আসানসোল, 1 অক্টোবর: ড্যাং-ড্যাং-ড্যাং ক'রে ঢাক বাজছে। আর একটি মন্দির চত্বরে শ'য়ে শ'য়ে মহিলা-পুরুষ লড়াইতে মেতেছে। কেউ কারও চুলের মুঠি ধরে টানছে, কেউবা ঘুঁসি-লাথি মারছে। ভূ-ভারতে দুর্গাপুজোকে ঘিরে এমন দৃশ্য আর কোথাও চোখে পড়বে কি না, জানা নেই ! তবে কুলটির নিয়ামতপুরে সিংরাই বাবার আদিবাসী আশ্রমে দুর্গাপুজোর নবমীতে হয় সত্যিকারের অসুর-দুর্গার লড়াই। তবে এখানেও শেষ পর্যন্ত জয়ী হয় মাতৃশক্তি।
কুলটি নিয়ামতপুরে ইস্কো বাইপাস রোডের পাশে 1975 সাল থেকে সিংরাই বাবার আশ্রমে দুর্গাপুজো হয়ে আসছে। এক সময় সিংরাই মারান্ডি নামে এক আদিবাসী ধর্মগুরু নিজেকেই দেবতা বলে ঘোষণা করেন এবং একটি মন্দিরে নিজেরই মূর্তি বানিয়ে পুজো শুরু করেন। হইচই পড়ে যায় আসানসোলে। তারপর থেকেই সেই মন্দিরে নানা উৎসব পালিত হয়ে আসে। তার মধ্যে দুর্গাপুজোও একটি। তবে সব পুজোতেই ধর্মগুরু সিংরাই মারান্ডির নিজস্ব নিয়ম কানুন চলত। সিংরাই মারা গিয়েছেন বেশ কয়েক বছর হল। কিন্তু, এখনও তাঁর মন্দিরের আদিবাসী দুর্গাপুজো একেবারেই অন্যরকম।
পুজোর নিয়ম-
এখানে ষষ্ঠীতেই প্রতিমার বিসর্জন হয়। আসলে দুর্গাপুজোর সময় যে প্রতিমাকে পুজো করা হয় সেই প্রতিমা থেকে যায় সারা বছর মন্দিরে। নিত্যপুজো করা হয় সেই প্রতিমার। ষষ্ঠীর দিন সেই প্রতিমাকে বিসর্জন দিয়ে নতুন প্রতিমা প্রতিস্থাপিত হয় মন্দিরে। তারপরেই শুরু হয় 'আসল' পুজো। আদিবাসী মন্ত্র উচ্চারণেই এখানে পুজো হয়। ফুল, বেলপাতায় এখানে পুজো হয়। কোনও রকমের বলিদান প্রথা চল নেই। প্রকৃতির পশু এবং গাছকে যাতে হানি না করা হয় সেই বার্তাই উঠে আসে এই আদিবাসী পুজোতে।
পুজোর আকর্ষণ-
তবে এই পুজোর মূল আকর্ষণ নবমীতে। একদা সিংরাই মারান্ডি এবং তার স্ত্রী দুলালী মারান্ডি দু'জনে মিলে দুর্গা-অসুরের লড়াই করতেন নবমীতে। সেই লড়াই দেখতে ভিড় জমে যেত। বর্তমানে দু'জনেই মারা গিয়েছেন। দু'জনেরই সমাধিক্ষেত্র রয়েছে মন্দিরে। কিন্তু অসুর-দুর্গার লড়াই বন্ধ হয়নি। এখন শ'য়ে শ'য়ে ভক্তকুল আসে এবং সিংরাই মারান্ডির দেখানো পথেই নবমীতে নারী-পুরুষের লড়াই বাঁধে মন্দির চত্বরে। সেই লড়াই কোনও প্রতীকী লড়াই নয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে রীতিমতো চুলোচুলি, মারামারি লেগে যায় মন্দির চত্বরে।
সিংরাই মারান্ডির মেয়ে পার্বতী মারান্ডি বলেন, "নারীদের মধ্যে যখন ভর চলে আসে তখনই তাঁরা নিজেদের স্বামীদের মারতে শুরু করেন। পাল্টা মারামারি করেন স্বামীরাও। এই রীতি নবমীতে হয়ে আসছে বহু বছর ধরে। যদিও শেষ পর্যন্ত মেয়েরাই জেতে এই লড়াইয়ে।"
কিন্তু কেন এই লড়াই? এর মাধ্যমে কী বার্তা যায় সমাজে?
মন্দিরের বর্তমান ধর্মগুরু শ্যামাপদ মুর্মু জানান, সমাজ থেকে অসুর শক্তি বিনাশ হয়ে নারী শক্তির জয় হোক এমনই বার্তা দিতে চেয়েছিলেন সিংরাই বাবা। আর সেই বার্তাতেই এখনও পর্যন্ত সেই নারী-পুরুষের লড়াই হয়। যদিও সব পুরুষ অসুর হয় না। কিন্তু যে সমস্ত পুরুষেরা আসুরিক শক্তি নিয়ে নারীদের উপর অত্যাচার করে। আমরা সেই আসুরিক শক্তির বিনাশ চাই। পাশাপাশি সাঁওতাল সমাজের উপর নেমে আসা সমস্ত অশুভ শক্তি যাতে ধ্বংস হোক তেমনটাই আমরা এই যুদ্ধের, এই লড়াইয়ের মাধ্যমে চাই।" এই পুজোয় শুধু আসানসোল নয়, জঙ্গলমহলের বিভিন্ন জেলা এমনকী ঝাড়খণ্ড, বিহার, ওড়িশা থেকেও আদিবাসী ভক্তগণ ভিড় জমায়।