কলকাতা, 12 মে: চলছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের উৎসব ৷ 13 মে সেই উৎসবের চতুর্থ দফার অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছে দেশের 96টি লোকসভা কেন্দ্র ৷ তার মধ্যে রয়েছে এ রাজ্যের আটটি কেন্দ্র-বহরমপুর, কৃষ্ণনগর, রানাঘাট, বর্ধমান পূর্ব, বর্ধমান–দুর্গাপুর, আসানসোল, বোলপুর এবং বীরভূম ৷ দেশের সাধারণ নির্বাচনের ইতিহাসে ‘শান্ত’ বলেই পরিচিত কেন্দ্রগুলি ৷ ‘অধীর-গড়’ বহরমপুরকে বাদ দিলে গত লোকসভা ভোটে পাঁচটি আসন গিয়েছিল তৃণমূলের ঝুলিতে, বিজেপি পেয়েছিল দু’টি ৷ ফলে আসন সংখ্যা বাড়াতে সদা-সচেষ্ট দু'দলই ৷
2024 সালের এই নির্বাচন হচ্ছে সাত দফায় ৷ লোকসভা ভোট শেষ হবে 1 জুন ৷ ভোটগণনা 4 জুন ৷ রাজ্যে তৃণমূলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপি ৷ গত লোকসভা নির্বাচনে 18টি আসন জিতেছিল গেরুয়া শিবির ৷ উত্তরবঙ্গ উজার করে পদ্মশিবিরের ভোটবাক্স ভরিয়েছিল ৷ ফলে বঙ্গে আরও জোরালোভাবে দাঁত ফোটাতে উত্তরবঙ্গের পাশাপাশি বাকি আসনেও নজর দিয়েছে বিজেপি ৷
বহরমপুর:
নিজের রাজনৈতিক জীবনে আরও একবার পরীক্ষায় বসতে চলেছেন কংগ্রেসের 'বেতাজ বাদশা' অধীররঞ্জন চৌধুরী ৷ 1999 লোকসভা ভোটে এই কেন্দ্রের তিন-তিনবারের আরএসপি সাংসদ প্রমথেশ মুখোপাধ্যায়কে পরাজিত করেছিলেন ৷ তারপর থেকে বহরমপুরে অধীর চৌধুরী জয়ী হবেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি ৷ বরং প্রশ্ন ছিল, কংগ্রেসের পরে দ্বিতীয় স্থানে কোন দল থাকবে ? এবার বিপক্ষে রয়েছেন তৃণমূলের ইউসুফ পাঠান ও বিজেপির ডাঃ নির্মল সাহা ৷ ফলে লড়াইটা এবার খানিক কঠিন ৷
তৃতীয় দফায় মুর্শিদাবাদের অন্য দুই কেন্দ্র জঙ্গিপুর ও মুর্শিদাবাদে নির্বাচন হয়ে গিয়েছে । বিক্ষিপ্ত দু-একটি ঘটনা ছাড়া শান্তিপূর্ণভাবেই মিটেছে নির্বাচন । এই প্রথমবার মুর্শিদাবাদে ভোটের দিন প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি । বহরমপুরের ক্ষেত্রেও একইভাবে ব্যবস্থা নিচ্ছে প্রশাসন । শক্তিপুর, বেলডাঙায় ভোটের আগে অশান্তি ছড়ানোয় বেলডাঙা ও রেজিনগর বিধানসভার উপর বাড়তি নজর রাখা হয়েছে ।
- মোট ভোটার: 17 লক্ষ 83 হাজার 78
- পুরুষ ভোটার: 9 লক্ষ 6 হাজার 760
- মহিলা ভোটার: 8 লক্ষ 76 হাজার 275
- তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার: 45 জন
- 85 বছরের উর্ধ্বে ভোটারের সংখ্যা: 9557 জন
- পোল বুথের সংখ্যা: 1870টি
- স্পর্শকাতর বুথ সংখ্যা: 558টি
- নিরাপত্তা: মোতায়েন থাকবে 75 কোম্পানি সিএপিএফ, থাকবে 3572 জন রাজ্য পুলিশ
কৃষ্ণনগর:
পশ্চিমবঙ্গের 42টি লোকসভা আসনের মধ্যে যে ক’টি আসনে হাইভোল্টেজ লড়াই চলছে, তার মধ্যে অন্যতম কৃষ্ণনগর ৷ সেই লড়াইয়ের একদিকে তৃণমূল কংগ্রেসের মহুয়া মৈত্র ৷ অন্যদিকে বিজেপির অমৃতা রায় ৷ আর রয়েছেন সিপিএম প্রার্থী এসএম সাদি ৷ গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির কল্যাণ চৌবে ভালো লড়াই দিয়েছিলেন ৷ তার উপর কয়েক মাস আগে ঘুষ নিয়ে সংসদে প্রশ্ন করার অভিযোগ উঠেছে মহুয়ার বিরুদ্ধে ৷ লোকসভার এথিক্স কমিটির সুপারিশে তাঁকে সংসদ থেকে বহিষ্কার পর্যন্ত করা হয়েছে ৷ এখনও সিবিআই তদন্ত চলছে ওই ঘটনা নিয়ে ৷ যদিও এই ঘটনা যে তাঁকে ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছে, মানতে নারাজ তৃণমূল সাংসদ ৷
- মোট ভোটার: 17 লক্ষ 54 হাজার 377 জন।
- পুরুষ ভোটার: 9 লক্ষ 6 হাজার 125
- মহিলা ভোটার: 8 লক্ষ 48 হাজার 226
- তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার: 26
- পোল বুথের সংখ্যা: 1841টি
- স্পর্শকাতর বুথ সংখ্যা: 338টি
রানাঘাট:
রানাঘাট লোকসভা কেন্দ্র নিয়েও রাজনৈতিক মহলে তুমুল চর্চা চলছে। অতীতে এই আসনে তৃণমূলের দাপট দেখা গেলেও গতবার পরিস্থিতি বদলায়। বিজেপি প্রার্থী জগন্নাথ সরকার সাংসদ নির্বাচিত হন। তৃণমূলের রূপালী বিশ্বাসকে পরাজিত করেন জগন্নাথ। শাসক শিবিরের প্রার্থীর স্বামী সত্যজিৎ বিশ্বাস ছিলেন তৃণমূলের বিধায়ক । 2019 সালের লোকসভা নির্বাচনের অল্প কিছুদিন আগে তাঁকে খুন করা হয়। এরপরই রুপালী প্রার্থী করে তৃণমূল। তবে তাতে কাজের কাজ হয়নি। এবারও জগন্নাথেই আস্থা রেখেছে বিজেপি। প্রার্থী বদলেছে তৃণমূল। তাদের প্রার্থী একদা গেরুয়া শিবিরের বিধায়ক মুকুটমণি অধিকারী। একেবারে শেষ মুহূর্তে মুকুটমণির স্ত্রীকে দলে নিয়ে লড়াই আরও জমিয়ে দিয়েছে বিজেপি।
- মোট ভোটার: 18 লক্ষ 71 হাজার 910 জন।
- পুরুষ ভোটার: 9 লক্ষ 59 হাজার 364 জন
- মহিলা ভোটার: 9 লক্ষ 12 হাজার 486 জন
- তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার: 60
- পোল বুথের সংখ্যা: 1983টি
- স্পর্শকাতর বুথ সংখ্যা: 410টি
একনজরে বর্ধমান-দুর্গাপুর:
একদা লাল দুর্গে এখন পদ্মফুলের রমরমা ৷ প্রচারে পিছিয়ে নেই তৃণমূলও ৷ আবার পুরনো লাল রং ফেরাতে দায়বদ্ধ সিপিএম ৷ এখানে প্রার্থীর ভাগ্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ কৃষক ও শ্রমিক- দুই শ্রেণির ভোটার ৷ এবার এই কেন্দ্রের অন্যতম হেভিওয়েট প্রার্থী বিজেপির দিলীপ ঘোষ ৷ বিজেপির প্রাক্তন এই রাজ্য সভাপতির নেতৃত্ব রাজ্যে প্রধান বিরোধী দল হয়ে উঠেছে ভারতীয় জনতা পার্টি ৷ সেই দিলীপ ঘোষ কি কেন্দ্রের শ্রমিক-কৃষক সমীকরণে চাল মাত করবেন ? তৃণমূল এই কেন্দ্রে প্রার্থী করেছে জাতীয় দলের প্রাক্তন ক্রিকেটার কীর্তি আজাদকে ৷ তাঁর একটা পরিচয় 1983 সালের বিশ্বকাপ জয়ী ভারতীয় অলরাউন্ডার ৷ এছাড়া তাঁর অন্য পরিচয় তিনি প্রাক্তন কংগ্রেস সাংসদ ৷ 2014 সালের লোকসভা ভোটে বিহারের দ্বারভাঙা থেকে কংগ্রেসের টিকিটে জয়ী হন ৷
- মোট ভোটার: 13 লক্ষ 8 হাজার 672 জন
- পুরুষ ভোটার: 6 লক্ষ 54 হাজার 929 জন
- মহিলা ভোটার: 6 লক্ষ 53 হাজার 718 জন
- তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার: 25 জন
- পোল বুথের সংখ্যা: 1442টি
একনজরে বর্ধমান পূর্ব:
রাজনৈতিক মহলের মতে, জেলায় এবার দ্বিমুখী লড়াই । 2019 সালে এই আসন থেকে জয়ী হয়ে দ্বিতীয়বারের জন্য সাংসদ হন তৃণমূল কংগ্রেসের সুনীল মণ্ডল । তৃণমূল তাঁকে এবার প্রার্থী করেনি । এবার ড. শর্মিলা সরকারকে প্রার্থী করেছে তৃণমূল কংগ্রেস । বিজেপি প্রার্থী করেছে কবিয়াল বিধায়ক অসীম সরকারকে । সিপিএমের প্রার্থী নীরব খাঁ । রাজনৈতিক মহল বলছে, মূল লড়াই হতে চলেছে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে বিজেপির । তবে সিপিএমের ভোট বড় ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করবে ৷
- মোট ভোটার: 17 লক্ষ 99 হাজার 121 জন
- পুরুষ ভোটার: 9 লক্ষ 12 হাজার 416 জন
- মহিলা ভোটার: 8 লক্ষ 86 হাজার 654 জন
- তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার: 51 জন
- পোল বুথের সংখ্যা: 1942টি
একনজরে আসানসোল :
কয়লা সমৃদ্ধ শিল্পাঞ্চলের লোকসভা আসন আসানসোল ৷ এই আসন এককালে ছিল বামদুর্গ ৷ সেই দুর্গের পতন হয় বিজেপির হাত ধরে ৷ 2019 সালেও বিজেপি এই আসন ধরে রেখেছিল ৷ কিন্তু 2022 সালে উপ-নির্বাচনে তৃণমূলের কাছে হারতে হয় বিজেপিকে ৷ শত্রুঘ্ন সিনহার বিপক্ষে প্রার্থী হয়েছেন বিজেপির সুরিন্দরজিৎ সিং আলুওয়ালিয়া । ফলে আসানসোলে এবার লড়াই জমজমাট ৷ ভোটে নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে কোনও ফাঁকফোঁকড় রাখতে চাইছে না নির্বাচন কমিশন । মোট কেন্দ্রীয়বাহিনী আনা হয়েছে 88 কোম্পানি । মোট রাজ্য পুলিশ মোতায়েন থাকছে 5 হাজার 472 জন ৷
- মোট ভোটার: 17 লক্ষ 70 হাজার 281 জন
- পুরুষ ভোটার: 9 লক্ষ 3 হাজার 406 জন
- মহিলা ভোটার: 8 লক্ষ 66 হাজার 837 জন
- তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার: 38টি
- পোল বুথের সংখ্যা: 1901টি
- স্পর্শকাতর বুথ সংখ্যা: 319টি
একনজরে বোলপুর ও বীরভূম :
গত নির্বাচনে দুটি আসনই গিয়েছিল তৃণমূলের ঝুলিতে ৷ দুই সাংসদকেই এবার ফের টিকিট দিয়েছে রাজ্যের শাসকদল ৷ বোলপুরে অসিত কুমার মাল ও বীরভূমে শতাব্দী রায়ের ক্যারিশ্মাতেই ভোট বৈতরণী পার হওয়ার স্বপ্ন দেখছে জোড়াফুল শিবির ৷ বোলপুরে ‘গৃহবধূ’ পিয়া সাহাকে প্রার্থী করেছে বিজেপি ৷ অন্যদিকে, বীরভূমে ‘প্রার্থী বিভ্রাট’ ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছে পদ্মশিবিরকে ৷ ফলে দুই কেন্দ্রেই খানিক এগিয়ে রয়েছে তৃণমূল ৷
কমিশনের কাছে চ্যালেঞ্জ দুই কেন্দ্রে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন প্রক্রিয়া পরিচালনা করার । এই জেলায় মোট 131 কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে ৷ পাশাপাশি 6 হাজার 172 জন রাজ্য পুলিশের অফিসার ও কর্মী মোতায়েন থাকছে ৷ 94টি নাকা চেকিং পয়েন্ট করা হয়েছে ৷
বোলপুর:
- মোট ভোটার: 18 লক্ষ 39 হাজার 234 জন
- পুরুষ ভোটার: 9 লক্ষ 31 হাজার 74 জন
- মহিলা ভোটার: 9 লক্ষ 8 হাজার 137 জন
- তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার: 23 জন
- পোল বুথের সংখ্যা: 1979টি
- স্পর্শকাতর বুথ সংখ্যা: 659টি
বীরভূম:
- মোট ভোটার: 18 লক্ষ 57 হাজার 22
- পুরুষ ভোটার: 9 লক্ষ 34 হাজার 14 জন
- মহিলা ভোটার: 9 লক্ষ 22 হাজার 989 জন
- তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার: 19 জন
- পোল বুথের সংখ্যা: 1943টি
- স্পর্শকাতর বুথ সংখ্যা: 640টি
আগের তিন দফার মতোই শান্তিপূর্ণ রক্তপাতহীন নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে বদ্ধপরিকর জাতীয় নির্বাচন কমিশন । বর্তমানে রাজ্যে রয়েছে মোট 596 কেন্দ্রীয় বাহিনী ৷ এই সংখ্যার মধ্যে আটটি আসনের নির্বাচনের জন্য মোতায়েন থাকবে 578 কোম্পানি । বাকি কোম্পানি থাকবে স্ট্রং রুমের নিরাপত্তায় এবং বাকি জেলায় । অন্যদিকে চতুর্থ দফায় রাজ্যে পুলিশ থাকছে 33471 জন । চতুর্থ দফায় আসনের সংখ্যা বেশি বলে স্বাভাবিকভাবেই এই দফায় ক্রিটিক্যাল বুথের সংখ্যা অনেকটাই বেড়েছে । সেইমতো বাড়ানো হয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনী ও রাজ্য পুলিশের সংখ্যা । তবে আগের তিন দফার তুলনায় কুইক রেসপন্স টিমের সংখ্যা কমেছে ।
কুইক রেসপন্স টিমের বিন্যাস:
- বীরভূম ও বোলপুর মিলিয়ে 37টি কুইক রেসপন্স টিম
- মুর্শিদাবাদে পুলিশ ডিস্ট্রিক্টে 23টি কুইক রেসপন্স টিম
- কৃষ্ণনগর পুলিশ ডিস্ট্রিক্টে 20টি কুইক রেসপন্স টিম
- রানাঘাটে 12টি কুইক রেসপন্স টিম
- আসানসোল-দুর্গাপুরে 25টি কুইক রেসপন্স টিম
- বর্ধমান পূর্বে 31টি কুইক রেসপন্স টিম
চতুর্থ দফায় কুইক রেসপন্স টিমের সংখ্যা 148 । কমিশনের তরফে জানানো হয়েছে, এই সংখ্যা আরও কিছুটা বাড়তে পারে । কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এই দফায় কোনও শ্যাডো জোন থাকছে না ৷ ফলে 100 শতাংশ বুথেই ওয়েব কাস্টিং করা হবে । পাশাপাশি দফার মোট বুথের প্রায় 23 শতাংশ বুথকেই কমিশন স্পর্শকাতর বুথ হিসাবে চিহ্নিত করেছে ।
আরও পড়ুন: