কলকাতা, 2 ডিসেম্বর: ফিরবে না, সে কী ফিরবে না...? ফিরবে না আর কোনওদিন ! মহানগরীর মানুষের মনে এই প্রশ্নই দানা বেঁধেছিল ৷ আশঙ্কা ছিল, হয়তো শিগগিরই চিরতরে হারিয়ে যাবে কলকাতার অন্যতম ঐতিহ্য ৷ হলুদ পাখি ফিরেছে কি না জানা নেই ৷ তবে স্বমহিমায় কলকাতার রাস্তায় নতুন রূপে ফিরছে হলুদ ট্যাক্সি ৷ জল্পনার অবসান ঘটিয়েছে নয়া এক তথ্য ৷ 'হলুদের' ছোঁয়া মুছে যাচ্ছে না কলকাতার রাজপথ থেকে । বরং শহরে নতুনভাবে 'হলুদ' ফিরছে । সূত্রের তরফে জানা গিয়েছে, আসন্ন বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনে হলুদ ট্যাক্সি নবরূপে প্রকাশিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ।
কলকাতার অনেক আইকনিক জিনিসের মধ্যে অন্যতম হল হলুদ ট্যাক্সি । বয়সের ভারে সে নুইয়ে গিয়েছে বলে সরিয়ে দেওয়ার রব উঠেছিল । কিন্তু যা রটে তা সবসময় ঘটে না । বরং নতুনভাবে স্বমহিমায় কলকাতার রাজপথে ফিরছে নস্টালজিক হলুদ ট্যাক্সি ।
শহর কলকাতার পরিচয় যেন এই হলুদ ট্যাক্সি । কলকাতা বললেই ভিন রাজ্য বা দেশের মানুষের কাছে প্রথমেই ভেসে ওঠে এই হলুদ যান ৷ বিভিন্ন সেলিব্রেটিদেরও কলকাতায় এসে এই হলুদ ট্যাক্সি চেপে শহর চষে বেড়াতে দেখা গিয়েছে ৷ সম্প্রতি তার উদাহরণ হল, বিখ্যাত পাঞ্জাবি গায়ক দিলজিৎ দোসাঞ্জ ৷ কলকাতায় এসে তিনি হলুদ ট্যাক্সি চড়ার বেশকিছু ছবি পোস্ট করেছেন তাঁর সোশাল মিডিয়া হ্যান্ডেলে ৷ এর আগে কার্তিক আরিয়ানকেও দেখা গিয়েছিল ছবির প্রচারে শহরে এসে হলুদ ট্যাক্সির মাথায় উঠে ছবি তুলতে ৷ তাঁর সঙ্গে ছিলেন বিদ্যা বালানও ৷
কলকাতার ইমোশন হলুদ ট্যাক্সি
একদা শহর কলকাতা মানেই তো ছিল হাওড়া ব্রিজ, ট্রাম এবং হলুদ ট্যাক্সি । তবে বর্তমানে গণপরিবহণ অনেক বেশি স্মার্ট । তাই এক সময় অতি ব্যবহৃত ট্রাম বা হলুদ ট্যাক্সি অপরিহার্য থাকলেও শহরবাসী এখন অনেক বেশি নির্ভরশীল মেট্রো এবং অ্যাপ ক্যাবের উপর ।
এরই সঙ্গে রাজ্যে বন্ধ হয়েছে অ্যাম্বাসেডর গাড়ি নির্মাণকারী সংস্থা হিন্দুস্থান মোটরস ৷ হলুদ ট্যাক্সিগুলো হল অ্যাম্বাসেডর গাড়ি ৷ হিন্দুস্থান মোটরস কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাই তার সঙ্গে অস্তাচলে গিয়েছে অ্যাম্বাসেডর গাড়ির নির্মাণও । হিন্দুস্থান মোটরসের বিড়লার কারখানাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে । আর তাই পথে যেই অ্যাম্বাসেডর ট্যাক্সিগুলো চলছে, সেগুলি অচিরেই বয়সের ভারে স্বাভাবিক নিয়মে চলা বন্ধ হয়ে যাবে । তাই অ্যাম্বাসেডর বন্ধ হয়ে গেলেও যাতে হলুদ ট্যাক্সির সঙ্গে যুক্ত আবেগ শেষ হয়ে না যায়, তাই নতুন রূপে আবারও আত্মপ্রকাশ করতে চলেছে হলুদ ট্যাক্সি ক্যাব ।
স্বমহিমায় রাজপথে ফিরছে হলুদ ট্যাক্সি
কলকাতার আইকন ট্রাম যেমন ট্রামপ্রেমীদের চেষ্টায় যেতে যেতেও যাচ্ছে না, তেমনই হলুদ ট্যাক্সি রাজপথ থেকে মুছে গিয়ে মুছছে না । বরং আরও নতুন ভাবে ফিরে আসছে সে । পরিবহণ দফতর সূত্রে খবর, ঝাঁ চকচকে আধুনিক কলেবরে পথে নামবে আরও 2000 হলুদ ট্যাক্সি । এক বেসরকারি সংস্থা নতুন রূপে হলুদ ট্যাক্সি নামাতে চলেছে শহরের রাজপথে । প্রাথমিকভাবে পথে 2000 ট্যাক্সি নামানোর পর ধাপে ধাপে আরও বেশ কয়েক হাজার হলুদ ট্যাক্সি নামানোর পরিকল্পনা রয়েছে । আসন্ন বাণিজ্য সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এমনটাই ঘোষণা করতে চলেছেন বলে খবর ৷
শুধু তাই নয়, পরিবহণ দফতর সূত্রে এমনটাও জানা গিয়েছে, পুরনো অ্যাম্বাসেডরের পারমিটেই পাওয়া যাবে নতুন ট্যাক্সি নামানোর পারমিট । এক আধিকারিক জানিয়েছেন, "আমরা চাই ট্যাক্সি সংগঠনের চালক ও মালিক এসে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করুক ৷ কারণ পরিবহণ দফতরও হলুদ ট্যাক্সির নস্টালজিয়াকে বাঁচিয়ে রাখতে চায় । তাই কেউ যদি বাণিজ্যিক নম্বর প্লেটে ট্যাক্সি নামাতে চান এবং সেই গাড়িকে হলুদ রং দিতে চান, পরিবহণ দফতরের অনুমোদন সাপেক্ষে সেটাও করা যাবে ।"
হলুদ ট্যাক্সির হাল ফেরাতে উদ্যোগ
প্রসঙ্গত, বর্তমানে আকাশছোঁয়া জ্বালানির দামের সঙ্গে গত 2018 সাল থেকে ভাড়া বাড়েনি ট্যাক্সির । রাজ্যের ট্যাক্সি পরিবহণের এই রুগ্ন অবস্থার বেশ অনেকটাই ফায়দা তুলতে পেরেছে অ্যাপ ক্যাব সংস্থাগুলি । তাই অ্যাপ ক্যাবের দৌরাত্ম্যের উপর রাশ টানতেই রাজ্যে পরিবহণ দফতরের উদ্যোগে হলুদ ট্যাক্সির হাল ফেরাতে মিটার ট্যাক্সিকে 'যাত্রী সাথী' অ্যাপে যুক্ত করা হয় ।
ট্রাফিক ও পরিবহণ দফতর সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুসারে, তিন বছরের মাথায় 'যাত্রী সাথী' অ্যাপের মাধ্যমে হলুদ ট্যাক্সির প্রায় 71 হাজার চালক এই অ্যাপের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন ৷ চালকদের আয় হয়েছে প্রায় 166 কোটি টাকা ৷ প্রায় 61 লক্ষ ট্রিপ সম্পূর্ণ করেছেন তাঁরা । 3 কোটি 19 লক্ষ বার অ্যাপটি সার্চ করা হয়েছে ।
হলুদ ট্যাক্সির ইতিহাস
উল্লেখ্য, 1908 সালে শহর কলকাতায় প্রথম ট্যাক্সি দৌড়তে শুরু করে চৌরঙ্গী রোডের উপর দিয়ে । ফরাসি কোম্পানি শেভিজাঁ প্রথম ট্যাক্সি নিয়ে আসে শহরে । তারপর ইন্ডিয়ান মোটর ট্যাক্সি ক্যাব অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি ট্যাক্সি নিয়ে আসে । এরপর ইংরেজরা দেশ ছেড়ে চলে যেতে বন্ধ হয়ে যায় ওই কোম্পানি । তখন 1957 সালে হিন্দুস্তান মোটরস কোম্পানি বাজারে নিয়ে আসে অ্যাম্বাসেডর ।
এই গাড়িগুলি তখন ব্যক্তিগত ব্যবহারের পাশাপাশি ট্যাক্সি হিসেবে বাণিজিকভাবে চালানো শুরু হয় । তখন শহরের মধ্যে চলাচলকারী ট্যাক্সির রং ছিল কালো-সাদা । যেগুলি শহরের বাইরে যেত সেগুলি ছিল হলুদ । তবে সাদা-কালো ট্যাক্সি সরে গিয়ে রয়ে যায় শুধুই হলুদ ট্যাক্সি । তারপর হিন্দুস্তান মোটরস কোম্পানিও অ্যাম্বাসেডর তৈরি বন্ধ করে দেয় । সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে শহরে এসেছে অ্যাপ ক্যাব ।