কলকাতা, 1 জানুয়ারি: প্রয়াত কিংবদন্তি ফুটবলার মহম্মদ হাবিবের শহরে গোলের নজির ছুঁয়ে শ্রদ্ধা রবি হাঁসদার । কিংবদন্তিকে বাঙালি স্ট্রাইকারের সেরা শ্রদ্ধাঞ্জলির মাধ্যম এর থেকে ভালো কিছু হওয়ার ছিল না । রবি আলোয় মিঞা তর্পণে ফুটবলের জয়গান । একটি সন্তোষ ট্রফিতে এক ডজন গোল । তাও আবার বাঙালি স্ট্রাইকারের পা থেকে ৷ বিদায়ী বছরের শেষ দিনে এর থেকে ভালো ছবি বাংলার ফুটবলের জন্যও বোধহয় হতে পারত না ।
ফুটবল মানেই সংগ্রামের গল্প । আইএসএল পরবর্তী ভারতীয় ফুটবলে সেই ছবিটা আরও কঠিন । স্বীকৃতির নিশ্চয়তা নেই । প্রচারের আর্ক লাইট পড়ার জো নেই । শুধুই আছে বঞ্চনা ও তাচ্ছিল্যের গল্প । ব্যর্থতার সামান্য ঠোকাঠুকিতে যে গল্পে কটাক্ষের শর তড়িৎ গতিতে ছুটে আসে । রবি হাঁসদার সন্তোষ ট্রফিতে সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার পেছনে রয়েছে সেইরকম লড়াইয়ের কথা ।
পূর্ব বর্ধমানের ভাতার থানার অন্তর্গত মশারু গ্রামের আদিবাসী পরিবারের ছেলে রবি । দ্রারিদ্রের সেখানে বাস বারোমাস । নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর অবস্থায় চর্মগোলককে সঙ্গী করে জীবনের রাজপথে দৌড়নোর ইচ্ছে সাধারণভাবে বিলাসিতা মনে হতে পারে । পায়ে পায়ে প্রতিকুলতার মাঝে রবির ফুটবলার হয়ে ওঠা । রবির ফুটবল দেখতে মাঠে নিয়মিত আসতেন ওর বাবা । স্বপ্ন দেখতেন ছেলে ফুটবলার হয়েছে । সেই বাবার আচমকা মৃত্যু দিশেহারা করে দিয়েছিল রবিকে । মনে হয়েছিল, এবার ফুটবলটাই ছেড়ে দিতে হবে । ফুটবল এবং জীবনজীবিকার টানাপোড়েনের মধ্যে বাবার অপূর্ণ ইচ্ছেকে মর্যাদা দেওয়াকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন রবি । তাই মাস ছ'য়েক আগে খেলা ছেড়ে বাবার টোটো নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েননি । কিংবা মায়ের সঙ্গে চাষবাসের কাজে নেমে পড়েননি । আর সে জন্যই চলতি সন্তোষ ট্রফির সর্বোচ্চ স্কোরার হিসেবে লেখা রইল এক স্ট্রাইকারের নাম, তিনি রবি হাঁসদা ।
কল্যাণীতে বাছাই পর্ব ও হায়দরাবাদে মূলপর্ব মিলিয়ে বছর পঁচিশের রবির ঝুলিতে মোট 12 গোল । কল্যাণীতে প্রাথমিক পর্বে শেষ খেলার দিন উপস্থিত ছিলেন রবির স্ত্রী এবং দেড় বছরের ছোট্ট সন্তান । মাঠের ধারে জালের বাইরে অপেক্ষারত গর্বিত স্ত্রী’র সুখের হাসি, সন্তানের মুখে বাবার জন্য আদুরে দুষ্টুমিতে রবির মুখে গোধুলির আলো । সেদিন তিনি বলছিলেন জীবনের লড়াইয়ের কথা । বলেছিলেন আর্থিক অনিশ্চয়তা নিয়ে চিন্তার কথা ।
|
পূর্ব বর্ধমানের ভাতার থানার অন্তর্গত মশারু গ্রামের আদিবাসী পরিবারের ছেলের ফুটবলের হাত ধরে জীবনের রাজপথে দৌড়নোর ঋত্বিক অসিত রায় । জনাইয়ের এই ফুটবল কর্তার হাত ধরে কলকাতা লিগে কাশীপুর সরস্বতী ক্লাবে সই করেছিলেন রবি । সেখান থেকে রেনবো ঘুরে কাস্টমসের হয়ে খেলে বাংলা দলের হয়ে জাতীয় গেমসে প্রতিনিধিত্ব । বাংলাকে জাতীয় গেমসে চ্যাম্পিয়ন করায় বড় ভূমিকা ছিল রবির । তারপরেও ছবিটা উজ্জ্বল হয়নি । সন্তোষ ট্রফির বাছাই পর্বে খেলতে গিয়ে 2023 সালের শুরুতে হাঁটুতে চোট । যার জেরে বছরটাই মাঠের বাইরে কেটেছিল । রবির সেইসময় রুটিরোজগার ছিল ‘খেপ’ খেলা । চোটের ধাক্কায় সেটাও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভীষণই হতাশায় ডুবে গিয়েছিলেন । এই সময়ে পরিত্রাতা হন কাস্টমস ক্লাবের কর্তারা । এই যোগাযোগে ফের রবিদয় । কিন্তু প্রতিবন্ধকতা রবির প্রতিটি চলার বাঁকে ।
এ বছর বাবার আচমকা মৃত্যু । পাশে ফের কাস্টমস ক্লাবের কর্তারা । কলকাতা লিগে 9 গোল করার পরে সন্তোষ ট্রফিতে একডজন রবি-ম্যাজিক । সুনীল ছেত্রীর ভক্ত এবার সামনে তাকাতে চান । বাবাকে হারানোর আক্ষেপ চোখে-মুখে । কয়েকটি কথার পরেই প্রয়াত বাবার কথা বলেন রবি । সন্তোষ ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হলে বাংলা দলকে সংবর্ধনা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন রাজ্যের ক্রীড়ামন্ত্রী । ইস্টবেঙ্গল ক্লাবও সংবর্ধনা দেওয়ার কথা বলেছে ।
মা, স্ত্রী আর দেড় বছরের মেয়েকে নিয়ে বাঁচার স্বপ্ন রবির মুখে । আইএসএলের টিমে সুযোগ পেয়ে নিজেকে সফল স্ট্রাইকার হিসেবে প্রমাণ করার স্বপ্নও রয়েছে । তারপর জাতীয় দলের দরজা খোলার চেষ্টা । লক্ষ্যপূরণের জন্য রবি সন্তোষ ট্রফিতে নিজেকে নিঙড়ে দিয়েছেন । সঞ্জয় সেনের প্রশিক্ষণাধীন বাংলা দলের এই সাফল্য আত্মত্যাগের রূপকথা । বিদায়ী বছরের শেষ রাতে নিজামের শহরে রবি তেজে বাংলার ফুটবলের নতুন সূর্যোদয় । 2025 সালে বাংলার ফুটবল এখন নতুন রবির আলোয় ভরে ওঠার অপেক্ষায় ।