বর্ধমান, 12 জুলাই: সাজাপ্রাপ্ত মাওবাদী নেতা অর্ণব দামকে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে । যদিও সরকার, বিচারবিভাগ ও কারা বিভাগের পক্ষ থেকে তাঁকে পড়াশোনা করার ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে । কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্দরে দুই পক্ষের মধ্যে একটা মতভেদ তৈরি হয়েছে । একপক্ষের মতে, অর্ণব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে যদি তিনি আবার কোনও ঘটনা ঘটান, তার দায় কে নেবে । যদিও ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কোনও আতঙ্কের পরিবেশ নেই । বরং সবাই তাঁকে সাদরে গ্রহণ করতে প্রস্তুত ।
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র স্বরাজ ঘোষ বলেন, "প্রাক্তন মাওবাদী নেতা অর্ণব দাম নিজের যোগ্যতায় বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে গবেষণা করার সুযোগ পেয়েছেন । তিনি মাওবাদী হলেও আসলে তো মানুষ ৷ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মাওবাদীদের মূল স্রোতে আনার জন্য উদ্যোগ নিয়েছেন, সেই সুযোগ পেয়ে অর্ণব দাম বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিয়েছেন । পরীক্ষাতে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন । ফলে তাঁকে কোনওভাবেই আটকে রাখা যায় না । তাঁকে পড়তে দেওয়া উচিত ।"
অর্ণবকে নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কোনও আতঙ্ক নেই বলেও জানালেন ওই ছাত্র ৷ তাঁর কথায়, "তিনি মাওবাদী বলে আমাদের মধ্যে কোনও ভয় বা আতঙ্ক কাজ করছে না । কারণ আমরা মনে করি অনেকেই কিছু না কিছু ভুল করে থাকেন ৷ তাঁকে সেই ভুল সংশোধন করার সুযোগ দেওয়া উচিত । তাইতো আজ জেলখানার পরিবর্তে নাম হয়েছে সংশোধনাগার । একটা মানুষ ভুল করার পরে নিজেকে সংশোধন করে সমাজের মূল স্রোতে ফিরে আসবে এর থেকে ভালো জিনিস তো কিছু হতেই পারে না । তাই আমরা তাঁকে সাদরে গ্রহণ করব ।" তাঁর অভিযোগ, "কিছু মানুষ নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ তাঁর ভর্তি প্রক্রিয়াকে আটকে রেখেছেন ।"
আইন বিভাগের ছাত্র রবিউল হালদার বলেন, "যতটুকু জানতে পেরেছি অর্ণব দাম পিএইচডি করার জন্য ববর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হচ্ছেন । তিনি মেধার ভিত্তিতে প্রথম স্থান অধিকার করেছেন । একজন ছাত্রের জন্য মেধাই আসল কথা । আমি মনে করি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর একটাই পরিচয়, তিনি একজন ছাত্র । ভারতীয় সংবিধানে শিক্ষার অধিকার বলছে, সব ভারতীয়ের শিক্ষার মৌলিক অধিকার আছে । হতে পারে তিনি প্রাক্তন মাওবাদী । আমার কাছে তাঁর একটাই পরিচয়, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ইতিহাসের গবেষণার ছাত্র । তাঁর মাওবাদী পরিচয় থাকবে বলে আমার মনে হয় না । আর কোনও সময় একটা মানুষের মধ্যে পরিবর্তন আসতে পারে । ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ভয়ের বা আতঙ্কের কোনও পরিবেশ নেই । আর পিএইচডি ক্লাস রেগুলার করতে হয় না ৷ তাঁদের প্রত্যেকের একটা গাইড থাকে ৷ তাঁর নির্দেশ মতোই গবেষণা চলবে । আমাদের এখানে ভয় বা আতঙ্কের কোনও পরিবেশ নেই ।"
একই কথা শোনা গেল আইন বিভাগের ছাত্রী রিয়া বৈরাগ্যর গলায় ৷ তিনি বলেন, "অর্ণব দাম বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হলেও তাঁকে নিয়ে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কোনও ভয় বা আতঙ্ক আমাদের মধ্যে কাজ করছে না । বরং আমরা খুশি হয়েছি । কারণ একজন একটা ভুল কাজ করার পরে তিনি আবার নিজের ভুল বুঝতে পেরে সমাজের মূল স্রোতে ফেরার চেষ্টা করছেন, এটা সমাজের কাছে একটা নিদর্শন হয়ে থাকবে ।"
অর্ণব অন্য অপরাধীদের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলে মনে করেন রিয়া ৷ তিনি বলেন, "আমার মনে হয় এটা প্রথম ঘটছে যে, মাওবাদী নেতা সমাজের প্রথম সারিতে এগিয়ে আসার চেষ্টা করছেন । তিনি তাঁর মেধাকে কাজে লাগিয়ে নিজের পরিবর্তন চেষ্টা করছেন । আমাদের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কোনও ভয় বা আতঙ্ক কাজ করছে না । ইতিমধ্যে আদালত থেকে পড়াশোনা করার জন্য অনুমতি পেয়েছেন তিনি । এর ফলে অন্যান্য যাঁরা বিভিন্ন ভুল কাজ করেছেন তাঁরাও অর্ণবকে দেখে নিজেদের পরিবর্তন করার চেষ্টা করবেন । এটা সমাজের পক্ষে ভালোই হবে । আমরা যদি সংশোধন করার সুযোগ করে দিই তাহলে সমাজকে আমরা নতুন করে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব । ফলে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কোনও ভয় কাজ করছে না ।"
উল্লেখ্য, ইতিহাসে পিএইচডি করার জন্য বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন সাজাপ্রাপ্ত মাওবাদী নেতা অর্ণব দাম । বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম হয়েছেন অর্ণব দাম । বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, মোট 220 জন এই পরীক্ষায় বসেছিলেন । পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, নিহত মাওবাদী নেতা কিষেনজির ঘনিষ্ঠ ছিলেন অর্ণব । শিলদা ইএফআর ক্যাম্পে হামলা-সহ একাধিক মাওবাদী হামলায় তাঁর নাম জড়ায় । 2012 সালে তাঁকে আসানসোল থেকে গ্রেফতার করা হয় । জেল থেকেই পরীক্ষা দিয়ে তিনি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পান । এছাড়া তিনি জেল থেকেই স্টেট এলিজিবিলিটি টেস্ট (সেট)-এ উত্তীর্ণ হন ।
অর্ণব দামকে ভর্তি নিয়ে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে ৷ সূত্রের খবর, হুগলি জেলা সংশোধানাগার থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি চিঠি পাঠানো হয় । সেখানে এক জেলবন্দি পিএইচডি করতে চাইছে বলে উল্লেখ করা হয় । সেই মতো তাঁকে অনুমতি দেওয়া হয় ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মতে, সংশোধনাগারে থেকে কেউ পিএইচডি করতেই পারেন । কিন্তু অর্ণব যেহেতু মাওবাদী কার্যকলাপে যুক্ত ছিলেন, সেটা সংশোধনাগার সূত্রে জানানো হয়নি । ফলে অতীতে যেভাবে মাওবাদী হিংসাত্মক কার্যকলাপে অর্ণব যুক্ত ছিলেন, সে রকম কারওকে ক্লাস করতে দিলে কড়া নিরাপত্তার প্রয়োজন হবে । তাঁদের আশঙ্কা, যদি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অর্ণব কোনও ঘটনা ঘটান সেক্ষেত্রে কী হবে ।