ETV Bharat / state

তারকা তৈরির বছর ! বাংলাকে ভিলেনও চেনাল 2024 - YEARENDER 2024

বাংলা মানেই খবর ৷ 2024 সালেও অন্যথা হল না ৷ সন্দীপ ঘোষ থেকে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়রা থেকেছেন শিরোনামে ৷ জনমনে কেউ হয়েছেন হিরো, কেউ ভিলেন ৷

YEAR ENDER 2024
2024-এ বাংলার জনমনে কেউ হিরো, কেউ ভিলেন (ইটিভি ভারত)
author img

By ETV Bharat Bangla Team

Published : Dec 26, 2024, 7:16 AM IST

কলকাতা, 26 ডিসেম্বর: 2024 সাল শেষ হতে আর মাত্র কয়েকটা দিন। জীবনানন্দের 'বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি' স্মরণ করে বলাই যায়, এবছর সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেশ কিছু মানুষ বাংলার মুখ হয়ে উঠেছিলেন। কেউ হয়ে উঠেছিলেন জনগণের চোখের মণি, কেউ আবার রয়ে গেলেন সমাজের তির্যক, বাঁকা নজরে।

ইটিভি ভারত এরকম বেশ কিছু মানুষের মধ্যে থেকে বহুলচর্চিত কয়েকজনকে ফিরে দেখছে এখানে। 2024-এর বিদায় বেলায় রইল বাংলার খবরের ঘনঘটার মাঝে থাকা কয়েকটি চেনা মুখ।

1. সন্দীপ ঘোষ- সন্দীপ ঘোষের নাম সবাই জানে। বিখ্যাত নন, কুখ্যাত। তাঁর 'কুকীর্তি' এখন সকলেরই কমবেশি জানা ৷ দিনটা 9 অগস্ট ৷ আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে জুনিয়র চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগ উঠল ৷ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চার তলার সেমিনার হল থেকে উদ্ধার হয় ওই পড়ুয়ার দেহ ৷ তারপর সময় যত এগিয়েছে, ততই ওই হাসপাতালের তৎকালীন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে ঘিরে অভিযোগের পাহাড় জমতে থাকে ৷

কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে মামলার তদন্ত শুরুর পর সিবিআই প্রায় রোজই সন্দীপ ঘোষকে তলব করতে থাকে ৷ ঘটনার 15তম দিনে বিধাননগরের সিজিও কমপ্লেক্সে হাজিরা দিতে গিয়ে গ্রেফতার হন তিনি ৷ নির্যাতিতাকে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার প্রমাণ লোপাটের অভিযোগের পাশাপাশি হাসপাতালের আর্থিক অনিয়মে তাঁর নাম জড়ায়। সেই মামলার তদন্ত করছে সিবিআই ৷

2024-এ জনমনে কেউ হয়েছেন হিরো, কেউ ভিলেন (ইটিভি ভারত)

আদালতে পেশ করার সময় এই হাই প্রোফাইল ডাক্তারকে খেতে হয়েছে থাপ্পড়, জুতোর বাড়ি ৷ পরবর্তী সময়ে তাঁর গ্রেফতারির 90 দিনের মাথায় সিবিআই আদালতে জানায়, আরজি করে ধর্ষণ এবং খুনের মামলায় এই মুহূর্তে সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট দিতে পারছে না তারা। তদন্ত চলছে। তারপরই এই মামলায় জামিন পান আরজি কর হাসপাতলের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ ৷ তবে আর্থিক অনিয়মের মামলায় এখনও জেলেই রয়েছেন সন্দীপ।

2. শেখ শাহজাহান- বছরের শুরুর দিক থেকেই বাংলা তোলপাড় হয় সন্দেশখালির ঘটনায়। বিভিন্ন দুর্নীতির ঘটনায় ইডি, রাজ্যের তাবর নেতা-মন্ত্রী, বিধায়কদের গ্রেফতার করেছে। সামান্য প্রতিবাদ হলেও কোথাও বাধার মুখে পড়েনি ইডি। সেটাই হল সন্দেশখালিতে। রেশন দুর্নীতির তদন্তে 5 জানুয়ারি সন্দেশখালিতে বাধার মুখে পড়ে ইডি। মাথা ফাটে এক আধিকারিকের ৷ আহত হন আরও কয়েকজন। ইডির উপর হামলার ঘটনার পর গা-ঢাকা দিয়েছিলেন শাহজাহান।

পরবর্তী সময়ে বোঝা যায় এই শাহজাহান আসলে সন্দেশখালির 'বেতাজ বাদশা' ৷ তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে জমি-ভেড়ি দখল, মহিলাদের উপর নির্যাতনের একাধিক অভিযোগ ওঠে। গ্রামের মহিলারা লাঠিসোঁটা, মশাল হাতে রাস্তায় নামেন ৷

17 জানুয়ারি সন্দেশখালিতে ইডি আধিকারিকদের উপর হামলার ঘটনার তদন্তে সিট গঠন হয় ৷ উত্তর 24 পরগনার সন্দেশখালির পরিস্থিতি ক্রমশ অবনতির দিকে এগোয় ৷ হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগে কার্যত অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি হয় ৷ শাহজাহান ঘনিষ্ঠ শিবু হাজরা, উত্তম সর্দারদের বিরুদ্ধে অন‍্যায় অত‍্যাচারের অভিযোগ তুলে ক্ষোভে ফুঁসতে থাকেন গ্রামবাসীদের একটি বড় অংশ। কয়েক'টি পঞ্চায়েত নিয়ে এলাকাগুলিতে 144 ধারা জারি হয় ৷

তারপরও বাররার উত্তপ্ত হয়েছে সন্দেশখালি ৷ ছিনিয়ে নেওয়া জমি ফেরত চান স্থানীয়রা ৷ তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে পরিস্থিতি সামাল দিতে এলাকায় যান মন্ত্রী পার্থ ভৌমিক, সুজিত বসুরা। আশ্বাস দেওয়া হয় জমি হারাদের জমি ফিরিয়ে দেওয়ার। সেই সঙ্গে কেড়ে নেওয়া হয় শাহজাহান ও তাঁর ঘনিষ্ঠ উত্তম, শিবুদের পদ।

এদিকে বার দুয়েকের নোটিশে সাড়া না-মেলায় তৃতীয় বারের জন্য নোটিশ দেওয়া হয় সন্দেশখালির 'ফেরার' ও দল থেকে বাদ পড়া শেখ শাহজাহানকে ৷ তার আগেই লুক আউট নোটিশ জারি করা হয় সন্দেশখালির 'মাস্টারমাইন্ড' শেখ শাহজাহানের নামে ৷ এরপর 29 ফ্রেবুয়ারি অর্থাৎ সন্দেশখালি সংবাদ শিরোনামের 55 দিন পর নাটকীয়ভাবে গ্রেফতার হন সন্দেশখালি ঘটনার 'মাস্টারমাইন্ড' তৃণমূল নেতা শেখ শাহজাহান ৷ মিনাখাঁ থেকেই তাঁকে গ্রেফতার করে পুলিশ ৷ বর্তমানে জেলেই রয়েছেন তিনি ৷

3. মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়- স্বস্তি ও অস্বস্তির হাত ধরাধরি করে চলার নামই জীবন ৷ রাজনীতির রঙিন চরিত্রদের বর্ণময় জীবনে স্বস্তি আর অস্বস্তির সম্পর্ক- এ বলে আমায় দ্যাখ তো ও বলে আমায় ৷ বছরের শুরুতে সন্দেশখালির ঘটনাপ্রবাহ রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছিল তাতে সন্দেহ নেই ৷ বিরোধীদের লাগাতার আক্রমণ, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা থেকে মহিলা কমিশন-মানবাধিকার কমিশনের দিক থেকে আসা একের পর এক অভিযোগের বাউন্সার সামলাতে হয়েছে মমতাকে ৷ দক্ষ প্রশাসক ও বিচক্ষণ রাজনীতিকের মতো সমস্ত বিপত্তি সামলে লোকসভা নির্বাচনের জন্য উঠে পড়ে লাগেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ বিজেপি তো বটেই সিপিএম-কংগ্রেসের যৌথ আক্রমণ, তৃণমূলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির একাধিক বড় অভিযোগ-সব রইল একদিকে ৷ অন্যদিকে, শুধু বাংলার মানুষের আস্থা জিতে আবারও 'অনন্যা' মমতাই ৷ তৃণমূলের 29 জন সাংসদই যে তাঁর ছবিকে সামনে রেখে নির্বাচনী বৈতরণী পার করেছেন তার সন্দেহের অবকাশ নেই ৷

জুন মাসে নতুন সরকার তৈরি হওয়ার পর কেন্দ্রীয় প্রশাসনকে আক্রমণের নয়া ছক সাজাচ্ছিলেন মমতাও ৷ ঠিক তখনই অশান্ত হয়ে উঠল বাংলাদেশ ৷ 21 জুলাইয়ের শহিদ দিবসের মঞ্চ থেকে মমতা বলে দিলেন, 'বাংলাদেশ থেকে সব হারিয়ে এই বাংলায় কেউ এলে তাঁকে সাদরে গ্রহণ করা হবে ৷' এরপর বিতর্ক যে ঢাকা থেকে দিল্লিকে জুড়বে তা আর নতুন কী!

অগস্টও যে তাঁর জন্য দুঃস্বপ্ন বয়ে আনছে তা মমতা জানতেন না ৷ আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের ঘটনা দেশ তথা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিল ৷ প্রশ্ন উঠল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে থাকা স্বাস্থ্য দফতরের কাজকর্ম নিয়েও ৷ ওই কলেজেরই সন্দীপ ঘোষকে রাজ্য প্রশাসন আড়াল করতে চাইছে এমন দাবিও ওঠে ৷ আরজি করের প্রিন্সিপাল পদ ছাড়ার পরই সন্দীপকে পাঠানো হয় এনআরএসের দায়িত্বে ৷ যদিও বিক্ষোভে দায়িত্ব নেওয়া হয়নি সন্দীপের ৷

প্রতিবাদ-বিক্ষোভ-সমাবেশ ভরা 14 অগস্ট 'রাত দখল' দেখল রাজ্য ৷ আরও পড়ে অবস্থান শুরু হল জুনিয়র চিকিৎসকদের ৷ বিক্ষোভকারীদের তরফে এক নয়া স্লোগান উঠে এল, 'দফা এক দাবি এক মমতার পদত্যাগ' ৷ সেসময়ও প্রশাসনিক কাজে মগ্ন থেকেছেন মমতা ৷ জুনিয়র চিকিৎসকরা আরজি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে দশ দফা দাবি নিয়ে অনড় থাকেন ৷ এরপর সরাসরি অনশনরত জুনিয়র চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলতে চান মমতা ৷ প্রথমে নবান্নে, পরে মমতার কালীঘাটের বাড়িতে বৈঠক ডাকা হয় ৷ সেখানেও 'লাইভ স্ট্রিমিং' নিয়ে জটিলতার কারণে বৈঠক ভেস্তে যায় ৷ মমতার বাড়ির সামনে অপেক্ষা করছিলেন জুনিয়র চিকিৎসকরা ৷ শুরু হয় বৃষ্টি ৷ আন্দোলনকারীদের ভিজতে দেখে ছাতা হাতে বেরিয়ে এলেন মমতা ৷ প্রশাসনিক প্রধান নন পরিবারের 'দিদি'র মতোই তাঁদের ভিজতে বারণ করলেন মমতা ৷ পরে নবান্নে বৈঠক হয় মমতা-জুনিয়র চিকিৎসকদের সঙ্গে ৷

4. মহুয়া মৈত্র: মাস ছয়েক আগে শেষ হওয়া লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের যে কয়েকটি কেন্দ্র নিয়ে সবচেয়ে বেশি চর্চা হয়েছে তার অন্যতম কৃষ্ণনগর। কৃষ্ণনগর আসনটি আরও বেশি করে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল ওই কেন্দ্রেরই সাংসদ মহুয়া মৈত্রর জন্য ৷ 2019 সালের লোকসভা নির্বাচনে কৃষ্ণনগরে মহুয়া মৈত্র 63 হাজার 218 ভোটে জিতেছিলেন ৷ তারপর থেকে লাগাতার শিরোনামে সাংসদ। ইংরেজি ভাষায় তাঁর অসামান্য পাণ্ডিত্য থেকে শুরু করে যে কোনও বিষয়ে বিজেপিকে চোখাচোখা আক্রমণ-মহুয়াকে খুব অল্প সময়ের মধ্যে ভারতীয় রাজনীতিতে বিশেষ করে তুলেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকেও তিনি বহুবার সরাসরি আক্রমণ করেছেন ৷

যদিও তাঁকে নিয়ে বিতর্ক কম হয়নি। তাঁর বিরুদ্ধে অর্থের বিনিময়ে সংসদে প্রশ্ন করার অভিযোগ উঠেছে ৷ লোকসভার এথিক্স কমিটির সুপারিশে তাঁকে সংসদ থেকে বহিষ্কার পর্যন্ত করা হয়েছিল লোকসভা নির্বাচনের কয়েক মাস আগে। এখনও সিবিআই তদন্ত চলছে ওই ঘটনা নিয়ে ৷

এদিকে, মহুয়া নিশ্চিত ছিলেন ঘুষ-কাণ্ডের কোনও প্রভাব তাঁর ভোটে পড়বে না। হলও তাই। মহুয়া কেন্দ্রে দু'বার নির্বাচনী জনসভা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। মহুয়ার বিরুদ্ধে প্রার্থী করা হয়েছিল কৃষ্ণনগরের রাজ পরিবারের সদস্য অমৃত রায়কে। তাতেও লাভ হয়নি পদ্ম শিবিরের। নিজস্ব ক‍্যারিশমা, দলের সাংগঠনিক শক্তিতে ভর করে আবারও সংসদে গিয়েছেন মহুয়া ।

5.অভিষেক বন্দ্যোপাধ্য়ায়- তাঁর নামের সঙ্গে এখন জুড়েছে 'তৃণমূল সেনাপতি' ও দলের 'সেকেন্ড ইন কমান্ড' শব্দবন্ধ দুটি ৷ লোকসভা নির্বাচনে 7 লক্ষ 10 হাজার 930 ভোটে ডায়মন্ড হারবার আসন জিতেছেন । ব্যবধানের নিরিখে 'দিল্লির দৌড়ে' প্রথম ছয়ে নাম তুলেছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সেনাপতি ৷ এবছর তাঁর রাজনৈতিক জীবন ঝলমলে হলেও একাধিকবার তাঁর নাম জড়িয়েছে দুর্নীতির ঘটনায় ৷ শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে একাধিকবার ইডি এবং সিবিআইয়ের স্ক্যানারে এসেছেন তিনি ৷ পাশাপাশি তাঁর পরিবারও পড়েছে প্রশ্নের মুখে। স্ত্রী রুজিরাকেও দুর্নীতি-মামলায় ডেকে পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ।

অভিষেককে ভুগতে হয়েছে শারীরিক সমস্যাতেও ৷ বিদেশে গিয়ে চোখের অস্ত্রোপচার করাতে হয় দলের সেকেন্ড ইন কমান্ডকে ৷ 2016 সালের এক পথ দুর্ঘটনার পর থেকে তৃণমূল নেতার দৃষ্টিশক্তির ক্ষেত্রে সমস্যা হয়। আটবার তাঁকে সার্জারি করাতে হয় ৷ তিনি এখন সুস্থ ৷ কয়েক মাস আগে দেশে ফিরে বাড়ির কালীপুজোতেও অংশ নিয়েছিলেন।

এদিকে, গত কয়েকমাস ধরেই শোনা যাচ্ছে, তৃণমূলের সাংগঠনিক স্তরে বড় রদবদল হবে ৷ বিদেশ যাওয়ার আগে এই ব্যাপারে নিজের সুপারিশ দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়কে দিয়েছেন অভিষেক ৷ মমতাও সেই সুপারিশ নিয়ে বিবেচনা করেছেন বলে তৃণমূল সূত্রে খবর ৷ কিন্তু এখনও রদবদল হয়নি ৷ রাজনৈতিক মহল মনে করছে, নতুন বছরের শুরুর দিকে কোনও একটি সময় এই সাংগঠনিক রদবদল হতে পারে ৷

6. রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস- পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস ৷ তিনি ধারাবাহিকভাবেই সংবাদে থাকেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে করা মন্তব্য থেকে শুরু করে নিজের মূর্তি উন্মোচন পর্যন্ত রাজ্য সরকারের সঙ্গে তাঁর জটিল সম্পর্ক তাঁকে বারবার চর্চায় রাখে।

মে মাসে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠে শ্লীলতাহানির অভিযোগ ৷ যা নিয়ে তোলপাড় হয় রাজ্য-রাজনীতি। রাজভবনেরই এক অস্থায়ী কর্মী অভিযোগ তোলেন ৷ সেই সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেন রাজ্যপাল ৷ পাল্টা জানান, সন্দেশখালির মহিলাদের পাশে দাঁড়ানোয় এই অপবাদ দেওয়া হয়েছে তাঁকে ৷ রাজ্যপালের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে ভুল করেনি তৃণমূল। খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত বারবার বলেছেন, "যা অবস্থা তাতে রাজভবনে যেতে ভয় পাচ্ছে মেয়েরা।" রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে শিক্ষা দফতরের সঙ্গেও সংঘাত হয়েছে বারবার ৷ বিতর্ক হয়েছে উপ-নির্বাচনে জিতে আসা বিধায়কদের শপথ গ্রহণকে কেন্দ্র করেও। বছরের শেষ দিকে অবশ্য দুপক্ষের সম্পর্ক খানিকটা স্বাভাবিক হয়েছে ৷

7. অনুব্রত মণ্ডল- বীরভূমের 'ত্রাস' তিনি ৷ বঙ্গ রাজনীতিতে চর্চিত নাম এই অনুব্রত ৷ 2011 সালে বাংলায় রাজনৈতিক পালাবদলের পর থেকে ধীরে ধীরে খবরের শিরোনামে উঠে এসেছিলেন বীরভূমের এই দোর্দণ্ডপ্রতাপ তৃণমূল নেতা ৷ কখনও পুলিশকে বোমা মারতে বলা, কখনও বিরোধীদের মেরে হাত-পা ভেঙে দেওয়ার নিদান, কখনও বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার হুঁশিয়ারি শোনা গিয়েছিল কেষ্ট (অনুব্রতর ডাকনাম)র মুখে ৷ সবমিলিয়ে তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদরের 'কেষ্ট' দোর্দণ্ডপ্রতাপ হিসেবেই শিরোনামে থেকেছেন বরাবর।

তবে, 2022 সালে 11 অগস্ট গরু পাচারের অভিযোগে তাঁকে গ্রেফতার করে সিবিআই ৷ এই মামলার তদন্তে নেমে গোয়েন্দারা অনুব্রতর আয় বহির্ভূত বিপুল সম্পত্তির হদিশ পান ৷ 2023 সালে মার্চ মাসে ইডি সেই মামলা হাতে নিয়ে তাঁকে দিল্লি নিয়ে যায় ৷ এরপরই তিনি তিহাড়ে জেলবন্দি হন ৷ কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা তাঁর বিরুদ্ধে আর্থিক তছরূপের মামলা দায়ের করে ৷ এ প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার তাঁর কন্যা সুকন্যা মণ্ডলকেও গ্রেফতার করে ইডি ৷ তিহাড় থেকে তৃণমূল নেতা জেল মুক্তি পাওয়ার জন্য একাধিকবার জামিনের আবেদন করেছিলেন ৷ তা খারিজ হয়ে যায় ৷

এবছর 30 জুলাই সুপ্রিম কোর্ট গরু পাচার মামলায় বীরভূমের কেষ্টকে জামিন দেয় ৷ কিন্তু তিনি যেহেতু সিবিআইয়ের মামলায় জামিন পেয়েছেন, তাই সেদিনই তাঁর জেল মুক্তি হয়নি ৷ তার থেকে প্রায় দু'মাস পর 20 সেপ্টেম্বর দিল্লির রাউস অ্যাভিনিউ আদালত তাঁকে 10 লক্ষ টাকার বন্ডে তাঁর জামিন মঞ্জুর করে ৷ 2 বছর 9 দিন পর তিনি জেল থেকে মুক্তি পান ৷ পাশাপাশি, 10 সেপ্টেম্বর দিল্লি হাইকোর্ট অনুব্রত-কন্যা সুকন্যা মণ্ডলকে জামিন দেয় ৷ এতদিন বীরভূম অনুব্রতহীন থাকলেও দল কিন্তু তাঁর পাশে থেকেছে ৷ দলের সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার আস্থা রাখেন জেলবন্দি প্রিয় কেষ্টর উপর ৷ তাই তো তিহাড় ফেরত অনুব্রতকেই বীরভূমের কোর কমিটির চেয়ারম্যানের পদে এনেছেন মমতা ৷

8. অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়- বিচারবিভাগ থেকে রাজনীতির দুনিয়ায় নাম লেখান কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় ৷ তারপরই আলোড়ন ওঠে বাংলার সংবাদজগতে ৷ বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডে একের পর এক ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন তিনি। চাকরিপ্রার্থীদের চোখে তিনি হয়ে উঠেছিলেন 'ভগবান'। যোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের চাকরি দেওয়ার কথায় তাঁর মুখে শোনা গিয়েছে । পদত্যাগের কয়েক ঘণ্টা পরই বিচারপতির মুখ থেকে শোনা গিয়েছে তিনি বিজেপিতে যোগদান করবেন ৷

2024 লোকসভা নির্বাচনে তমলুক আসনে পদ্মপ্রার্থী হয়ে ভোটে দাঁড়ান প্রাক্তন বিচারপতি ৷ প্রতিপক্ষ তৃণমূলের দেবাংশু ভট্টাচার্য ও পেশায় আইনজীবী সিপিএমের সায়ন বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ এরপর নির্বাচনী সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সম্পর্কে 'কুরুচিকর' মন্তব্যের জেরে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে শো-কজের চিঠি পাঠায় নির্বাচন কমিশন। পালটা নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধেও তিনি কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন ৷ তবে, 4 জুন লোকসভা নির্বাচনের ফলঘোষণার পর দেখা যায় প্রথমবার রাজনীতিতে নাম লিখিয়েই সাংসদ হিসাবে নির্বাচিত হন অভিজিৎ ৷ দেবাংশুকে 77 হাজারেরও বেশি ভোটে জয়ী হন তিনি ৷

9. শ্রীলেখা মিত্র- বামপন্থী হিসেবেই তিনি পরিচিত। আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদে প্রথম সারিতে তাঁরই নাম দেখা গিয়েছে বারে বারে ৷ আর তার জেরে অভিনয়ের কাজ পেতে সমস্যা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন অভিনেত্রী। তবু সাময়িক প্রতিবাদ করে থেমে থাকেননি ৷

একদিকে যখন আরজি করের ঘটনায় উত্তপ্ত বাংলা, অন্যদিকে, বাংলা চলচ্চিত্র জগতে নারী সুরক্ষা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। একের পর এক অভিনেত্রী নাম না-করে প্রকাশ্যে এনেছেন তাঁদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া পরিচালকের অভব্য আচরণের কাহিনি ৷ সেই ঘটনা বাংলার বাইরেও যে প্রতিনিয়তই ঘটে তা সামনে আনেন শ্রীলেখা মিত্রই ৷ কোচিতে শুটিং করতে গিয়ে এমনই অপ্রীতিকর ঘটনার শিকার যে তাঁকে হতে হয়েছিল সেই অভিজ্ঞতা শ্রীলেখা ইটিভি ভারতকেও জানিয়েছিলেন ৷

সালটা 2009 ৷ মালয়লম পরিচালক রঞ্জিতের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ তোলেন বাঙালি অভিনেত্রী ৷ সম্প্রতি, মালয়লম ইন্ডাস্ট্রিতে মহিলাদের কাজের পরিস্থিতি জানার জন্য এবং নিরাপত্তা নিয়ে 'হেমা কমিটি' গঠন করে কেরল সরকার ৷ শ্রীলেখার অভিযোগ প্রকাশ্যে আসতেই শোরগোল পড়ে যায় দক্ষিণের রাজ্যে ৷ রঞ্জিতের পদত্যাগের দাবিতে প্রতিবাদ শুরু হয় ৷ সেই আবহে কেরল চলচ্চিত্র অ্যাকাডেমির চেয়ারম্যানের পদ থেকে ইস্তফা দেন দক্ষিণের বিখ্যাত পরিচালক রঞ্জিত ৷

10. বিনীত গোয়েল- রাজ্য পুলিশের শীর্ষকর্তাদের মধ্যে অন্যতম বিনীত গোয়েল ৷ কর্মজীবনে একাধিক বড় বড় দায়িত্ব সামলানোর পর তাঁকেই কলকাতা পুলিশের নগরপালের দায়িত্ব দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ তবে, তাঁর পূর্বসূরি রাজীব কুমার বা রঞ্জিত পচনন্দার মতো বিনীতের সময়কালও রইল বিতর্কে ঘেরা ৷ জুনিয়র চিকিৎসকদের আন্দোলনের প্রবল চাপে শেষমেশ বিনীতকে কলকাতার নগরপালের পদ থেকে সরাতেই হয় মমতাকে ৷ জুনিয়র চিকিৎসক থেকে শুরু করে আরজি কর আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত অনেকেই মনে করেন, বিনীত গোয়েল নির্যাতিতা পড়ুয়ার সঙ্গে সুবিচার করেননি ৷ তাঁর দেহ উদ্ধারের অব্যবহিত পরে কলকাতা পুলিশ যদি সক্রিয় হত তাহলে মামলার গতিপ্রকৃতিও অন্যরকম হতে পারত ৷ নির্যাতিতার পরিবার এখনও মনে করে কলকাতা পুলিশ তদন্তে গাফিলতি করেছে, শুধু তাই নয়, তথ্যপ্রমাণ লোপাট করেছে ৷ আর সেই কারণেই সিবিআইও মামলার যথার্থ তদন্ত করতে পারছে না ৷

আরজি কর আন্দোলন যখন মধ্যগগনে তখন জুনিয়র চিকিৎসকরা বিনীত গোয়েলের পদত্যাগ চেয়ে সরব হন ৷ মিছিল করে এগিয়ে যান কলকাতা পুলিশের সদর দফতর লালবাজারের দিকে ৷ দাবি একটাই বিনীতের পদত্যাগ ৷ রাতভর লালবাজারের কাছে ফিয়ার্স লেনে অবস্থান করলেন জুনিয়র চিকিৎসকরা ৷ কলকাতা পুলিশের তরফে কোনও প্রতিনিধি এসে তাঁদের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেননি অভিযোগ ৷ অনেক পরে আনুষ্ঠানিকভাবে কলকাতা পুলিশ তাঁদের স্মারকলিপি গ্রহণ করে ৷ রাজ্য প্রশাসন প্রথম দিকে বিনীতের পাশে ছিল ৷ কিন্তু শেষমেশ ডাক্তারদের চাপের কাছে নতি শিকার করে নবান্ন ৷ পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হল বিনীত গোয়েলকে ৷ তাঁর জায়গায় নগরপালের দায়িত্বে এলেন মনোজ বর্মা ৷

11. কিঞ্জল নন্দ- 9 অগস্টের ঘটনা সমাজের মননকেই নাড়িয়ে দিয়েছিল ৷ সেখান থেকেই লড়াইয়ের সূচনা জুনিয়র চিকিৎসক পড়ুয়া কিঞ্জল নন্দের ৷ মনের ভিতরে জমে থাকা ক্ষোভ, প্রতিবাদ হয়ে বেরিয়ে এসেছিল জনসমক্ষে। জনা পনেরো চিকিৎসক-পড়ুয়া মনকে দৃঢ় করে এগিয়েছিলেন । তাঁরা নিজেদের কথা নিজেরাই বলবেন। জোর গলায় আওয়াজ তুলে বিচার চাইবেন তাঁদেরই সতীর্থ চিকিৎসক-পড়ুয়ার খুন-ধর্ষণের ঘটনার। সকলের সামনে সমস্বরে স্লোগান তুলেছিলেন, 'উই ওয়ান্ট জাস্টিস'। পরে ক্রমাগত দীর্ঘ হয় সেই মিছিল।

31 বছর বয়সি জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের অন্যতম মুখ এগরার কিঞ্জল। তিনি বর্তমানে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে মাইক্রোবায়োলজিতে এমডি করছেন ৷ চিকিৎসা নিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি রয়েছে অভিনয়েও দক্ষতা রয়েছে । ইতিমধ্যে বেশকিছু সিনেমা ও ওয়েব সিরিজে অভিনয় করেছেন এই আন্দোলনকারী জুনিয়র চিকিৎসক।

12. অনিকেত মাহাতো- জঙ্গলমহলের উজ্জ্বল তরুণ অনিকেত মাহাতো ৷ তাঁর খবরের শিরোনামে আসার কারণ কিঞ্জল নন্দের মতোই ৷ ঝাড়গ্রাম শহরের কুমুদকুমারী ইনস্টিটিউশন থেকে বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর এসএসকেএম হাসপাতাল থেকে এমবিবিএস পাস করেন অনিকেত। তারপর আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে থেকে এমডি পড়ছেন অনিকেত। আর এর মধ্যেই আরজি করে নারকীয় ঘটনা ঘটায়, ঘটনার বিচার চেয়ে ও চিকিৎসকদের নিরাপত্তার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন জুনিয়র ডাক্তাররা। আর সেই আন্দোলনেরই অন্যতম মুখ অনিকেত।

কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে অনিকেত আমরণ অনশনে বসেন ধর্মতলায় ৷ সেই অনশন মঞ্চ থেকে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন ৷ শারীরিক অবস্থার অবনতি হয় ৷ পরে তিনি সুস্থ হয়ে ফের অনশন মঞ্চে যোগ দেন ৷ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে নবান্নের বৈঠকেও যোগ দেন ৷ ওই বৈঠকে অন্যদের তুলনায় অনিকেত অনেক বেশি সরব ছিলেন ৷ বৈঠক চলাকালীন তাঁর সতীর্থ আসফাকুল্লা নাইয়াকে অনিকেত বলেছিলেন, "বলতে দিলে তো বলব !" সোশাল মিডিয়ায় তুমুল চর্চা হয় এই সংলাপ নিয়ে।

কলকাতা, 26 ডিসেম্বর: 2024 সাল শেষ হতে আর মাত্র কয়েকটা দিন। জীবনানন্দের 'বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি' স্মরণ করে বলাই যায়, এবছর সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেশ কিছু মানুষ বাংলার মুখ হয়ে উঠেছিলেন। কেউ হয়ে উঠেছিলেন জনগণের চোখের মণি, কেউ আবার রয়ে গেলেন সমাজের তির্যক, বাঁকা নজরে।

ইটিভি ভারত এরকম বেশ কিছু মানুষের মধ্যে থেকে বহুলচর্চিত কয়েকজনকে ফিরে দেখছে এখানে। 2024-এর বিদায় বেলায় রইল বাংলার খবরের ঘনঘটার মাঝে থাকা কয়েকটি চেনা মুখ।

1. সন্দীপ ঘোষ- সন্দীপ ঘোষের নাম সবাই জানে। বিখ্যাত নন, কুখ্যাত। তাঁর 'কুকীর্তি' এখন সকলেরই কমবেশি জানা ৷ দিনটা 9 অগস্ট ৷ আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে জুনিয়র চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগ উঠল ৷ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চার তলার সেমিনার হল থেকে উদ্ধার হয় ওই পড়ুয়ার দেহ ৷ তারপর সময় যত এগিয়েছে, ততই ওই হাসপাতালের তৎকালীন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে ঘিরে অভিযোগের পাহাড় জমতে থাকে ৷

কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে মামলার তদন্ত শুরুর পর সিবিআই প্রায় রোজই সন্দীপ ঘোষকে তলব করতে থাকে ৷ ঘটনার 15তম দিনে বিধাননগরের সিজিও কমপ্লেক্সে হাজিরা দিতে গিয়ে গ্রেফতার হন তিনি ৷ নির্যাতিতাকে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার প্রমাণ লোপাটের অভিযোগের পাশাপাশি হাসপাতালের আর্থিক অনিয়মে তাঁর নাম জড়ায়। সেই মামলার তদন্ত করছে সিবিআই ৷

2024-এ জনমনে কেউ হয়েছেন হিরো, কেউ ভিলেন (ইটিভি ভারত)

আদালতে পেশ করার সময় এই হাই প্রোফাইল ডাক্তারকে খেতে হয়েছে থাপ্পড়, জুতোর বাড়ি ৷ পরবর্তী সময়ে তাঁর গ্রেফতারির 90 দিনের মাথায় সিবিআই আদালতে জানায়, আরজি করে ধর্ষণ এবং খুনের মামলায় এই মুহূর্তে সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট দিতে পারছে না তারা। তদন্ত চলছে। তারপরই এই মামলায় জামিন পান আরজি কর হাসপাতলের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ ৷ তবে আর্থিক অনিয়মের মামলায় এখনও জেলেই রয়েছেন সন্দীপ।

2. শেখ শাহজাহান- বছরের শুরুর দিক থেকেই বাংলা তোলপাড় হয় সন্দেশখালির ঘটনায়। বিভিন্ন দুর্নীতির ঘটনায় ইডি, রাজ্যের তাবর নেতা-মন্ত্রী, বিধায়কদের গ্রেফতার করেছে। সামান্য প্রতিবাদ হলেও কোথাও বাধার মুখে পড়েনি ইডি। সেটাই হল সন্দেশখালিতে। রেশন দুর্নীতির তদন্তে 5 জানুয়ারি সন্দেশখালিতে বাধার মুখে পড়ে ইডি। মাথা ফাটে এক আধিকারিকের ৷ আহত হন আরও কয়েকজন। ইডির উপর হামলার ঘটনার পর গা-ঢাকা দিয়েছিলেন শাহজাহান।

পরবর্তী সময়ে বোঝা যায় এই শাহজাহান আসলে সন্দেশখালির 'বেতাজ বাদশা' ৷ তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে জমি-ভেড়ি দখল, মহিলাদের উপর নির্যাতনের একাধিক অভিযোগ ওঠে। গ্রামের মহিলারা লাঠিসোঁটা, মশাল হাতে রাস্তায় নামেন ৷

17 জানুয়ারি সন্দেশখালিতে ইডি আধিকারিকদের উপর হামলার ঘটনার তদন্তে সিট গঠন হয় ৷ উত্তর 24 পরগনার সন্দেশখালির পরিস্থিতি ক্রমশ অবনতির দিকে এগোয় ৷ হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগে কার্যত অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি হয় ৷ শাহজাহান ঘনিষ্ঠ শিবু হাজরা, উত্তম সর্দারদের বিরুদ্ধে অন‍্যায় অত‍্যাচারের অভিযোগ তুলে ক্ষোভে ফুঁসতে থাকেন গ্রামবাসীদের একটি বড় অংশ। কয়েক'টি পঞ্চায়েত নিয়ে এলাকাগুলিতে 144 ধারা জারি হয় ৷

তারপরও বাররার উত্তপ্ত হয়েছে সন্দেশখালি ৷ ছিনিয়ে নেওয়া জমি ফেরত চান স্থানীয়রা ৷ তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে পরিস্থিতি সামাল দিতে এলাকায় যান মন্ত্রী পার্থ ভৌমিক, সুজিত বসুরা। আশ্বাস দেওয়া হয় জমি হারাদের জমি ফিরিয়ে দেওয়ার। সেই সঙ্গে কেড়ে নেওয়া হয় শাহজাহান ও তাঁর ঘনিষ্ঠ উত্তম, শিবুদের পদ।

এদিকে বার দুয়েকের নোটিশে সাড়া না-মেলায় তৃতীয় বারের জন্য নোটিশ দেওয়া হয় সন্দেশখালির 'ফেরার' ও দল থেকে বাদ পড়া শেখ শাহজাহানকে ৷ তার আগেই লুক আউট নোটিশ জারি করা হয় সন্দেশখালির 'মাস্টারমাইন্ড' শেখ শাহজাহানের নামে ৷ এরপর 29 ফ্রেবুয়ারি অর্থাৎ সন্দেশখালি সংবাদ শিরোনামের 55 দিন পর নাটকীয়ভাবে গ্রেফতার হন সন্দেশখালি ঘটনার 'মাস্টারমাইন্ড' তৃণমূল নেতা শেখ শাহজাহান ৷ মিনাখাঁ থেকেই তাঁকে গ্রেফতার করে পুলিশ ৷ বর্তমানে জেলেই রয়েছেন তিনি ৷

3. মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়- স্বস্তি ও অস্বস্তির হাত ধরাধরি করে চলার নামই জীবন ৷ রাজনীতির রঙিন চরিত্রদের বর্ণময় জীবনে স্বস্তি আর অস্বস্তির সম্পর্ক- এ বলে আমায় দ্যাখ তো ও বলে আমায় ৷ বছরের শুরুতে সন্দেশখালির ঘটনাপ্রবাহ রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছিল তাতে সন্দেহ নেই ৷ বিরোধীদের লাগাতার আক্রমণ, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা থেকে মহিলা কমিশন-মানবাধিকার কমিশনের দিক থেকে আসা একের পর এক অভিযোগের বাউন্সার সামলাতে হয়েছে মমতাকে ৷ দক্ষ প্রশাসক ও বিচক্ষণ রাজনীতিকের মতো সমস্ত বিপত্তি সামলে লোকসভা নির্বাচনের জন্য উঠে পড়ে লাগেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ বিজেপি তো বটেই সিপিএম-কংগ্রেসের যৌথ আক্রমণ, তৃণমূলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির একাধিক বড় অভিযোগ-সব রইল একদিকে ৷ অন্যদিকে, শুধু বাংলার মানুষের আস্থা জিতে আবারও 'অনন্যা' মমতাই ৷ তৃণমূলের 29 জন সাংসদই যে তাঁর ছবিকে সামনে রেখে নির্বাচনী বৈতরণী পার করেছেন তার সন্দেহের অবকাশ নেই ৷

জুন মাসে নতুন সরকার তৈরি হওয়ার পর কেন্দ্রীয় প্রশাসনকে আক্রমণের নয়া ছক সাজাচ্ছিলেন মমতাও ৷ ঠিক তখনই অশান্ত হয়ে উঠল বাংলাদেশ ৷ 21 জুলাইয়ের শহিদ দিবসের মঞ্চ থেকে মমতা বলে দিলেন, 'বাংলাদেশ থেকে সব হারিয়ে এই বাংলায় কেউ এলে তাঁকে সাদরে গ্রহণ করা হবে ৷' এরপর বিতর্ক যে ঢাকা থেকে দিল্লিকে জুড়বে তা আর নতুন কী!

অগস্টও যে তাঁর জন্য দুঃস্বপ্ন বয়ে আনছে তা মমতা জানতেন না ৷ আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের ঘটনা দেশ তথা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিল ৷ প্রশ্ন উঠল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে থাকা স্বাস্থ্য দফতরের কাজকর্ম নিয়েও ৷ ওই কলেজেরই সন্দীপ ঘোষকে রাজ্য প্রশাসন আড়াল করতে চাইছে এমন দাবিও ওঠে ৷ আরজি করের প্রিন্সিপাল পদ ছাড়ার পরই সন্দীপকে পাঠানো হয় এনআরএসের দায়িত্বে ৷ যদিও বিক্ষোভে দায়িত্ব নেওয়া হয়নি সন্দীপের ৷

প্রতিবাদ-বিক্ষোভ-সমাবেশ ভরা 14 অগস্ট 'রাত দখল' দেখল রাজ্য ৷ আরও পড়ে অবস্থান শুরু হল জুনিয়র চিকিৎসকদের ৷ বিক্ষোভকারীদের তরফে এক নয়া স্লোগান উঠে এল, 'দফা এক দাবি এক মমতার পদত্যাগ' ৷ সেসময়ও প্রশাসনিক কাজে মগ্ন থেকেছেন মমতা ৷ জুনিয়র চিকিৎসকরা আরজি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে দশ দফা দাবি নিয়ে অনড় থাকেন ৷ এরপর সরাসরি অনশনরত জুনিয়র চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলতে চান মমতা ৷ প্রথমে নবান্নে, পরে মমতার কালীঘাটের বাড়িতে বৈঠক ডাকা হয় ৷ সেখানেও 'লাইভ স্ট্রিমিং' নিয়ে জটিলতার কারণে বৈঠক ভেস্তে যায় ৷ মমতার বাড়ির সামনে অপেক্ষা করছিলেন জুনিয়র চিকিৎসকরা ৷ শুরু হয় বৃষ্টি ৷ আন্দোলনকারীদের ভিজতে দেখে ছাতা হাতে বেরিয়ে এলেন মমতা ৷ প্রশাসনিক প্রধান নন পরিবারের 'দিদি'র মতোই তাঁদের ভিজতে বারণ করলেন মমতা ৷ পরে নবান্নে বৈঠক হয় মমতা-জুনিয়র চিকিৎসকদের সঙ্গে ৷

4. মহুয়া মৈত্র: মাস ছয়েক আগে শেষ হওয়া লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের যে কয়েকটি কেন্দ্র নিয়ে সবচেয়ে বেশি চর্চা হয়েছে তার অন্যতম কৃষ্ণনগর। কৃষ্ণনগর আসনটি আরও বেশি করে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল ওই কেন্দ্রেরই সাংসদ মহুয়া মৈত্রর জন্য ৷ 2019 সালের লোকসভা নির্বাচনে কৃষ্ণনগরে মহুয়া মৈত্র 63 হাজার 218 ভোটে জিতেছিলেন ৷ তারপর থেকে লাগাতার শিরোনামে সাংসদ। ইংরেজি ভাষায় তাঁর অসামান্য পাণ্ডিত্য থেকে শুরু করে যে কোনও বিষয়ে বিজেপিকে চোখাচোখা আক্রমণ-মহুয়াকে খুব অল্প সময়ের মধ্যে ভারতীয় রাজনীতিতে বিশেষ করে তুলেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকেও তিনি বহুবার সরাসরি আক্রমণ করেছেন ৷

যদিও তাঁকে নিয়ে বিতর্ক কম হয়নি। তাঁর বিরুদ্ধে অর্থের বিনিময়ে সংসদে প্রশ্ন করার অভিযোগ উঠেছে ৷ লোকসভার এথিক্স কমিটির সুপারিশে তাঁকে সংসদ থেকে বহিষ্কার পর্যন্ত করা হয়েছিল লোকসভা নির্বাচনের কয়েক মাস আগে। এখনও সিবিআই তদন্ত চলছে ওই ঘটনা নিয়ে ৷

এদিকে, মহুয়া নিশ্চিত ছিলেন ঘুষ-কাণ্ডের কোনও প্রভাব তাঁর ভোটে পড়বে না। হলও তাই। মহুয়া কেন্দ্রে দু'বার নির্বাচনী জনসভা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। মহুয়ার বিরুদ্ধে প্রার্থী করা হয়েছিল কৃষ্ণনগরের রাজ পরিবারের সদস্য অমৃত রায়কে। তাতেও লাভ হয়নি পদ্ম শিবিরের। নিজস্ব ক‍্যারিশমা, দলের সাংগঠনিক শক্তিতে ভর করে আবারও সংসদে গিয়েছেন মহুয়া ।

5.অভিষেক বন্দ্যোপাধ্য়ায়- তাঁর নামের সঙ্গে এখন জুড়েছে 'তৃণমূল সেনাপতি' ও দলের 'সেকেন্ড ইন কমান্ড' শব্দবন্ধ দুটি ৷ লোকসভা নির্বাচনে 7 লক্ষ 10 হাজার 930 ভোটে ডায়মন্ড হারবার আসন জিতেছেন । ব্যবধানের নিরিখে 'দিল্লির দৌড়ে' প্রথম ছয়ে নাম তুলেছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সেনাপতি ৷ এবছর তাঁর রাজনৈতিক জীবন ঝলমলে হলেও একাধিকবার তাঁর নাম জড়িয়েছে দুর্নীতির ঘটনায় ৷ শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে একাধিকবার ইডি এবং সিবিআইয়ের স্ক্যানারে এসেছেন তিনি ৷ পাশাপাশি তাঁর পরিবারও পড়েছে প্রশ্নের মুখে। স্ত্রী রুজিরাকেও দুর্নীতি-মামলায় ডেকে পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ।

অভিষেককে ভুগতে হয়েছে শারীরিক সমস্যাতেও ৷ বিদেশে গিয়ে চোখের অস্ত্রোপচার করাতে হয় দলের সেকেন্ড ইন কমান্ডকে ৷ 2016 সালের এক পথ দুর্ঘটনার পর থেকে তৃণমূল নেতার দৃষ্টিশক্তির ক্ষেত্রে সমস্যা হয়। আটবার তাঁকে সার্জারি করাতে হয় ৷ তিনি এখন সুস্থ ৷ কয়েক মাস আগে দেশে ফিরে বাড়ির কালীপুজোতেও অংশ নিয়েছিলেন।

এদিকে, গত কয়েকমাস ধরেই শোনা যাচ্ছে, তৃণমূলের সাংগঠনিক স্তরে বড় রদবদল হবে ৷ বিদেশ যাওয়ার আগে এই ব্যাপারে নিজের সুপারিশ দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়কে দিয়েছেন অভিষেক ৷ মমতাও সেই সুপারিশ নিয়ে বিবেচনা করেছেন বলে তৃণমূল সূত্রে খবর ৷ কিন্তু এখনও রদবদল হয়নি ৷ রাজনৈতিক মহল মনে করছে, নতুন বছরের শুরুর দিকে কোনও একটি সময় এই সাংগঠনিক রদবদল হতে পারে ৷

6. রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস- পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস ৷ তিনি ধারাবাহিকভাবেই সংবাদে থাকেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে করা মন্তব্য থেকে শুরু করে নিজের মূর্তি উন্মোচন পর্যন্ত রাজ্য সরকারের সঙ্গে তাঁর জটিল সম্পর্ক তাঁকে বারবার চর্চায় রাখে।

মে মাসে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠে শ্লীলতাহানির অভিযোগ ৷ যা নিয়ে তোলপাড় হয় রাজ্য-রাজনীতি। রাজভবনেরই এক অস্থায়ী কর্মী অভিযোগ তোলেন ৷ সেই সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেন রাজ্যপাল ৷ পাল্টা জানান, সন্দেশখালির মহিলাদের পাশে দাঁড়ানোয় এই অপবাদ দেওয়া হয়েছে তাঁকে ৷ রাজ্যপালের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে ভুল করেনি তৃণমূল। খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত বারবার বলেছেন, "যা অবস্থা তাতে রাজভবনে যেতে ভয় পাচ্ছে মেয়েরা।" রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে শিক্ষা দফতরের সঙ্গেও সংঘাত হয়েছে বারবার ৷ বিতর্ক হয়েছে উপ-নির্বাচনে জিতে আসা বিধায়কদের শপথ গ্রহণকে কেন্দ্র করেও। বছরের শেষ দিকে অবশ্য দুপক্ষের সম্পর্ক খানিকটা স্বাভাবিক হয়েছে ৷

7. অনুব্রত মণ্ডল- বীরভূমের 'ত্রাস' তিনি ৷ বঙ্গ রাজনীতিতে চর্চিত নাম এই অনুব্রত ৷ 2011 সালে বাংলায় রাজনৈতিক পালাবদলের পর থেকে ধীরে ধীরে খবরের শিরোনামে উঠে এসেছিলেন বীরভূমের এই দোর্দণ্ডপ্রতাপ তৃণমূল নেতা ৷ কখনও পুলিশকে বোমা মারতে বলা, কখনও বিরোধীদের মেরে হাত-পা ভেঙে দেওয়ার নিদান, কখনও বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার হুঁশিয়ারি শোনা গিয়েছিল কেষ্ট (অনুব্রতর ডাকনাম)র মুখে ৷ সবমিলিয়ে তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদরের 'কেষ্ট' দোর্দণ্ডপ্রতাপ হিসেবেই শিরোনামে থেকেছেন বরাবর।

তবে, 2022 সালে 11 অগস্ট গরু পাচারের অভিযোগে তাঁকে গ্রেফতার করে সিবিআই ৷ এই মামলার তদন্তে নেমে গোয়েন্দারা অনুব্রতর আয় বহির্ভূত বিপুল সম্পত্তির হদিশ পান ৷ 2023 সালে মার্চ মাসে ইডি সেই মামলা হাতে নিয়ে তাঁকে দিল্লি নিয়ে যায় ৷ এরপরই তিনি তিহাড়ে জেলবন্দি হন ৷ কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা তাঁর বিরুদ্ধে আর্থিক তছরূপের মামলা দায়ের করে ৷ এ প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার তাঁর কন্যা সুকন্যা মণ্ডলকেও গ্রেফতার করে ইডি ৷ তিহাড় থেকে তৃণমূল নেতা জেল মুক্তি পাওয়ার জন্য একাধিকবার জামিনের আবেদন করেছিলেন ৷ তা খারিজ হয়ে যায় ৷

এবছর 30 জুলাই সুপ্রিম কোর্ট গরু পাচার মামলায় বীরভূমের কেষ্টকে জামিন দেয় ৷ কিন্তু তিনি যেহেতু সিবিআইয়ের মামলায় জামিন পেয়েছেন, তাই সেদিনই তাঁর জেল মুক্তি হয়নি ৷ তার থেকে প্রায় দু'মাস পর 20 সেপ্টেম্বর দিল্লির রাউস অ্যাভিনিউ আদালত তাঁকে 10 লক্ষ টাকার বন্ডে তাঁর জামিন মঞ্জুর করে ৷ 2 বছর 9 দিন পর তিনি জেল থেকে মুক্তি পান ৷ পাশাপাশি, 10 সেপ্টেম্বর দিল্লি হাইকোর্ট অনুব্রত-কন্যা সুকন্যা মণ্ডলকে জামিন দেয় ৷ এতদিন বীরভূম অনুব্রতহীন থাকলেও দল কিন্তু তাঁর পাশে থেকেছে ৷ দলের সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার আস্থা রাখেন জেলবন্দি প্রিয় কেষ্টর উপর ৷ তাই তো তিহাড় ফেরত অনুব্রতকেই বীরভূমের কোর কমিটির চেয়ারম্যানের পদে এনেছেন মমতা ৷

8. অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়- বিচারবিভাগ থেকে রাজনীতির দুনিয়ায় নাম লেখান কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় ৷ তারপরই আলোড়ন ওঠে বাংলার সংবাদজগতে ৷ বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডে একের পর এক ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন তিনি। চাকরিপ্রার্থীদের চোখে তিনি হয়ে উঠেছিলেন 'ভগবান'। যোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের চাকরি দেওয়ার কথায় তাঁর মুখে শোনা গিয়েছে । পদত্যাগের কয়েক ঘণ্টা পরই বিচারপতির মুখ থেকে শোনা গিয়েছে তিনি বিজেপিতে যোগদান করবেন ৷

2024 লোকসভা নির্বাচনে তমলুক আসনে পদ্মপ্রার্থী হয়ে ভোটে দাঁড়ান প্রাক্তন বিচারপতি ৷ প্রতিপক্ষ তৃণমূলের দেবাংশু ভট্টাচার্য ও পেশায় আইনজীবী সিপিএমের সায়ন বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ এরপর নির্বাচনী সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সম্পর্কে 'কুরুচিকর' মন্তব্যের জেরে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে শো-কজের চিঠি পাঠায় নির্বাচন কমিশন। পালটা নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধেও তিনি কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন ৷ তবে, 4 জুন লোকসভা নির্বাচনের ফলঘোষণার পর দেখা যায় প্রথমবার রাজনীতিতে নাম লিখিয়েই সাংসদ হিসাবে নির্বাচিত হন অভিজিৎ ৷ দেবাংশুকে 77 হাজারেরও বেশি ভোটে জয়ী হন তিনি ৷

9. শ্রীলেখা মিত্র- বামপন্থী হিসেবেই তিনি পরিচিত। আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদে প্রথম সারিতে তাঁরই নাম দেখা গিয়েছে বারে বারে ৷ আর তার জেরে অভিনয়ের কাজ পেতে সমস্যা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন অভিনেত্রী। তবু সাময়িক প্রতিবাদ করে থেমে থাকেননি ৷

একদিকে যখন আরজি করের ঘটনায় উত্তপ্ত বাংলা, অন্যদিকে, বাংলা চলচ্চিত্র জগতে নারী সুরক্ষা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। একের পর এক অভিনেত্রী নাম না-করে প্রকাশ্যে এনেছেন তাঁদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া পরিচালকের অভব্য আচরণের কাহিনি ৷ সেই ঘটনা বাংলার বাইরেও যে প্রতিনিয়তই ঘটে তা সামনে আনেন শ্রীলেখা মিত্রই ৷ কোচিতে শুটিং করতে গিয়ে এমনই অপ্রীতিকর ঘটনার শিকার যে তাঁকে হতে হয়েছিল সেই অভিজ্ঞতা শ্রীলেখা ইটিভি ভারতকেও জানিয়েছিলেন ৷

সালটা 2009 ৷ মালয়লম পরিচালক রঞ্জিতের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ তোলেন বাঙালি অভিনেত্রী ৷ সম্প্রতি, মালয়লম ইন্ডাস্ট্রিতে মহিলাদের কাজের পরিস্থিতি জানার জন্য এবং নিরাপত্তা নিয়ে 'হেমা কমিটি' গঠন করে কেরল সরকার ৷ শ্রীলেখার অভিযোগ প্রকাশ্যে আসতেই শোরগোল পড়ে যায় দক্ষিণের রাজ্যে ৷ রঞ্জিতের পদত্যাগের দাবিতে প্রতিবাদ শুরু হয় ৷ সেই আবহে কেরল চলচ্চিত্র অ্যাকাডেমির চেয়ারম্যানের পদ থেকে ইস্তফা দেন দক্ষিণের বিখ্যাত পরিচালক রঞ্জিত ৷

10. বিনীত গোয়েল- রাজ্য পুলিশের শীর্ষকর্তাদের মধ্যে অন্যতম বিনীত গোয়েল ৷ কর্মজীবনে একাধিক বড় বড় দায়িত্ব সামলানোর পর তাঁকেই কলকাতা পুলিশের নগরপালের দায়িত্ব দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ তবে, তাঁর পূর্বসূরি রাজীব কুমার বা রঞ্জিত পচনন্দার মতো বিনীতের সময়কালও রইল বিতর্কে ঘেরা ৷ জুনিয়র চিকিৎসকদের আন্দোলনের প্রবল চাপে শেষমেশ বিনীতকে কলকাতার নগরপালের পদ থেকে সরাতেই হয় মমতাকে ৷ জুনিয়র চিকিৎসক থেকে শুরু করে আরজি কর আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত অনেকেই মনে করেন, বিনীত গোয়েল নির্যাতিতা পড়ুয়ার সঙ্গে সুবিচার করেননি ৷ তাঁর দেহ উদ্ধারের অব্যবহিত পরে কলকাতা পুলিশ যদি সক্রিয় হত তাহলে মামলার গতিপ্রকৃতিও অন্যরকম হতে পারত ৷ নির্যাতিতার পরিবার এখনও মনে করে কলকাতা পুলিশ তদন্তে গাফিলতি করেছে, শুধু তাই নয়, তথ্যপ্রমাণ লোপাট করেছে ৷ আর সেই কারণেই সিবিআইও মামলার যথার্থ তদন্ত করতে পারছে না ৷

আরজি কর আন্দোলন যখন মধ্যগগনে তখন জুনিয়র চিকিৎসকরা বিনীত গোয়েলের পদত্যাগ চেয়ে সরব হন ৷ মিছিল করে এগিয়ে যান কলকাতা পুলিশের সদর দফতর লালবাজারের দিকে ৷ দাবি একটাই বিনীতের পদত্যাগ ৷ রাতভর লালবাজারের কাছে ফিয়ার্স লেনে অবস্থান করলেন জুনিয়র চিকিৎসকরা ৷ কলকাতা পুলিশের তরফে কোনও প্রতিনিধি এসে তাঁদের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেননি অভিযোগ ৷ অনেক পরে আনুষ্ঠানিকভাবে কলকাতা পুলিশ তাঁদের স্মারকলিপি গ্রহণ করে ৷ রাজ্য প্রশাসন প্রথম দিকে বিনীতের পাশে ছিল ৷ কিন্তু শেষমেশ ডাক্তারদের চাপের কাছে নতি শিকার করে নবান্ন ৷ পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হল বিনীত গোয়েলকে ৷ তাঁর জায়গায় নগরপালের দায়িত্বে এলেন মনোজ বর্মা ৷

11. কিঞ্জল নন্দ- 9 অগস্টের ঘটনা সমাজের মননকেই নাড়িয়ে দিয়েছিল ৷ সেখান থেকেই লড়াইয়ের সূচনা জুনিয়র চিকিৎসক পড়ুয়া কিঞ্জল নন্দের ৷ মনের ভিতরে জমে থাকা ক্ষোভ, প্রতিবাদ হয়ে বেরিয়ে এসেছিল জনসমক্ষে। জনা পনেরো চিকিৎসক-পড়ুয়া মনকে দৃঢ় করে এগিয়েছিলেন । তাঁরা নিজেদের কথা নিজেরাই বলবেন। জোর গলায় আওয়াজ তুলে বিচার চাইবেন তাঁদেরই সতীর্থ চিকিৎসক-পড়ুয়ার খুন-ধর্ষণের ঘটনার। সকলের সামনে সমস্বরে স্লোগান তুলেছিলেন, 'উই ওয়ান্ট জাস্টিস'। পরে ক্রমাগত দীর্ঘ হয় সেই মিছিল।

31 বছর বয়সি জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের অন্যতম মুখ এগরার কিঞ্জল। তিনি বর্তমানে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে মাইক্রোবায়োলজিতে এমডি করছেন ৷ চিকিৎসা নিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি রয়েছে অভিনয়েও দক্ষতা রয়েছে । ইতিমধ্যে বেশকিছু সিনেমা ও ওয়েব সিরিজে অভিনয় করেছেন এই আন্দোলনকারী জুনিয়র চিকিৎসক।

12. অনিকেত মাহাতো- জঙ্গলমহলের উজ্জ্বল তরুণ অনিকেত মাহাতো ৷ তাঁর খবরের শিরোনামে আসার কারণ কিঞ্জল নন্দের মতোই ৷ ঝাড়গ্রাম শহরের কুমুদকুমারী ইনস্টিটিউশন থেকে বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর এসএসকেএম হাসপাতাল থেকে এমবিবিএস পাস করেন অনিকেত। তারপর আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে থেকে এমডি পড়ছেন অনিকেত। আর এর মধ্যেই আরজি করে নারকীয় ঘটনা ঘটায়, ঘটনার বিচার চেয়ে ও চিকিৎসকদের নিরাপত্তার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন জুনিয়র ডাক্তাররা। আর সেই আন্দোলনেরই অন্যতম মুখ অনিকেত।

কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে অনিকেত আমরণ অনশনে বসেন ধর্মতলায় ৷ সেই অনশন মঞ্চ থেকে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন ৷ শারীরিক অবস্থার অবনতি হয় ৷ পরে তিনি সুস্থ হয়ে ফের অনশন মঞ্চে যোগ দেন ৷ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে নবান্নের বৈঠকেও যোগ দেন ৷ ওই বৈঠকে অন্যদের তুলনায় অনিকেত অনেক বেশি সরব ছিলেন ৷ বৈঠক চলাকালীন তাঁর সতীর্থ আসফাকুল্লা নাইয়াকে অনিকেত বলেছিলেন, "বলতে দিলে তো বলব !" সোশাল মিডিয়ায় তুমুল চর্চা হয় এই সংলাপ নিয়ে।

ETV Bharat Logo

Copyright © 2025 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.