বর্ধমান, 11 ফেব্রুয়ারি: ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের অংশ হিসেবে গান্ধিজির অন্যতম অহিংস হাতিয়ার ছিল বিদেশি বস্ত্র ত্যাগ এবং মোটা খাদি বস্ত্রকে গ্রহণ করা ৷ তিনি নিজে চরকায় সুতো বুনে খাদির বস্ত্র তৈরি ও পরিধানে দেশবাসীকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন ৷ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে গান্ধিজির অন্যতম হাতিয়ার সেই খাদি শিল্প থেকেই ধীরে-ধীরে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের শিল্পীরা ৷ কিন্তু, কেন ?
রাজ্য সরকার যেখানে দাবি করছে পশ্চিমবঙ্গের খাদি শিল্পকে তারা বিশ্বের মানচিত্রে তুলে ধরার চেষ্টা করছে ৷ বিদেশের মেলাতে পৌঁছে যাচ্ছে এই রাজ্যের শিল্পীদের তৈরি খাদির দ্রব্য ৷ সেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিল্পীদের বর্তমান প্রজন্ম খাদি শিল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন ৷ তাঁরা ভিন রাজ্যে চলে যাচ্ছেন নতুন কাজের আশায় ৷ শুধু তাই নয়, শিল্পীদের অনেকেই চাইছেন না যে তাঁদের ছেলে-মেয়েরা এই পেশার সঙ্গে যুক্ত হোক ৷ এমনটাই জানাচ্ছেন রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বর্ধমান শহরে সরকার আয়োজিত খাদি শিল্প মেলায় আসা শিল্পীরা ৷
শিল্পীদের মতে, বাইরের রাজ্যে খাদি পোশাক ও সামগ্রীর চাহিদা অনেক বেশি ৷ সেই তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে খাদির পোশাক এবং সামগ্রীর চাহিদা খুবই কম ৷ তবে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে এই রাজ্যে খাদির চাহিদা আগের তুলনায় বেড়েছে ৷ তবে, তা-ও খুবই সামান্য ৷ এর পাশাপাশি অভিযোগ উঠছে, রাজ্য সরকার বিভিন্ন প্রকল্প তথা শিল্পের উন্নতিতে খরচ করছে, সেই তুলনায় খাদি শিল্পে কোনও খরচই রাজ্য সরকার করে না ৷ কেবলমাত্র বিভিন্ন খাদি বস্ত্র শিল্প মেলার আয়োজন করা ছাড়া ৷
কিন্তু, খাদির পোশাক ও সামগ্রী তৈরির ক্ষেত্রে সুতো ও কাপড়ের দাম অনেকটাই বেড়েছে ৷ সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে কারিগরদের মজুরি ৷ খাদির একটি কাপড় বুনতে যেখানে প্রায় মাসখানেক সময় লেগে যায়, তুলনায় সেই দীর্ঘ শ্রমের দাম মেলে না-বলে অভিযোগ শিল্পীদের একাংশের ৷ এই পরিস্থিতিতে বর্তমান খাদি শিল্পীরা চাইছেন না, তাঁদের উত্তরসূরীরা এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হোক ৷ তবুও, কিছু ক্ষেত্রে হাতেগোনা কয়েকজন পূর্বপুরুষের এই খাদি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন ৷ তবুও, তাঁদের বাবা-মায়েরা চাইছেন না যে সন্তানরা এই শিল্পে যোগ দিক ৷
হুগলি, উত্তর 24 পরগনা-সহ বিভিন্ন জেলা থেকে বর্ধমান শহরে চলা খাদি মেলায় নিজেদের পসরা নিয়ে এসেছেন শিল্পীরা ৷ তাঁদের মধ্যে একজন হুগলির পোলবা ব্লকের বাসিন্দা মাজহারা বেগম ৷ তিনি বলেন, "ব্যবসার অবস্থা ভালো নয় ৷ আমাদের নেহাত কাজ না-করলে চলবে না, তাই ব্যবসা করতে হচ্ছে ৷ সুতোর দাম অনেকগুণ বেড়ে গিয়েছে ৷ এছাড়া এখন অনেকেই কম দামের সুতো ও কাপড় দিয়ে জিনিস তৈরি করছে ৷ যেহেতু দাম অনেক কম, তাই ক্রেতারা সেগুলোই কিনছেন ৷ যেমন একটা বেড কভার হাতে সেলাই করতে প্রায় একমাস সময় লাগে ৷ এবার একটা জিনিস তৈরি করার পর, বিক্রি করেও দাম পাচ্ছি না ৷"
কিছুটা হতাশই শোনাল তাঁকে ৷ মাজহারা বেগম বলেন, "উপায় নেই, বসে থাকলে চলবে না ৷ সরকারি সাহায্য সেভাবে পাই না ৷ এ দিকে মেলাতে যেতেও হবে ৷ গাড়ি ভাড়া করে মাল পাঠানো-সহ সমস্ত খরচ আমাদের বহন করতে হয় ৷ আবার মেলাতে গিয়েও সেভাবে বাজার মেলে না ৷ কিন্তু, না-গেলেও চলবে না ৷ কারণ, আগের মতো চিঠি দিলেই যে মেলা মিলবে, তা নয় ৷ সরকার তাদের পছন্দ মতো মেলাতে পাঠাবে ৷"
উত্তর 24 পরগনার খাদি ব্যবসায়ী অনুপ দালালের কথায়, "বাইরের রাজ্য খাদির চাহিদা অনেক বেশি ৷ আগে তো খাদি বলে রাজ্যের সাধারণ মানুষ কিছু জানতো না ৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারে আসার পরে এই রাজ্যে খাদির চাহিদা বেড়েছে ৷ নতুন প্রজন্মও সেভাবে আসতে চাইছে না ৷ কারণ, পরিশ্রম করার পরে সেভাবে আয় হচ্ছে না ৷ তাই তাঁরা অন্য লাইনে কাজ করতে চলে যাচ্ছেন ৷ যাঁরা অন্য কিছু করতে পারছেন না, তাঁরা এই শিল্পেই কাজ করছেন ৷"
হুগলির বাবনান এলাকার শিল্পী শেখ বাবর আলি বলেন, "ব্যবসার অবস্থা খুব ভালো নয় ৷ টুকটাক ব্যবসা হচ্ছে ৷ মেলাগুলোতে কোথাও ভালো হচ্ছে, কোথাও ভালো নয় ৷ তৈরির খরচ অনেক গুণ বেড়ে গিয়েছে ৷ লেবার খরচ বেড়েছে ৷ আগে যে বেড-কভার শুধুমাত্র সেলাইয়ের মজুরি লাগতো দুশো টাকা, এখন সেটা তিনশো টাকা লাগছে ৷ একটা বেড-কভার বানাতেই খরচ পড়ে যাচ্ছে প্রায় আটশো টাকা ৷ সেটা বিক্রি করছি হাজার টাকা দিয়ে ৷ আবার কম্পিটিশনের জন্য সেটা সাড়ে আটশো ন’শো টাকাতেও বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি ৷ অথচ, যাঁরা কম দামের কাপড় ও সুতো ব্যবহার করছে, তাঁরা আটশো টাকায় বিক্রি করে ৷ ফলে আমরা তাদের সঙ্গে ব্যবসার লড়াইয়ে টিকে থাকতে সমস্যায় পড়ছি ৷ আমরা ভালো জিনিস বিক্রি করি বলে দাম সেভাবে কমাতে পারি না ৷ সরকার যে হারে অন্য বিষয়ে খরচ করে, সেই তুলনায় আমরা কিছুই পাই না ৷ নতুন প্রজন্মের কাছে অন্য বিকল্প কাজ না-থাকায়, কেউ-কেউ এই কাজ করছে ৷ যাঁরা সুযোগ পাচ্ছেন অন্য পেশায়, তাঁরা ভিন রাজ্যে চলে যাচ্ছেন ৷"
![Bengal Khadi Industry](https://etvbharatimages.akamaized.net/etvbharat/prod-images/11-02-2025/wb-bwn-01-spl-burdwankhadiproblem-7204528_11022025121619_1102f_1739256379_293.jpg)
হুগলির জেলার পোলবা ব্লকের আরেক খাদি শিল্পী মহম্মদ মুস্তাফির ৷ তিনি বলছেন, "ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ ৷ বেড সিট, গামছা, শাড়ি, চুড়িদার, টেবিল ক্লথ সবই হাতের কাজ ৷ একটা জিনিস তৈরি করতে যেভাবে পরিশ্রম করতে হচ্ছে, কাঁচামালের দাম বাড়ছে, সেই হারে লাভের টাকা উঠছে না ৷"
তবে, মুস্তাফি মনে করেন পশ্চিমবঙ্গে খাদির চাহিদা আছে ৷ ঠিক যেমনটা বাইরের রাজ্যে ৷ কিন্তু, সমস্যাটা অন্যত্র বলে মনে করেন তিনি ৷ এই খাদি শিল্পীর মতে, "ভিন রাজ্যের মতো এরাজ্যেও খাদির চাহিদা আছে ৷ কিন্তু, নতুন প্রজন্ম এই পেশায় আসতে চাইছে না ৷ আমার দু’টো ছেলে ভিন রাজ্যে কাজে চলে গিয়েছে ৷ গ্রামের অবস্থাও সেই এক ৷ যাঁরা কাজ করত, তাঁঁরাই করেন ৷ নতুন ছেলেরা কাজ করতে চাইছে না ৷ আসলে আমরা বাবা-মায়েরাই চাইছি না, ছেলেরা এই কাজ করুক ৷ যে হারে পরিশ্রম করতে হচ্ছে, সেই পরিশ্রমের দাম মিলছে না ৷ সরকারি সাহায্য তো সেভাবে কিছু পাওয়া যায় না ৷ অবস্থা খুব একটা ভালো নয় ৷"
খাদি শিল্পীদের এই অভিযোগ সম্পর্কে জানতে ইটিভি ভারত যোগাযোগ করেছিল রাজ্যের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প মন্ত্রী স্বপন দেবনাথের সঙ্গে ৷ তবে, সেই অভিযোগকে কিছুটা লঘু করেই যেন দেখছেন মন্ত্রী ৷ বরং রাজ্য সরকার খাদি শিল্পের উন্নতিতে সবরকম কাজ করছেন বলেই দাবি করলেন তিনি ৷ স্বপন দেবনাথের বক্তব্য, "কিছুদিন আগে ইতালির রোমে হস্তশিল্প মেলাতে পশ্চিমবঙ্গের খাদি শিল্প অংশ নেয় ৷ রাজ্যের খাদি শিল্পকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে উদ্যোগ নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ এছাড়া, রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে মেলাগুলির মাধ্যমে শিল্পীরা সরাসরি ক্রেতার কাছে তাঁদের তৈরি পণ্য ও সামগ্রী বিক্রি করতে পারেন, সেই ব্যবস্থাও করা হয় ৷ এর পাশাপাশি, খাদি শিল্পকে ঢেলে সাজানোর জন্য রাজ্য সরকার একাধিক পরিকল্পনা নিয়েছে ৷"
![Bengal Khadi Industry](https://etvbharatimages.akamaized.net/etvbharat/prod-images/11-02-2025/wb-bwn-01-spl-burdwankhadiproblem-7204528_11022025121619_1102f_1739256379_532.jpg)
তিনি জানিয়েছেন, খাদি শিল্পের একাধিক ক্লাস্টার তৈরি করেছে রাজ্য সরকার ৷ সেখানে এক ছাতার তলায় বিভিন্ন শিল্পীদের নিয়ে আসা হচ্ছে ৷ সেই ক্লাস্টারগুলিতে সুতো, কাপড়-সহ সমস্তরকম কাঁচামালের জোগানও রাজ্য সরকার দিচ্ছে বলে দাবি মন্ত্রীর ৷ সেখানে শিল্পীরা মজুরির ভিত্তিতে কাজ করছেন ৷ কিন্তু, সেখানেও সঠিক মজুরি না-পাওয়ার অভিযোগ উঠেছে একাংশ শিল্পীর তরফে ৷
উল্লেখ্য, কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে খাদি শিল্পে উৎসাহ প্রদান করা হচ্ছে ৷ কেন্দ্রের আত্মনির্ভর ভারত গড়ে তোলার লক্ষ্যে খাদি শিল্পকে ভিত্তি হিসেবে মন্তব্য করেছিলেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ৷ খাদির প্রচারে সরকারের বিজ্ঞাপনও তৈরি করা হয়েছে ৷ এমনকি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তার প্রভাবও পড়েছে ৷ সেখানেই এরাজ্য খাদি শিল্পের প্রসারে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ার অভিযোগ, অবশ্যই চিন্তার কারণ ৷