বর্ধমান, 9 মে: মূলত ধান চাষের উপরেই নির্ভরশীল পূর্ব বর্ধমান জেলা । রাজ্যের শস্য ভাণ্ডার বলা হয় এই জেলাকে । ধান প্রধান ফসল । ধান ছাড়াও পাট, আলু, পেঁয়াজ প্রভৃতি চাষ করা হয় । জেলার দু’টি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে অন্যতম বর্ধমান পূর্ব ।
2019 সালে এই আসন থেকে জয়ী হয়ে দ্বিতীয়বারের জন্য সাংসদ হন তৃণমূল কংগ্রেসের সুনীল মণ্ডল । তৃণমূল তাঁকে এবার প্রার্থী করেনি । এবার ড. শর্মিলা সরকারকে প্রার্থী করেছে তৃণমূল কংগ্রেস । বিজেপি প্রার্থী করেছে কবিয়াল বিধায়ক অসীম সরকারকে । সিপিএমের প্রার্থী নীরব খাঁ । রাজনৈতিক মহল বলছে, মূল লড়াই হতে চলেছে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে বিজেপির । তবে সিপিএমের ভোট বড় ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করবে ।
পূর্ব বর্ধমান লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে আছে রায়না, জামালপুর, কালনা, মেমারি, পূর্বস্থলী দক্ষিণ, পূর্বস্থলী উত্তর ও কাটোয়া বিধানসভা । সবটাই কৃষিপ্রধান এলাকা । 2019 সালে যখন বিজেপির অনুকূলে হাওয়া দিয়েছিল, সেই সময়েও এই আসন তৃণমূল কংগ্রেস ধরে রাখে ।
2019 লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেসের সুনীল মণ্ডলের সঙ্গে বিজেপির পরেশচন্দ্র দাসের । সুনীল মণ্ডল জিতেছিলেন 89 হাজার 311 ভোটে । তিনি পেয়েছিলেন 6 লক্ষ 40 হাজার 834 ভোট । বিজেপি প্রার্থী পরেশচন্দ্র দাস পেয়েছিলেন 5 লক্ষ 51 হাজার 523 ভোট । সিপিএমের প্রার্থী ঈশ্বরচন্দ্র দাস পেয়েছিলেন 1 লক্ষ 75 হাজার 920 ভোট । শতাংশের হিসেবে দেখতে গেলে তৃণমূল কংগ্রেস 44.52, বিজেপি 38.32 ও সিপিএমের প্রার্থী 12.22 ভোট পেয়েছিল ।
2009 সালে নির্বাচন কমিশন ডিলিমিটেশন করায় এই বর্ধমান পূর্ব লোকসভা কেন্দ্র গঠন হয় । 2009 সালে এই আসনে জয়ী হন সিপিএমের প্রার্থী অনুপকুমার সাহা । 2014 সালে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী সুনীল মণ্ডল এই আসন থেকে জিতে প্রথম বারের জন্য সাংসদ হন । 2019 সালে তিনি ফের ওই আসন থেকে জেতেন । 2021 সালে বিধানসভা নির্বাচনের আগে তাকে বিজেপির মঞ্চে দেখা যায় । যা নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক । কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস 2021 সালে সরকার গঠন করায় সুনীল মণ্ডল তৃণমূলে ফিরে আসেন ৷ সেই কারণেই তাঁকে এবার আর টিকিট দেওয়া হয়নি বলে তৃণমূল সূত্রে খবর ।
2019 সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের সুনীল মণ্ডল জিতেছিলেন 89 হাজার 311 ভোটে । লোকসভার নিরিখে এখানে যে সাতটা বিধানসভা কেন্দ্র আছে, তার মধ্যে রায়নায় তৃণমূল কংগ্রেস এগিয়ে ছিল 54 হাজার 849 ভোটে ৷ জামালপুরে তৃণমূল কংগ্রেস 3 হাজার 684 ভোটে এগিয়েছিল । কালনা বিধানসভা কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেস এগিয়েছিল 3 হাজার 633 ভোটে । এই কালনা বিধানসভা কেন্দ্রে সিপিএমের ভোট ছিল 19 হাজার 661 ৷ মেমারি বিধানসভা কেন্দ্রেও সিপিএমের ভোট কাটাকাটিতে তৃণমূল কংগ্রেসের এগিয়েছিল 4 হাজার 899 ভোটে । সিপিএমের প্রার্থী এই কেন্দ্রে ভোট পায় 28 হাজার 780 । পূর্বস্থলী দক্ষিণ কেন্দ্রে 21 হাজার 908 ভোটে ও পূর্বস্থলী উত্তর কেন্দ্রে 2 হাজার 705 ভোটে তৃণমূল কংগ্রেস এগিয়েছিল । কাটোয়া কেন্দ্রে অবশ্য বিজেপি লিড পায় 8 হাজার 141 ভোট ।
2021 সালের বিধানসভা নির্বাচনে অবশ্য তৃণমূল কংগ্রেস সব আসনেই জিতে যায় । কিন্তু কোনও কোনও বিধানসভায় 2019 লোকসভার নিরিখে তৃণমূল কংগ্রেসের ভোট কমে যায় । এক নজরে দেখা যাক 2021 সালের বিধানসভা নির্বাচনে বর্ধমান পূর্ব লোকসভা আসনের অন্তর্ভুক্ত বিধানসভাগুলির কী অবস্থা ছিল:
রায়না: তৃণমূল কংগ্রেস ওই আসনে জিতলেও ভোটের মার্জিন কিন্তু অনেকটা কমে যায় । তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী শম্পা ধারা বিজেপির মানিক রায়কে 18 হাজার 205 ভোটে হারান । লোকসভা ভোটের নিরিখে প্রায় 36 হাজার 644 ভোট কম পেয়েছিল তৃণমূল । যা চলতি লোকসভা ভোটে শাসকদলকে কিছুটা হলেও চিন্তায় রেখেছে ।
জামালপুর: তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী অলোক মাঝি 17 হাজার 971 ভোটে বিজেপির প্রার্থী বলরাম ব্যাপারীকে হারিয়ে দেন । কিন্তু লোকসভার নিরিখে তৃণমূলের লিড বৃদ্ধি হয় প্রায় 14 হাজার 287 ৷
কালনা: তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী দেবপ্রসাদ বাগ 7 হাজার 478 ভোটে বিজেপির বিশ্বজিৎ কুন্ডুকে জয়লাভ করেন । লোকসভা নির্বাচনে এই আসনে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী 3 হাজার 633 ভোটে এগিয়েছিল । ফলে লোকসভার নিরিখে তৃণমূল কংগ্রেস ওই আসনে আরও 3 হাজার 845 লিড বাড়াতে সক্ষম হয়েছে ।
মেমারি: তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী মধুসূদন ভট্টাচার্য 23 হাজার 78 ভোটে বিজেপি প্রার্থী ভীষ্মদেব ভট্টাচার্যকে হারিয়ে জয়লাভ করেন । অথচ লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল ওই আসনে 4 হাজার 899 ভোটে এগিয়েছিল । ফলে বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস সেই ভোটের মার্জিন 18 হাজার 179 বেড়ে যায় । যেটা তাদের কিছুটা হলেও স্বস্তি দেয় ।
পূর্বস্থলী দক্ষিণ: তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী স্বপন দেবনাথ বিজেপি প্রার্থী রাজীবকুমার ভৌমিককে 17 হাজার 410 ভোটে হারিয়ে জয়লাভ করেন । কিন্তু যদি 2019 সালের লোকসভা ভোটের মার্জিনের সঙ্গে তুলনা করা হয় তাহলে তৃণমূল কংগ্রেসের লিড কিছুটা হলেও কমেছে । কারণ, লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে ওই আসনে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী 21 হাজার 908 ভোটে এগিয়েছিলেন । ফলে বিধানসভা নির্বাচনে জিতলেও তৃণমূল কংগ্রেসের লিড কমে যায় 4 হাজার 498 ।
পূর্বস্থলী উত্তর: এই আসনে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী তপন চট্টোপাধ্যায় 6 হাজার 706 ভোটে বিজেপি প্রার্থী গোবর্ধন দাসকে হারিয়ে জয়লাভ করেন । লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে তৃণমূল কংগ্রেসের মার্জিন বাড়ে 4001 ।
কাটোয়া: এই বিধানসভা কেন্দ্রটি তৃণমূল কংগ্রেসের দখলে যায় । ওই কেন্দ্রের তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় 9 হাজার 155 ভোটে বিজেপির প্রার্থী শ্যামা মজুমদারকে হারিয়ে জয়লাভ করে । অথচ লোকসভা এই কাটোয়া কেন্দ্রে বিজেপি 8 হাজার 141 ভোটে এগিয়েছিল ।
তবে চলতি নির্বাচনে কোন দল জিতবে, সেই কথা কিন্তু জোর দিয়ে কোনও প্রার্থীই বলতে নারাজ । তবে তাঁরা জেতার ব্যাপারে আশাবাদী বলে জানিয়েছেন ।
তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী ড. শর্মিলা সরকার বলেন, "সব জায়গাতেই মানুষের সাড়া পাচ্ছি । মানুষ যেভাবে আমাকে গ্রহণ করছেন, আমাকে কাছে টেনে নিচ্ছেন, তাতে আমি ভীষণ ভাবে আপ্লুত ও অভিভূত । মনে হচ্ছে সবাই আমার পাশে আছে । সবাই তৃণমূল কংগ্রেসের হয়ে কাজ করছে । সকলের সাহায্য নিয়ে এই বৈতরণী পার করব । যেভাবে মানুষের সাড়া পাচ্ছি, তাতে মনে হচ্ছে আমি জিতব । কিন্তু রেকর্ড ভোটে কি না সেটা বলতে পারব না । সেটা মানুষ বলবে । তৃণমূল সরকার অনেক উন্নয়ন করেছে । মানুষের অনেক চাহিদা আছে সেগুলো আমার নজরে থাকবে । রাস্তাঘাট সমস্ত কিছু তো থাকবেই তবে সবচেয়ে বেশি জোর দেব শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উপরে ।"
বিজেপি প্রার্থী অসীম সরকার বলেন, ‘‘একটা সময় এখানে সিপিএম জিততো । পরে তৃণমূল জিতেছে । কিন্তু তারা যে হারে দুর্নীতি করেছে, তার ফলে এবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে ভোট হচ্ছে । মানুষের এখন বিবেক জেগেছে । আমি শুধুমাত্র মানুষের বিবেক জাগাবার জন্য কথা বলি । ভোট দেওয়া মানুষের অধিকার । মানুষকে ভোট দিতে দেওয়া হোক । তারা যাকে ইচ্ছা তাকে ভোট দিক । আর ভোট ঠিকমতো গুনতে দেওয়া হোক । আর গণনার দিন যেন কোনোরকম কোনও কারচুপি না হয় । তাহলেই বুঝতে পারবেন ফলাফলটা । পদ্ম ফুটতেই থাকবে । সারা বাংলা জুড়ে পদ্ম ফুটবে । বালি চুরি, কয়লা চুরি, গরু চুরি, মিড ডে মিলের টাকা চুরি, একশো দিনের কাজে টাকা চুরি, নারী ধর্ষণ থেকে কী না করেছেন তৃণমূলের নেতারা । সব নেতাদের বলবো না । কারণ, কিছু ভালো মানুষও আছে । বেশিরভাগ ওরা দুর্নীতিগ্রস্থ । তাই দুর্নীতির বিরুদ্ধেই ভোট হবে ।’’
বর্ধমান পূর্ব লোকসভা কেন্দ্রের সিপিএমের প্রার্থী নীরব খাঁ বলেন, ‘‘আমাদের প্রতি মানুষের যথেষ্ট সহানুভূতি আছে । মানুষ পাশে আছে । কাটোয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, গঙ্গার উপরে ব্রিজ আছে, তাঁত শিল্পীদের দুর্দশা, কৃষকদের দুর্দশা, গঙ্গার নদী ভাঙন এই সব ইস্যুকে সামনে রেখেই প্রচার চলছে । কোনও প্রার্থী আমার ফ্যাক্টর নয়, সিম্বল নিয়েই ফ্যাক্টর । মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি ধর্ম দিয়ে মানুষের পেট ভরে না । মানুষের রুটিরুজির বিষয়কেই সামনে এনেছি । ফলে আমরা এগিয়ে আছি । এনআরসি নিয়ে প্রচার করেছি । বিজেপি এটা নিয়ে রাজনীতি করছে । আমরা চাই অযোগ্যদের বাতিল করে যোগ্যদের নিয়োগ করা হোক । বিগত পঞ্চায়েত ভোটে আমাদের ভোট অনেক বেড়ে গিয়েছে । ফলে আমরা আশাবাদী । আমরা জিতবো । আমাদের কাছে কেউ প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। দুটো দলই সমান ।’’
তবে রাজনৈতিক মহলের মতে, এই আসনে এখনও পর্যন্ত তৃণমূল কংগ্রেস কিছুটা হলেও বিজেপির থেকে এগিয়ে আছে । কালনা, মেমারি, পূর্বস্থলী, জামালপুর এলাকায় মতুয়া ভোট কিছুটা ফ্যাক্টর হতে পারে তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে । সেই সঙ্গে রায়না, মেমারি, জামালপুর-সহ বেশ কিছু বিধানসভায় তৃণমূল কংগ্রেসের গোষ্ঠীকোন্দল তৃণমূলের চিন্তার বিষয় । যদিও 2019 লোকসভার তুলনায় 2021 সালে বর্ধমান পূর্ব লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেস 10 হাজার 962 ভোট বাড়াতে সক্ষম হয়েছে । তবে রায়না, জামালপুর, পূর্বস্থলী দক্ষিণ, পূর্বস্থলী উত্তর কিছুটা হলেও তৃণমূলকে চিন্তায় রেখেছে । অন্যদিকে বিজেপি প্রার্থী অসীম সরকারের সঙ্গে নিচুতলার কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকাটা বিজেপিকে কিছুটা হলেও পিছিয়ে রাখছে বলে মত রাজনৈতিক মহলের ।
আরও পড়ুন: