সন্দেশখালি, 8 মার্চ: সন্দেশখালি... নারকীয় ঘটনায় যা সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে এখন আলোচিত ৷ চলতি বছর যা প্রকাশ্যে এলেও অত্যাচারের বয়স এক যুগ ৷ হকের টাকা কিংবা জমি কেড়ে নেওয়াই নয়, নিপীড়নের অন্যতম হাতিয়ার ছিল যৌন হেনস্থাও ৷ সন্দেশখালির মহিলারা বলছেন, ‘নারীত্ব’ ছিল তৃণমূল নেতাদের আমোদের বস্তু ৷ শাসকের ভোগপণ্যে পরিনত হয়েছিলেন তাঁরা ৷ তিলোত্তমার আধুনিকতা থেকে মাত্র 75 কিলোমিটার দূরের সন্দেশখালিতে গত বছরও নারী দিবস ছিল বাতুলতা ৷
গত দু’মাসে ছবিটা বদলেছে ৷ যার নেতৃত্বে অবাধ যৌনাচার চলত, সেই শেখ শাহজাহান সিবিআইয়ের জালে ৷ গ্রেফতার হয়েছে শিবু-উত্তমও ৷ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে সরাসরি জানানো হয়েছে অত্যাচারের কথা। আশ্বাসবাণী মিলেছে দেশের প্রশাসনিক প্রধানের তরফে ৷ ফলে খানিক স্বস্তিতে গ্রামের মহিলারা ৷ যে পাঁচজনের থেকে ঘটনার বর্ণনা শুনেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি, তাদেরই একজনের সঙ্গে কথা বলল ইটিভি ভারত ৷
নারী দিবসে সন্দেশখালি, সন্দেশখালির নারী দিবস...
সময়টা গতবছরের মার্চ ৷ আলাদা করে নারী দিবস নিয়ে ভাবার উপায় ছিল না ৷ শুধু গত বছরই না, একযুগ ধরে 8 মার্চও ছিল বাকি দিনগুলির মতোই যন্ত্রণার, কষ্টের, বেদনার, অত্যাচারের ৷ আজ ছবিটা খানিক বদলেছে ৷ যদিও গ্রামে এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে শেখ শাহজাহানের অনুগামীরা ৷ এতদিন যারা অত্যাচার চালিয়েছে, যাদের লাম্পট্যের হিল্লোলস্রোত বয়েছে গ্রামে, তারা এখনও সেখানেই রয়েছে, ভয় দেখাচ্ছে ৷ ফলে সেই অত্যাচার আবার ফিরবে কি না, সেই ভয় এখনও তাড়া করছে সন্দেশখালিকে ৷
ওই মহিলা বলছেন, প্রাথমিক জয় এসেছে ৷ ফলে যাবতীয় ভয় সত্ত্বেও 12 বছর পর এবারের ‘নারী দিবস’ খানিকটা হলেও অন্যরকম ৷ এখনও ভয় না-কাটলেও খানিক হাসি ফিরেছে মুখে ৷ ফলে নিজেদের উদযাপন করবেন তাঁরা ৷ উদযাপন করবেন, তাঁদের হার না-মানা লড়াই, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর সংকল্পকে ৷
নরকযন্ত্রণার অভিজ্ঞতা...
সন্দেশখালির সেই বীরাঙ্গনার কথায়, 34 বছরের বামফ্রন্ট সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল তৃণমূল ৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের ক্ষমতায়ণের প্রায় সমান্তরালেই উত্থান ‘তৃণমূল নেতা’ শেখ শাহজাহানের ৷ একই সঙ্গে গোড়াপত্তন পৈশাচিক অত্যাচারের ৷ কোনও ব্যকরণেই যার নিঁখুত বর্ণনা সম্ভব নয় ৷ তাঁর অভিযোগ, তৃণমূল নেতা শাহজাহানের দুই শাগরেদ শিবু-উত্তমের তরফে আসত ‘কুপ্রস্তাব’ ৷ শাসকদলের দুই ‘স্তম্ভে’র ইশারায় না-চললে সইতে হত অকথ্য অত্যাচার ৷ শাসক হওয়ার সুবাদে হাতের মুঠোয় প্রশাসন ৷ ফলে প্রাথমিক চাহিদা (রেশন, অন্যান্য সরকারি সুবিধা) বন্ধ করে দেওয়া তো বটেই, শিবুদের প্রস্তাব ফেরানোর ফল হত আরও মারাত্মক ৷ 12 বছর ধরে প্রতিনিয়ত যা সইতে সইতে দেওয়ালে পিঠ থেকে গিয়েছিল সন্দেশখালির ৷
কোনও পথ না-পেয়ে 6 মার্চ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার মরিয়া চেষ্টা চালান তাঁরা ৷ শেষ পর্যন্ত দেখা করতে পেরেছেন পাঁচজন ৷ তাদেরই একজনের মুখে উঠে এল সন্দেশখালির বর্তমান চিত্রটা ৷ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই মহিলা বলেন, ‘‘কোনও রাজনৈতিক রঙ নয় ৷ প্রধানমন্ত্রী দেশের অভিভাবক ৷ ফলে তাঁর কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা করছিলাম ৷’’ তাঁকে আটকানোর যাবতীয় প্রচেষ্টা চলেছে বুধবার ভোররাত পর্যন্ত ৷ বাড়ির সামনে পুলিশ, সিভিকরা পালা করে দাঁড়িয়ে ৷ উপায়ান্তর না-দেখে ছাদ টপকে পাশের বাড়ি গিয়ে বসেছেন মোদির জনসভায় যাওয়ার বাসে ৷ পথে বারবার সেই বাস আটকেছে পুলিশ ৷ ফলে নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর জনসভায় পৌঁছেছে বাস ৷ শেষপর্যন্ত অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হয়েছে, মিলেছে আশ্বাসবাণীও ৷
কাট টু মার্চ...
জানুয়ারি মাসে ইডি আধিকারিকদের আক্রমণের পরেই শিরোনামে উঠে আসে সন্দেশখালি ৷ বিরোধী দলগুলি তো বটেই, গণতন্ত্রে চতুর্থ স্তম্ভের আনাগোনা শুরু হয় শাহজাহানের ডেরায় ৷ ফলে খানিক আশার আলো দেখে এক যুগ ধরে যে যন্ত্রণা ভোগ করেছেন, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নামেন মহিলারা ৷ যে সন্দেশখালি শিরোনামে ছিল কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দফতরের আধিকারিকদের হেনস্তা হওয়া বা শাহজাহানের অর্থনৈতিক উত্থানের জন্য, ফেব্রুয়ারি থেকে তাই কার্যত 360 ডিগ্রি ঘুরে যায় ৷ প্রায় গোটা তৃণমূল জমানায় হওয়া এই পৈশাচিক ঘটনায় চমকে ওঠে গোটা দেশ ৷
বিরোধী রাজনৈতিকদলগুলির লাগাতার প্রতিবাদ এবং শাসকদলের সন্দেশখালি প্রসঙ্গে কার্যত নিশ্চুপ থাকা বদলে দেয় ঘটনার আঙ্গিকটাই ৷ বিরোধীদের দাবি, খানিক বাধ্য হয়েই সন্দেশখালির ‘ত্রাস’ বলে পরিচিত শাহজাহানকে গ্রেফতার করে পুলিশ ৷ যদিও যেভাবে দোর্দণ্ডপ্রতাপ তৃণমূল নেতাকে ‘গ্রেফতার’ করেছিল রাজ্যের পুলিশ, তা নিয়েও দানা বেঁধেছিল বিতর্ক ৷ একই সঙ্গে, সিবিআই শাহজাহানের হেফাজত চাওয়ায় তা ঠেকাতে রাজ্যের (পড়ুন শাসকদলের) মরিয়া প্রচেষ্টাও চোখে লাগার মতো ৷
শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার হেফাজতেই গিয়েছে শাহজাহান ৷ সুপ্রিম কোর্টে মুখ পুড়েছে রাজ্যের ৷ সামনেই লোকসভা নির্বাচন, দু’বছর পর রাজ্যের মসনদে বসার লড়াই ৷ দু’ক্ষেত্রেই সন্দেশখালিকে হাতিয়ার করেছে বিরোধী দলগুলি ৷ কিন্তু সন্দেশখালির মহিলাদের কী হবে ? একযুগ ধরে যারা অত্যাচারিত হয়েছেন, সর্বস্ব হারিয়েছেন, তাঁদের অবস্থার পরিবর্তন হবে কি না, তার উত্তর দেবে আগামী ৷
আরও পড়ুন: