বারাসত, 29 মে: উন্নয়ন বনাম অনুন্নয়ন । প্রধানত এই দুই ইস্যুই বারাসত লোকসভা কেন্দ্রের নির্বাচনে বড় হাতিয়ার হতে চলেছে শাসক ও বিরোধী শিবিরের কাছে । পরপর তিনবারের সাংসদ তথা এই কেন্দ্রের তৃণমূলের চিকিৎসক প্রার্থী কাকলি ঘোষদস্তিদারের ভোট বৈতরণী পার হতে যেখানে অস্ত্র 'উন্নয়ন', সেখানে বাম প্রার্থী সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় ও বিজেপি প্রার্থী স্বপন মজুমদার অনুন্নয়ন ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সেই অস্ত্রেই তৃণমূল প্রার্থীকে ঘায়েল করতে চাইছেন নির্বাচনী লড়াইয়ে । স্বভাবতই এই ইস্যুকে হাতিয়ার করে ভোট বাক্সে প্রতিফলন ঘটাতে বাম, বিজেপি ও তৃণমূল - কেউই কোনও কসুর করছে না । তবে, উন্নয়ন না অনুন্নয়ন ! এই লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত কে বাজিমাত করবে, তা অবশ্য জানা যাবে ভোটের ফলাফল প্রকাশের পরই ।
কলকাতা লাগোয়া এই কেন্দ্রটি উত্তর 24 পরগনার আর পাঁচটা কেন্দ্রের মতো সমান গুরুত্বপূর্ণ । বারাসতের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বহু ইতিহাসও । কথিত আছে, একসময় নাকি নীল বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল এই ছোট্ট জনপদ থেকেই । শুধু কী তাই ! নবাব সিরাজ উদ-দ্দৌলাহের পা-ও পড়েছিল এই বারাসতে । মোঘল আমলে এই এলাকাকেই তিনি হাতি ও ঘোড়ার বিশ্রামাগার হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন । পরবর্তীকালে সেই জায়গাটিই লোকমুখে প্রচলিত হয়ে ওঠে হাতিপুকুর নামে । লর্ড হেস্টিং থেকে শুরু করে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো মহান ঋষি-মনীষীদের পায়ের ধুলোও পড়েছিল বারাসতে । এই সমস্ত ঐতিহাসিক গুরুত্বের পাশাপাশি নির্দিষ্ট ছন্দে আবর্তিত হয়েছে বারাসতের নিজস্ব রাজনীতি ।
রাজনৈতিক দিক থেকে এখানকার মানুষ যথেষ্ট সচেতন । নিজের পছন্দসই জনপ্রতিনিধিকে তাঁরা বেছে নিয়েছেন নিজের মতো করে । সবচেয়ে বড় কথা, বারাসতের রাজনৈতিক পরিমণ্ডল গড়ে উঠেছে বেশকিছু ইস্যুকে কেন্দ্র করে । কখনও দুষ্কৃতী দৌরাত্ম্য । আবার কখনও রাজনৈতিক অস্থিরতা । ভোট এলেই এসব যেন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এখানে । এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না । নির্বাচনী আবহে মাঝেমধ্যেই গন্ডগোলে জড়িয়ে পড়ছেন রাজনৈতিক দলগুলি । তারই মধ্যে সমানে সমানে টক্কর দিয়ে চলেছেন শাসক ও বিরোধী শিবিরের প্রার্থীরা । তবে, বারাসতে কি কাকলি এবার নিজের কুর্সি রক্ষা করতে পারবেন ? নাকি তাঁর ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলা বিজেপি কুর্সি দখল করবে এই কেন্দ্রে ? তারই উত্তর খুঁজল ইটিভি ভারত ।
আরও পড়ুন:
বারাসত কেন্দ্রের রাজনৈতিক ইতিহাস: একসময় বামেদের দুর্ভেদ্য ঘাঁটি ছিল বারাসত । 1952 সালে আত্মপ্রকাশ করা এই লোকসভা কেন্দ্রটির বেশিরভাগ সময় শাসন করেছে বামেরা । 1977 থেকে 1996 পর্যন্ত এই কেন্দ্র থেকেই দাপটের সঙ্গে জিতে এসেছে 'সিংহ' বাহিনী অর্থাৎ ফরওয়ার্ড ব্লক । বারাসত কেন্দ্রেই পাঁচবারের সাংসদ ছিলেন বাম শরিক ফরওয়ার্ড ব্লকের চিত্ত বসু । তার আগে অবশ্য কখনও কংগ্রেস, আবার কখনও সিপিএমের দখলে ছিল গুরুত্বপূর্ণ এই লোকসভা কেন্দ্রটি ।
তবে, দীর্ঘদিন সাংসদ থাকায় এখনও প্রয়াত চিত্ত বসুর নাম উচ্চারিত হয় সবার আগে । বাম-ডান, সবপক্ষই তাঁর নিপাট আচরণ এবং কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশংসা করে থাকে । ফরওয়ার্ড ব্লক তো আবার ভোট এলেই প্রয়াত নেতার আদর্শকে কাজে লাগাতে কোনও কসুর করে না । এবারও তেমনটাই হয়েছে বাম প্রার্থী তথা ফরওয়ার্ড ব্লকের জেলা সম্পাদক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও ।
তাঁর মুখেও ঘুরেফিরে এসেছে সেই প্রয়াত চিত্ত বসুর উন্নয়নের কর্মকাণ্ড ! তবে, তাতে চিড়ে ভিজবে কি না, তা নিয়ে রয়েছে যথেষ্ট সংশয় । কারণ, গত কয়েকটি নির্বাচনে বামেদের ভোট কমতে কমতে এখন তলানিতে এসে ঠেকেছে । নির্বাচনে সাফল্যের চেয়ে ভোট ব্যাংক ধরে রাখাই যেন এই মুহূর্তে বড় চ্যালেঞ্জ বামেদের কাছে । সেই জায়গায় তাঁদের পিছনে ফেলে শাসকদলের প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে গেরুয়া শিবির ।
বারাসত লোকসভা কেন্দ্রের জনবিন্যাস: শহর এবং গ্রামীণ এলাকা নিয়ে বারাসত কেন্দ্র গঠিত হওয়ায় এখানকার জনবিন্যাস একটু আলাদা ! এই লোকসভার অন্তর্গত দেগঙ্গা বিধানসভা এলাকায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বসবাস বেশি হলেও অন্যান্য বিধানসভা এলাকাতে কিন্তু বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষ বসবাস করেন । হাবড়া, অশোকনগর ও বারাসত - এই তিনটি বিধানসভা কেন্দ্রে আবার ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মতুয়া সম্প্রদায় । যাঁদের অধিকাংশই ওপার বাংলা থেকে এসেছেন এপার বাংলাতে । ভোটারও হয়েছেন এই কেন্দ্রের । এই মতুয়া ভোটও এবারে বড় ফ্যাক্টর হতে পারে বারাসত কেন্দ্রের কুর্সি দখলে । এমনটাই মত ওয়াকিবহাল মহলের ।
বিধানসভা এলাকা: বারাসত লোকসভা কেন্দ্রের অধীনে সাতটি বিধানসভা হল যথাক্রমে - 1. বারাসত, 2. মধ্যমগ্রাম, 3. দেগঙ্গা, 4. হাবড়া, 5. অশোকনগর, 6. রাজারহট-নিউটাউন, 7. বিধাননগর ৷
অতীতের নির্বাচনের ফলাফল: 1952 সালের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের টিকিটে জিতে এই কেন্দ্র থেকে প্রথম সাংসদ নির্বাচিত হন অরুণচন্দ্র গুহ । এর পরের তিনবারের (1962, 1967, 1972) নির্বাচনেও জয়লাভ করেন তিনি । 1971 ও 1977 সালে পরপর দু'বার এই কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়ে সাংসদ নির্বাচিত হন সিপিএমের রণেন্দ্রনাথ সেন ।
1977, 1980, 1984, 1989, 1991 - পরপর পাঁচবার বারাসত কেন্দ্র থেকে জয়ী হন ফরওয়ার্ড ব্লকের চিত্ত বসু । 1998 ও 1999 সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে উঠে আসে এই কেন্দ্রে । তৃণমূলের রঞ্জিত পাঁজা জয়ী হয়ে পরপর দু'বার সাংসদ হন এখান থেকে । 2004 সালের নির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থীকে অবশ্য হারতে হয় বাম প্রার্থী সুব্রত বসুর কাছে । 2009-র লোকসভা নির্বাচনে আবারও ঘুরে দাঁড়ায় তৃণমূল । সেবার বাম প্রার্থী সুদিন চট্টোপাধ্যায়কে হারিয়ে জয়ী হন তৃণমূলের কাকলি ঘোষ দস্তিদার । এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে । 2014 ও 2019 - দুই নির্বাচনেই দাপটের সঙ্গে জিতে পুনরায় সাংসদ নির্বাচিত হন চিকিৎসক কাকলি ঘোষ দস্তিদার । এবারও তিনি লড়াইয়ে ময়দানে নেমেছেন চতুর্থবার সাংসদ হওয়ার লক্ষ্যে ।
আরও পড়ুন:
চব্বিশের লড়াই ও সমীকরণ: চব্বিশের লড়াইয়ে যুযুধান দুই পক্ষ সম্মুখ সমরে নেমেছে । একজন তৃণমূলের কাকলি ঘোষ দস্তিদার । অন্যজন পদ্ম শিবিরের স্বজন মজুমদার । ফরওয়ার্ড ব্লকের সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ঠিকই । কিন্তু, প্রেস্টিজ ফাইটে তিনি আদৌও তৃণমূল ও বিজেপির সঙ্গে এঁটে উঠতে পারবেন কি না, তা বলবে সময়ই ! তবে, গত লোকসভা নির্বাচন থেকেই গেরুয়া শিবিরের শক্তি কিন্তু ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করেছে বারাসত কেন্দ্রে । 2019-এর নির্বাচনে 38 শতাংশেরও বেশি ভোট পেয়েছিলেন বিজেপি প্রার্থী ।
শুধু তাই নয়, হাবড়া এবং বিধাননগর কেন্দ্রে হারের মুখ দেখতে হয়েছিল তৃণমূল প্রার্থীকে । দেগঙ্গা বিধানসভা থেকে লক্ষাধিক ভোটে লিড পাওয়ায় কাকলির জয়ের পথ সুনিশ্চিত হয়েছিল । তা না হলে সেবারই ফলাফল কাকলির বিপক্ষে যেতে পারত । এবার তো গেরুয়া শিবিরের সঙ্গে আইএসএফ-ও দাপট দেখাতে শুরু করেছে । সেক্ষেত্রে তৃণমূলের ভোট ব্যাংকে থাবা বসাতে পারে ভাইজানের দল । আর তা যদি সত্যি হয়ে যায়, তাহলে কিন্তু তিনবারের সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদারের কপালে চিন্তার ভাঁজ যে পড়তে বাধ্য, তা নির্দ্বিধায় বলাই যায় !
যদিও এসবকে গুরুত্ব দিতে নারাজ শাসকদলের চিকিৎসক প্রার্থী কাকলি ঘোষ দস্তিদার । তাঁর দাবি, এবারও মানুষ ভোট দিয়ে সাংসদ নির্বাচিত করবেন তাঁকে । কোনও অংকই কাজ করবে না নির্বাচনী লড়াইয়ে । পালটা বিজেপি প্রার্থী স্বপন মজুমদারও কাকলিকে হারাতে আদাজল খেয়ে ভোট ময়দানে নেমেছেন । জেতার ব্যাপারে তিনিও যথেষ্ট আশাবাদী ।
তবে, শেষ হাসি কে হাসবেন সেদিকেই এখন আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন বারাসতবাসী !
আরও পড়ুন: