিবেশ ও বন মন্ত্রক তৈরি করেছিল ৷ কমিশনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিমঘাটের বাস্তুসংস্থানের মূল্যায়ন করা এবং এই এলাকার পরিবেশ রক্ষা নিয়ে প্রস্তাব তৈরি করা । এর মধ্যে রয়েছে বাস্তুসংস্থানের মূল্যায়ন, অঞ্চলের জোনেশন, নীতিগত সুপারিশ এবং দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন ।
প্যানেল পুরো পশ্চিমঘাটকে একটি পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল এলাকায় শ্রেণীবদ্ধ করার প্রস্তাব করে । প্রতিবেদনে পশ্চিমঘাট সীমানার মধ্যে 142টি তালুককে তিনটি পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল অঞ্চলে বিভিন্ন মাত্রার সুরক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয় ৷ আর সেই অনুযায়ী ভাগ করা হয় ৷ সেই শ্রেণিগুলি হল - ইএসজেড-1, ইএসজেড-2 ও ইএসজেড-3 ৷ ইএসজেড-1 এ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের উপর কঠোর নজরদারি-সহ সর্বোচ্চ সুরক্ষাস্তরের সুপারিশ করা হয়েছিল । ইএসজেড-2 এর জন্য নিয়ন্ত্রিত উন্নয়ন-সহ মাঝারি সুরক্ষার সুপারিশ করা হয়েছিল । ইএসজেড-3 এর জন্য অনুমোদিত দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের সঙ্গে কম সুরক্ষার সুপারিশ করা হয়েছিল ।
ইএসজেড-1 ও ইএসজেড-2 এ খননকার্য এবং বড় আকারের নির্মাণের মতো কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করা উচিত । প্রতিবেদনে এই অঞ্চলগুলিতে ক্ষতি হতে পারে এমন যে কাজগুলি হচ্ছে, পর্যায়ক্রমে বন্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছে । ইকোলজিক্যাল ফুটপ্রিন্ট কমাতে জৈবচাষ, কৃষি বনায়ন ও অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদী চাষবাসকে উৎসাহিত করার কথা বলা হয়েছিল ৷
প্যানেলের তরফে সংরক্ষণের প্রচেষ্টা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াগুলিতে স্থানীয় সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কথাও বলা হয় ৷ এর মধ্যে রয়েছে তাদের বিকল্প জীবিকা প্রদান এবং দীর্ঘমেয়াদী অনুশীলনের বিষয়ে শিক্ষা ।
আরেকটি প্রধান সুপারিশ ছিল ওয়েস্টার্ন ঘাট ইকোলজি অথরিটি (ডব্লিউজিইএ) প্রতিষ্ঠা করা যাতে সংরক্ষণ ব্যবস্থা বাস্তবায়নের তদারকি করা যায় এবং নিয়ম মেনে চলা নিশ্চিত করা যায় । কমিশন 2011 সালের অগস্টে তাদের প্রতিবেদন জমা দেয় ।
তবে, গাডগিল কমিশন রিপোর্ট অত্যধিক পরিবেশ-বান্ধব ও বাস্তবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে সমালোচনা করা হয়েছিল । সমালোচনা রাজ্য সরকার, শিল্পমহল ও স্থানীয় সম্প্রদায়-সহ বিভিন্ন পক্ষের কাছ থেকে আসে ৷ তারা আশঙ্কা করেছিল যে কঠোর নিয়ম লাগু হলে ওই এলাকায় অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ও উন্নয়ন বাধাপ্রাপ্ত হবে ৷ ডব্লিউজিইএ নামে একটি নতুন সংস্থা গঠনের সুপারিশও অনেক সমালোচনার মধ্যে পড়ে ।
কেরালাতেও কিছু নির্দিষ্ট অংশের লোকেরা ওই রিপোর্ট বাস্তবায়নের তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন ৷ কারণ, বেশিরভাগ কৃষকই ওয়েনাড়ের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে তাঁদের জীবিকা অর্জন করেন । বিংশ শতাব্দীতে দক্ষিণ কেরালা থেকে প্রচুর সংখ্যক লোক স্থানান্তরিত হয়ে ওয়েনাড় ও অন্যান্য অঞ্চলে বনভূমিতে থাকতে শুরু করেছিলেন ৷
বিতর্ক ও বিরোধিতার কারণে ভারত সরকার গাডগিল কমিশনের সুপারিশ পর্যালোচনা করার জন্য বিশিষ্ট মহাকাশ বিজ্ঞানী কে কস্তুরিরঙ্গনের নেতৃত্বে আরেকটি প্যানেল তৈরি করে ৷ যার নাম ছিল কস্তুরিরঙ্গন কমিশন ৷