ঝাড়গ্রাম, 23 মে: একটা সময়ে লাল দুর্গ হিসেবে পরিচিত ছিল জঙ্গলমহল ঝাড়গ্রাম । 2009 সালের লোকসভা নির্বাচনে সিপিআইএম প্রার্থী পুলিনবিহারী বাস্কে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন । তবে 2011 সালের বিধানসভা ভোটে সেখানে ফোটে ঘাসফুল ৷ এরপর 2014 সালের লোকসভা নির্বাচনে ইতিহাস গড়ে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী উমা সরেন সিপিআইএম প্রার্থী পুলিনবিহারী বাস্কেকে প্রায় সাড়ে তিন লাখ ভোটের ব্যবধানে হারান ৷ তবে 2019 সালের লোকসভা নির্বাচনে ঝাড়গ্রাম উপর দিয়ে বয়ে যায় মোদি-ঝড় । মাত্র 11 হাজার ভোটের ব্যবধানে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী বীরবাহা সরেন টুডুকে পরাজিত করেন বিজেপি প্রার্থী কুনার হেমব্রম । দেখাই যাচ্ছে যে, ঝাড়গ্রাম লোকসভা কেন্দ্রে গত তিনটি লোকসভা নির্বাচনে তিন রকম ফলাফল হয়েছে । এ বার 2024 সালে ঝাড়গ্রামের কুর্সি কার দখলে যাবে তারই তত্ত্বতালাশ করল ইটিভি ভারত ৷
ঝাড়গ্রাম লোকসভায় মূলত লড়াই তৃণমূল, বিজেপি ও সিপিআইএম-এর মধ্যে ৷ তবে এ বারের নির্বাচনে এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর কুড়মি ভোট । জাতিসত্ত্বার স্বীকৃতির দাবিতে রাজ্য এবং কেন্দ্রের বিরুদ্ধে একের পর এক আন্দোলনে নামতে দেখা গিয়েছে কুড়মিদের। কোনও রাজনৈতিক দল তাঁদের গুরুত্ব না-দেওয়ায় পঞ্চায়েত নির্বাচনে নির্দল প্রার্থী হয়ে লড়াই করেছে কুড়মি সম্প্রদায়ের মানুষ । ফলাফলও ভালো হয় । তাই কুড়মিরা কোনও রাজনৈতিক দলের উপর ভরসা না-করে নিজেদের জাতিসত্ত্বার অধিকার আদায়ে দিল্লিতে নিজেদের প্রতিনিধি পাঠাতে মরিয়া। ঝাড়গ্রাম লোকসভা কেন্দ্রে নির্দল হিসেবে লড়াই করছেন কুড়মিরা । যদিও কুড়মিদের দুটি গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে পৃথক দুটি প্রার্থী দেওয়া হয়েছে।
2019 সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের দিকে তাকালে একটা জিনিস পরিষ্কার । তৃণমূলকে হারালেও বিজেপির জয়ের ব্যবধান খুবই সামান্য । ভোটদান করেছিলেন মোট 14,07,213 জন । তার মধ্যে বিজেপি প্রার্থী কুনার হেমব্রম 6,26,583 ভোট পান, তৃণমূল প্রার্থী বীরবাহা সরেন টুডু পান 6,14,816 ভোট ৷ সিপিআইএম প্রার্থী দেবলীনা হেমব্রম পান 75,680টি ভোট, কংগ্রেস পায় মাত্র 20,754টি ভোট ৷ এছাড়াও নোটায় 17,692টি ভোট পড়ে । শতাংশের বিচারে বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের হার এক ধাক্কায় 34.83% বেড়ে যায় এবং তৃণমূলের ভোট 10.88% কমে যায় । সিপিআইএমের 21.12% ভোট কমে । বিজেপি প্রার্থী কুনার হেমব্রম মাত্র 11,767 ভোটে জয়লাভ করেন । ফলে বোঝাই যাচ্ছে, সিপিআইএম এবং তৃণমূলের কিছু ভোট গিয়েছে বিজেপির ঝুলিতে।
2021 সালের বিধানসভা নির্বাচনে বদলে যায় সমীকরণ । ঝাড়গ্রাম লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত সাতটি বিধানসভায় জয়লাভ করে তৃণমূল কংগ্রেস । ঝাড়গ্রাম জেলার ঝাড়গ্রাম, বিনপুর, গোপীবল্লভপুর, নয়াগ্রাম চারটি বিধানসভা, পুরুলিয়া জেলার বান্দোয়ান বিধানসভা এবং পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গড়বেতা ও শালবনি বিধানসভা ঝাড়গ্রাম লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত। এই সাতটি বিধানসভাতেই ভালো ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করে তৃণমূল । দ্বিতীয় স্থানে থাকে বিজেপি। কিন্তু এ বারের লোকসভা নির্বাচনে চতুর্মুখী লড়াই হতে চলেছে ঝাড়গ্রাম লোকসভা কেন্দ্রে। তৃণমূল ও বিজেপির ভাগ্য নির্ধারণের চাবিকাঠি কুড়মি ও সিপিআইএমের কাছে রয়েছে বলে দাবি রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ।
2019 সালে বিজেপির ঘরে গিয়েছিল সিপিআইএমের প্রায় 21 শতাংশ ভোট। তবে সিপিআইএম 2021 বিধানসভা এবং 2023 পঞ্চায়েত নির্বাচনে যথেষ্ট ভোট নিজের ঘরে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে । সিপিআইএম প্রার্থী সোনামণি টুডু ৷ সোনামণির বাড়ি বান্দোয়ান বিধানসভার অন্তর্গত । সোনামণি ঝাড়খণ্ডের মেয়ে হলেও বিবাহসূত্রে তিনি বর্তমানে বান্দোয়ানের বাসিন্দা। ছোট থেকেই সোনামণি সমাজ কল্যাণমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত । ঝাড়খণ্ডেও গ্রামসভার নির্বাচনে এবং ছাত্র জীবনে ছাত্র রাজনীতিতে লড়াই করেও জয়লাভের রেকর্ড আছে তাঁর। প্রার্থী হওয়ার পর থেকেই জোরকদমে নির্বাচনী প্রচার করতে দেখা গিয়েছে সোনামণিকে। বামেদের দৃঢ় বিশ্বাস, তাঁদের হারিয়ে যাওয়া ভোট সোনামণির হাত ধরেই এই লোকসভা নির্বাচনে ফিরে আসবে ।
সোনামণির কথায়, "রাজ্য সরকারের লাগামহীন দুর্নীতি এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি এই দুই বিষয়কে সামনে রেখেই নির্বাচনী প্রচার করা হচ্ছে । মানুষের কাছে আজ জলের মতো পরিষ্কার যে, বামফ্রন্ট ছাড়া অন্য কিছু বিকল্প নেই ৷" সোনামণির দৃঢ় বিশ্বাস, তিনি ঝাড়গ্রামে লাল দুর্গ পুনরুদ্ধার করবেন । বিজেপির পকেট থেকে বামেদের ভোট বামেদের হাতে ফিরে গেলে বড় ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে বিজেপিকে।
অপরদিকে, এই আসনে কুড়মিদের পৃথক দুটি সংগঠনের পক্ষ থেকে দু'জনকে প্রার্থী করা হয়েছে । আদিবাসী নাগাচারি কুড়মি সমাজের নদিয়া জেলার বাসিন্দা বরুণ মাহাতোকে প্রার্থী হয়েছেন । পুরুলিয়ার সর্ববৃহৎ কুড়মি সংগঠন আদিবাসী কুড়মি সমাজ ঝাড়খণ্ড রাজ্যের ঘাটশিলার প্রাক্তন বিধায়ক তথা ঝাড়খণ্ড পিপিলস পার্টির নেতা সূর্য সিং বেসরাকে প্রার্থী করেছে । 'আমার ভোট আমার থাক' এই স্লোগানকে সামনে রেখেই এই নির্বাচনে লড়াই করছেন কুড়মিরা । ফলে কুড়মি ভোট যদি কুড়মি প্রার্থীদের কাছেই থেকে যায়, তাহলে সমস্ত রাজনৈতিক দলের উপরই তার প্রভাব পড়বে ।
যদিও তৃণমূল ও বিজেপি তা মানতে নারাজ । তাদের দাবি, কুড়মিরা জাতিসত্ত্বার জন্য লড়াই করছে । তাদের ভোটে তেমন একটা প্রভাব পড়বে না। এই আসনে সাঁওতালি সাহিত্যিক, পদ্মশ্রী ও বঙ্গবিভূষণ পুরস্কারের সম্মানিত কালীপদ সরেনকে (খেরওয়াল) প্রার্থী করেছে তৃণমূল কংগ্রেস । কালীপদ সরেনের সমর্থনে গোপীবল্লভপুর বিধানসভার অন্তর্গত গজাশিমূলে জনসভা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং নয়াগ্রাম বিধানসভার অন্তর্গত ছাচিনাশোলে জনসভা করেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় । দুই সভাতেই ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো । রাজ্য সরকারের লক্ষ্মীর ভান্ডার, স্বাস্থ্যসাথী, খাদ্যসাথীর মতো প্রকল্পগুলিকে সামনে রেখে বুথ স্তরের কর্মী থেকে শুরু করে জেলা স্তরের নেতৃত্ব সকলেই প্রচারে নেমেছেন ।
কালীপদ সরেন বলেন, "রাজ্য সরকার এখানে মানুষের জন্য যা উন্নয়ন করেছে তা সকলেই জানে । সুতরাং তৃণমূল কংগ্রেস ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত শক্ত করতে এই আসনে তৃণমূল কংগ্রেসের জয় নিশ্চিত ৷"
অপরদিকে, এই আসনে বিজেপির চিকিৎসক প্রার্থী ডা. প্রণত টুডু । তিনি ঝাড়গ্রাম সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের রেডিয়োলজি বিভাগের চিকিৎসক ছিলেন । বিজেপির প্রার্থী হওয়ার জন্য চাকরি ছেড়েছেন তিনি । প্রার্থী হওয়ার পর থেকেই 2019-এ বিজেপির জেতা এই আসনটিকে রক্ষা করার জন্য দিবারাত্রি লড়াই করে চলেছেন তরুণ চিকিৎসক । গত সোমবার ঝাড়গ্রাম স্টেডিয়ামে তাঁর সমর্থনে জনসভা করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি । মোদির জনসভায় জনপ্লাবনের ছবি ফুটে ওঠে । ঝাড়গ্রাম স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে হেলিপ্যাড গ্রাউন্ড পর্যন্ত গাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রোড শো'র মতো করে যান মোদি । মোদির সফরকে ঘিরে মানুষের উৎসাহ আশা জাগাচ্ছে বিজেপি কর্মী সমর্থকদের ৷ তবে শেষ হাসি কে হাসবেন ? কুর্সি যাবে কার দখলে ? তা জানতে অপেক্ষা আরও কিছুদিনে ৷
আরও পড়ুন: