মালদা, 14 ডিসেম্বর: নিজের মাথার উপর পাকা ছাদ নেই ৷ রয়েছে টিন ও প্লাস্টিকের আচ্ছাদন ৷ বাংলা আবাসের তালিকায় নাম উঠেছিল তাঁর ৷ কিন্তু তিনি জনপ্রতিনিধি৷ নিজের থেকে এলাকার মানুষের কথা তাঁকে আগে চিন্তা করতে হয় ৷ তিনি দেখেছেন, তাঁর থেকেও গরিব যাঁরা, তাঁদের অনেকের নাম আবাস তালিকায় ওঠেনি ৷ সেসব মানুষের কথা চিন্তা করে আবাসের তালিকা থেকে নিজের নাম কাটিয়ে দিয়েছেন মালদার গাজোল পঞ্চায়েত সমিতির সহকারি সভাপতি শিখা মণ্ডল সরকার ৷
যে সময় আবাসের ঘর নিয়ে চারদিকে দুর্নীতির অভিযোগ, বঞ্চিতদের রোষের শিকার হচ্ছেন জনপ্রতিনিধিরা, গরিব মানুষ বিডিও কিংবা জেলাশাসকের কাছে হত্যে দিচ্ছেন, সেই সময় পঞ্চায়েত সমিতির সহকারি সভাপতির সিদ্ধান্তে চমকে উঠেছেন সবাই ৷ তাঁর এই ভাবনাকে কুর্ণিশ জানাচ্ছেন ওই পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি৷ আপ্লুত খোদ সরকারি কর্তাও ৷
গাজোল পঞ্চায়েত সমিতির সহকারি সভাপতি শিখা মণ্ডল সরকারের বাড়ি দেওতলা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রত্যন্ত আমাইতোর গ্রামে ৷ স্বামী জীবনরাম সরকার ক্ষুদ্র চাষি ৷ ভাসুর কাঞ্ছিরাম সরকার ও জা মিলনী সরকারের অবস্থাও খুব খারাপ ৷ নুন আনতে পান্তা ফুরানোর দশা ৷ মাথা গোঁজার ঠাঁই বলতে চারদিকে টিনের দেওয়াল আর মাথায় জং পড়ে যাওয়া টিনের চালা ৷ পলিথিনের নীচে রান্নার কাজ সারেন দুই ভাইয়ের স্ত্রী ৷ এহেন শিখাদেবীর নাম এবারের আবাস তালিকায় উঠেছিল ৷
শিখাদেবী বলছেন, “আমাদের পাকা ঘর নেই ৷ তাই 2017 সালে আবাস যোজনার ঘরের জন্য আবেদন করেছিলাম ৷ সেই সময় এবং সাম্প্রতিক সমীক্ষাতেও আমাদের পরিবারের তিন সদস্যের নাম আবাসের তালিকায় উঠেছে ৷ কিন্তু আমাদের থেকেও অনেক গরিব মানুষ আছেন, যাঁদের মাথার উপর পাকা ছাদ নেই ৷ তাই পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি এবং বিডিওকে লিখিত জানিয়েছি, আমাদের আবাস যোজনার ঘর দেওয়ার প্রয়োজন নেই ৷ আমাদের থেকে যাঁরা গরিব, তাঁদের ঘর দেওয়া হোক ৷ সেটা হলেই আমরা খুশি ৷”
গাজোল পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি মোজাম্মেল হোসেনের বক্তব্য, “এই ঘটনা শুধু গাজোল ব্লক নয়, সারা পশ্চিমবঙ্গেই নজিরবিহীন ৷ সরকারি ঘর পাওয়ার পরেও ফেরত দেওয়া, আমার মনে হয় এটা এই পঞ্চায়েত সমিতির পক্ষেই সম্ভব ৷ শিখাদেবীদের আর্থিক পরিস্থিতি খুব খারাপ ৷ নিজেদের মাথা গোঁজার উপযুক্ত সংস্থানও নেই ৷ তা সত্ত্বেও তিনি নিজের এবং তাঁর পরিবারের আরও দুই সদস্যের নাম আবাসের তালিকা থেকে বাদ দিতে বিডিওকে আবেদন জানিয়েছেন ৷’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘তাঁর এই সিদ্ধান্তকে আমরা স্যালুট জানাচ্ছি ৷ তবে শুধু শিখাদেবীই নন, আমাদের পঞ্চায়েত সমিতির কৃষি কর্মাধ্যক্ষের নামও আবাসের তালিকায় উঠেছিল ৷ তিনিও সরকারি ঘর প্রত্যাখ্যান করেছেন ৷ তাঁকেও অভিনন্দন জানাচ্ছি ৷ আমরা লক্ষ্য করছি, আবাস যোজনার ঘর নিয়ে সারা রাজ্যে রীতিমতো মারামারি চলছে ৷ সেই সময় গাজোল পঞ্চায়েত সমিতির সদস্যরা দারিদ্র সীমার নীচে থাকলেও সরকারি ঘর নিচ্ছেন না ৷ তাদের হ্যাটস অফ ৷”
শিখাদেবীর সিদ্ধান্তে গর্বিত গাজোলের বিডিও সুদীপ্ত বিশ্বাসও ৷ তিনি বলেন, “শিখাদেবীর পরিবারের তিনজন আবাস প্রকল্পের ঘর পেয়েছিলেন ৷ তিনি স্বেচ্ছায় তিনটি ঘরই না-নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ৷ অথচ সার্ভে করে দেখা গিয়েছে, তাঁরা এই ঘর পাওয়ার যোগ্য ৷ তাঁর এই সিদ্ধান্তে আমরা গর্বিত৷ তিনি গত 5 ডিসেম্বর এই সিদ্ধান্ত জানিয়ে আমাদের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন ৷ সম্প্রতি ব্লক লেভেল কমিটির বৈঠকে তাঁর আবেদন মেনে তাঁদের নামে থাকা তিনটি ঘর চূড়ান্তভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে ৷ তাঁর এই সিদ্ধান্ত গাজোল তো বটেই, গোটা রাজ্যেই একটা দৃষ্টান্ত ৷”