কলকাতা, 25 ফেব্রুয়ারি: দেড়শো বছরের ইতিহাসে আরও নতুন পদক্ষেপ আলিপুর চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের । আলিপুর চিড়িয়াখানার গ্রন্থাগার এবার সাধারণ মানুষের জন্য খুলে দেওয়া হবে । প্রতিষ্ঠার দিন থেকে আজ পর্যন্ত এই লাইব্রেরি সাধারণ দর্শক বা মানুষজন ব্যবহার করতে পারেন না । তবে চলতি বছর থেকেই সেই সুযোগ হাতে আসার সম্ভাবনা ৷ ইতিমধ্যেই তার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে ।
চিড়িয়াখানার প্রথম সুপারিনটেনডেন্টের হাতে লেখা চিঠি-সহ নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও লাইব্রেরিতে থাকা বই ডিজিটালাইজড করা হচ্ছে । প্রায় 1400-রও বেশি দুষ্প্রাপ্য বই ডিজিটাল কপি করা হচ্ছে । সূত্রের দাবি, এই গ্রন্থাগার যেমন সাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হবে, ঠিক তেমনই চিড়িয়াখানার ওয়েবসাইটের গ্রন্থাগারে থাকা বিপুল পরিমাণ বইয়ের ডিজিটাল কপি আপলোড করা হবে । সেই প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু করা হয়েছে । রাজ্যের বনদফতর এবং চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ চলতি বছরের মধ্যে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার লক্ষ্য নিয়েছে । রাজ্যের বনমন্ত্রী বীরবাহা হাঁসদাও এই বিষয়টি ইটিভি ভারতের কাছে নিশ্চিত করেছেন ।
দক্ষিণ কলকাতায় অবস্থিত উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান আলিপুর জুলজিক্যাল গার্ডেন । এটি 1875 সালে প্রতিষ্ঠিত দেশের প্রাচীনতম প্রাণিবিদ্যা উদ্যান, যা 150 বছরে ধরে ভারতে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এবং ইতিহাস শিক্ষার অন্যতম আকর্ষণীয় প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছে । আলিপুর চিড়িয়াখানা বিভিন্ন প্রজাতির সংরক্ষণ এবং জীববৈচিত্র্যের প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে । বছরের পর বছর এটি দেশীয় এবং বহিরাগত উভয় প্রজাতি-সহ বিভিন্ন প্রাণীর অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে ।
চিড়িয়াখানার এক পদস্থ আধিকারিক বলেন, "এখানে অনেক দেশীয় প্রাণীর বাসস্থান; যেমন বাঘ, সিংহ, হাতি ৷ আবার বিদেশি প্রাণী যেমন জিরাফ, জেব্রা, শিম্পাঞ্জি, লেমুর ইত্যাদি-সহ বিভিন্ন পাখি ও সরীসৃপও আছে । যেখানে দর্শনার্থীরা এই দুর্দান্ত প্রাণীগুলি সম্পর্কে জানার ও দেখার সুযোগ পান । এবার তাঁরা এগুলির বিষয়ে আরও বিস্তারিত তথ্য জানতে পারবেন লাইব্রেরিতে থাকা বই পড়ে । এতদিন এই লাইব্রেরি শুধুমাত্র চিড়িয়াখানার পদস্থ আধিকারিকরা ব্যবহার করতেন ।"

আলিপুর চিড়িয়াখানার গ্রন্থাগারটি 'স্যার জ্যোতিন্দ্রমোহন টেগোর - কেসিআইই অফ ক্যালকাটা' নামে নামাঙ্কিত ৷ চিড়িয়াখানা শুরুর সময়ে তিনি চিড়িয়াখানার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন । তাঁর ইচ্ছা ছিল, প্রাণীদের চিকিৎসা সংক্রান্ত পৃথিবীর সমস্ত প্রয়োজনীয় বই এই গ্রন্থাগারে থাকবে । সেই উদ্দেশ্যে তিনি চিড়িয়াখানায় প্রচুর অর্থ দান করেন । সেই অর্থের সাহায্যে 1898 সালে চিড়িয়াখানায় এই গ্রন্থাগার গড়ে তোলা হয় ।

চিড়িয়াখানার আরেক পৃষ্ঠপোষক স্যার জন এডগার এই গ্রন্থাগারের জন্য বইয়ের আলমারি দান করেন । বর্তমানে এখানে প্রায় 1400-রও বেশি বই রয়েছে ৷ এর মধ্যে অধিকাংশই দুষ্প্রাপ্য । সেই তালিকায় চিড়িয়াখানার 150 বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত বইটিও যুক্ত হবে । এমনকি, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বন বিভাগ এবং রাজ্য চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ দ্বারা প্রকাশিত নানা বইও সেই তালিকায় সংযোজিত হবে ।

আলিপুর চিড়িয়াখানার প্রথম সুপারিনটেনডেন্ট রাম ব্রহ্ম সান্যাল । তাঁর বিশাল কর্মকাণ্ড এবং লেখালেখিও মিলবে গ্রন্থাগারে । 1851 সালে রাম ব্রহ্ম সান্যাল মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলাতে জন্মগ্রহণ করেন । পরবর্তীতে তিনি ডা. জন এন্ডারসন এবং ডা. জর্জ কিংয়ের সংস্পর্শে আসেন । এঁদের প্রভাবে, রাম ব্রহ্ম সান্যাল একজন সাধারণ কর্মী হিসাবে আলিপুর চিড়িয়াখানায় নিযুক্ত হন । অধ্যাবসায় এবং কর্মদক্ষতার গুণে তিনি 1878 সালের এপ্রিল মাসে কার্যনির্বাহী সুপারিনটেনডেন্ট পদে উন্নীত হন । পরবর্তীকালে, 1880 সালের এপ্রিল মাসে তিনি চিড়িয়াখানার প্রথম সুপারিনটেনডেন্ট পদে নিযুক্ত হন ।

চিড়িয়াখানায় প্রাণীদের খাঁচায় রাখার পদ্ধতি, তাদের খাদ্যগ্রহণ, প্রজননকালে আচরণ এবং তাদের চিকিৎসা সম্পর্কিত বিষয়গুলি তিনি প্রতিদিন পর্যবেক্ষণ ও লিপিবদ্ধ করতেন । পরবর্তীকালে তিনি 'এ হ্যান্ডবুক অফ দ্য ম্যানেজমেন্ট অফ ওয়াইল্ড অ্যানিম্যালস ইন ক্যাপ্টিভিটি ইন লোয়ার বেঙ্গল' নামে বইটি লিখতে উৎসাহিত হন । এই ধরনের বই বিশ্বে প্রথম লেখা হয় এবং বইটি 1892 সালে প্রকাশিত হয় । সেই দুষ্প্রাপ্য বইয়ের প্রতিলিপিও গ্রন্থাগারে এবং চিড়িয়াখানার ওয়েবসাইটে ডিজিটাল আকারে পাওয়া যেতে পারে ।

রাজ্যের বনমন্ত্রী বীরবাহা হাঁসদা বলেন, "আলিপুর চিড়িয়াখানার লাইব্রেরিতে বহু মূল্যবান এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে । আমরা চাই সেগুলো যাতে সংরক্ষিত হয় এবং হারিয়ে না যায় । সেগুলো যদি সঠিক কাজে লাগানো যায়, তার জন্য আমরা চিন্তাভাবনা করেছি এবং বিস্তারিত আলোচনাও হয়েছে । এই বিপুল তত্ত্ব ভাণ্ডার কীভাবে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায় সে দিকটাও ভাবনাচিন্তা করা হয়েছে । বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে ইতিমধ্যে প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে । আমরা সর্বতোভাবে চেষ্টা করছি কীভাবে এই কাজ এ বছরের মধ্যে শেষ করা যায় ।"
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজ্য বন দফতরের এক কর্তা বলেন, "বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণীর বসবাস ছাড়াও চিড়িয়াখানাটি বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীদের প্রজনন বাড়াতে নানা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে । বন্যপ্রাণী সুরক্ষা সম্পর্কে জনসচেতনতামূলক প্রচার, সংরক্ষণের চেষ্টায় গবেষণা ও শিক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠেছে এই চিড়িয়াখানা । ফলে, দর্শকদের মূল্যবান তথ্য এবং পরিবেশ রক্ষায় নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য ।"