গত বছরের 7 অক্টোবর থেকে পশ্চিম এশিয়া উত্তাল । হামাস, হিজবুল্লা, হুথি এবং ইরাক ও সিরিয়া জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ইরানের মদতপুষ্টদের সঙ্গে লড়াই করছে ইজরায়েল । গত 7 অক্টোবর হামাস ইজরায়েলি নাগরিকদের ওপর হামলা চালায় ৷ ইজরায়েল প্রাথমিকভাবে গাজায় হামাসকে মোকাবিলা করার চেষ্টা করেছিল ৷ তবে, হিজবুল্লা হামাসকে সমর্থন করায় ইজরায়েল বাধ্য হয় লেবাননের দিকে আক্রমণ করতে ৷ ইজরায়েল বড় সংঘাত এড়িয়ে পুরো লড়াইকে স্থানীয় এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করেছিল ৷ তবে, এই গোষ্ঠীগুলির প্রতি ইরানের দ্ব্যর্থহীন সমর্থন ইজরায়েলকে ঝুঁকি নিতে বাধ্য করেছে ।
এই বছরের পয়লা এপ্রিল, ইজরায়েল দামাস্কাসে একটি ইরানি কূটনৈতিক কেন্দ্রকে আক্রমণ করে ৷ সেই হামলায় সাতজন ইরানি আইআরজিসি (ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কর্পস) কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয় । ইরান প্রতিশোধ নিতে বাধ্য হয় । যদি এই আক্রমণকে উপেক্ষা করতে পারত ইরান, তাহলে ইজরায়েল আরও উৎসাহিত হতো এবং ইরানের নেতৃত্বকে দুর্বল হিসেবে প্রতিপন্ন করত ৷
13 এপ্রিল ইরান ইজরায়েলের দিকে 300টিরও বেশি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ব্যবহার করে পালটা আক্রমণ করে ৷ সেই সময় শুধু সামরিক ঘাঁটিগুলিকেই নিশানা করা হয় ৷ ফলে ওই হামলায় যথেষ্ট সতর্কতা দেওয়া গিয়েছিল ৷ এর উদ্দেশ্য ছিল দ্বন্দ্বকে বড় করা নয় ৷ বরং অভ্যন্তরীণ চাপকে কমানো ৷ আর একটি বার্তা পাঠানো যে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেও হামলা করবে ইরান ৷ কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার আগেই ধ্বংস হয়ে যায় । ইজরায়েল 19 এপ্রিল অনুরূপ হামলা চালিয়ে প্রতিশোধ নেয় ৷ সেই হামলায় হতাহতের ঘটনা এড়ানো যায় ৷ তবে, একটি ইরানি এস-300 ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যায় । তেল আভিভের বার্তা ছিল যে ভবিষ্যতে ইরানের কৌশলগত প্রতিষ্ঠানগুলিকে নিশানা করা হতে পারে । এর পর সংঘর্ষের অবসান ঘটে ।
হামাস ও হিজবুল্লার শীর্ষ নেতাদের হত্যা-সহ লেবাননে সাম্প্রতিক ইজরায়েলি হামলা ইরান ও ইজরায়েলের মধ্যে উত্তেজনা নতুন করে তৈরি হয়েছে ৷ তেহরানে হামাসের নেতা ইসমাইল হানিয়া নিহত হওয়ার পর ইরান কোনও প্রতিক্রিয়া জানায়নি । এটা সম্ভবত তেল আভিভকে উৎসাহিত করেছিল । ইরানের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্বাস নীলফরৌশানের পাশাপাশি হিজবুল্লা নেতা হাসান নাসরুল্লার হত্যা এবং লেবাননে ইজরায়েলের স্থল আক্রমণ, যা পালটা আক্রমণে বাধ্য করে ইরানকে । তেহরান তার মদতপুষ্টদের জন্য চাপে পড়ে । পদক্ষেপ করতে ব্যর্থ হলে হিজবুল্লার উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ চলে যেত ৷
যখন শান্তি আলোচনা চলছিল, ইজরায়েলের কাছে তখন লেবানন ও গাজার বিরুদ্ধে আক্রমণ বন্ধ করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থেকে কোনও চাপ আসেনি ৷ ইজরায়েল ও হিজবুল্লা শান্তি চুক্তির পথে অনেকটাই অগ্রসর হয়ে গিয়েছিল বলে তথ্য পাওয়া গিয়েছে ৷ যাই হোক, এটা ইজরায়েলকে হিজবুল্লার উপর আক্রমণ এবং তাদের সামরিক শক্তি ব্যবহার থেকে বিরত রাখত । এটা এখন স্পষ্ট যে কোনও শান্তি আসবে না । ইজরায়েলকে তার আক্রমণ চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে ৷ কারণ, গত 7 অক্টোবরের হামলায় তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং তাদের পালটা আঘাত করার অধিকার রয়েছে । একই সঙ্গে ইরানকে সংঘাত বৃদ্ধি হওয়া থেকে বিরত রাখা হচ্ছিল ।
সর্বশেষ হামলায় ইরান ইজরায়েলি সামরিক ঘাঁটিগুলিকে নিশানা করে প্রায় 200 ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে ৷ রাশিয়ার মাধ্যমে পশ্চিমে তথ্য দেওয়া হয়েছে । এবার আগাম সতর্কতা ছিল কয়েক ঘণ্টার । বেশিরভাগ ক্ষেপণাস্ত্র উড়ে গিয়ে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে । ইজরায়েল সূত্রে জানা গিয়েছে, মাটিতে সামান্য ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে । তেহরান বলেছে যে তাদের সংঘাত বৃদ্ধি করার কোনও ইচ্ছা নেই ৷ তবে, ইজরায়েল পালটা আঘাত করলে তারাও হামলা করবে । ইরান জানে যে তাদের সামরিক বাহিনী পশ্চিমী বিশ্ব সমর্থিত ইজরায়েলের চেয়ে দুর্বল । ইরান শুধুমাত্র রাশিয়া ও চিনের কূটনৈতিক সমর্থনের অধিকারী ।
ইজরায়েল প্রতিশোধ নেওয়ার শপথ করেছিল । যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দাবি করে যে ইজরায়েলের প্রতিশোধ নেওয়ার অধিকার রয়েছে ৷ তবে তারা ইরানের পারমাণবিক ক্ষেত্রগুলিকে নিশানা করার অনুমোদন দেয়নি ৷ পারমাণবিক ক্ষেত্রগুলি সর্বদা ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর জন্য উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ৷ তাই তিনি ইরানের পারমাণবিক ক্ষেত্রগুলি ধ্বংস করতে বদ্ধপরিকর । নেতানিয়াহু উল্লেখ করেছেন, ‘ইরান আজ রাতে একটি বড় ভুল করেছে এবং তারা এর মাশুল দেবে ।’
ইজরায়েলের একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনী হয়তো থাকতে পারে, কিন্তু একটি ছোট দেশ হওয়ায় তাদের কৌশলগত গভীরতার অভাব রয়েছে এবং তাই তারা বাফার জোন বাড়ানোর পাশাপাশি অপারেশনকে নিজেদের মাটি থেকে দূরে রাখতে পছন্দ করবে । লেবাননে ইজরায়েলের বর্তমান আক্রমণের উদ্দেশ্য হল সীমান্তের কাছাকাছি বসবাসকারী জনসংখ্যাকে রক্ষা করার জন্য একটি বাফার জোন তৈরি করা ।
আয়তনে বড় হলেও ইরান নিজেদের কাজের মাধ্যমে বেশিরভাগ আরব রাষ্ট্রের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে ৷ তাই সেখানে ইজরায়েলি হামলার ক্ষেত্রে তাদের কাছ থেকে কোনও সহানুভূতি বা সমর্থন পাওয়ার সম্ভাবনা নেই । ইরানের মদতপুষ্টরা এর আগে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর তেল উৎপাদনস্থলগুলিকে নিশানা করেছে । তেহরান হয়তো রিয়াদের সঙ্গে সম্পর্ক নতুন করে তৈরি করেছে, কিন্তু সেই সম্পর্কে কোনও ভালোবাসা নেই ৷ কোনও দেশের তাদের সমর্থনে আসার সম্ভাবনা নেই । ভারতে ইরানের রাষ্ট্রদূত জানিয়েছেন যে যেহেতু ভারতের ইরান ও ইজরায়েল উভয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, তাই ভারত 'ইজরায়েলকে যুদ্ধ বন্ধ করতে রাজি করাতে পারে ।'
তাছাড়া ইরান তার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন ৷ তাই তারা কখনও ইজরায়েলের সঙ্গে সংঘাত চায়নি । ইরানের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র তাদের মদতপুষ্টদের মাধ্যমে ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন হামলা চালিয়ে ইজরায়েলকে রক্তাক্ত করা । তাই, ইরান বা হিজবুল্লা কেউই নতুন ফ্রন্ট খোলেনি, যখন ইজরায়েল গাজায় হামাসকে নির্মূল করছিল । ইজরায়েলকে চাপে রাখার জন্য তারা যা করেছে, তা হল রকেট উৎক্ষেপণ । তারাও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সংঘাতে টানতে চায়নি । ইজরায়েল এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়েছে এবং গাজায় নিয়ন্ত্রণ পাওয়ার পর হিজবুল্লার সঙ্গে বিরোধ বাড়িয়েছে এবং ফলে হামাস অনেকাংশে দুর্বল হয়ে পড়ে । গাজা এখনও উত্তপ্ত, তাই হিজবুল্লার উপর ইজরায়েলের আক্রমণ কি সফল হবে, তা অজানা । এই নিয়ে তাদের আগের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে ।
তাছাড়া, তেহরানের একটি শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন শুধুমাত্র ইজরায়েল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নয়, এই অঞ্চলের জন্যও দীর্ঘমেয়াদে উপকারী হবে ৷ এই সত্যটি গ্রহণযোগ্য বলে মনে হচ্ছে । তবে এটা সহজে হওয়ার সম্ভাবনা কম ৷ যদিও নেতানিয়াহু এই দিকে ইঙ্গিত করেছেন ।
তবে, যদি ইজরায়েলের পালটা হামলা ইরানের কৌশলগত সম্পদের মারাত্মক ক্ষতি করে, তাহলে তেহরানের পশ্চিম এশিয়ায় অশান্তি সৃষ্টি করার ক্ষমতা রয়েছে । মদতপুষ্টদের দিয়ে অথবা ইরান নিজেই এই অঞ্চলের তেল উৎপাদনক্ষেত্রগুলিকে নিশানা করতে পারে, যার প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতিতে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে ৷ অন্যদিকে, ইজরায়েলের অবস্থাও ভালো নয় ৷ তাদের বিপর্যস্ত হামাসের পাশাপাশি হিজবুল্লা এবং হুথিদের সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে । নেতানিয়াহু বিমান হামলা এবং পেজার বিস্ফোরণ দ্বারা হিজবুল্লাকে আঘাত করতে পারেন ৷ তবে হিজবুল্লা এখনও তাঁর হাতের অনেক দূরে রয়েছে ।
এই পরিস্থিতিতে ইজরায়েল ইরানের বিরুদ্ধে আকাশযুদ্ধ শুরু করতে পারবে না । তবে, তেল আভিভকে ইরানের পদক্ষেপের প্রতিশোধ নিতে হবে ৷ অন্যথায় এটা একটা ভুল বার্তা পাঠাবে । প্রতিশোধের প্রকৃতি সংঘাতকে প্রসারিত করার বা এটাকে স্থানীয়ভাবে রাখার অভিপ্রায় নির্ধারণ করবে । ইজরায়েলের পরবর্তী হামলার পরিকল্পনা কী হবে, তার জন্য বিশ্ব অপেক্ষা করছে । একটি বর্ধিত সংঘাত তেল সরবরাহের উপর প্রভাব ফেলতে পারে, যা বিশ্ব অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে ।
ইরানের চাবাহার বন্দরের উন্নয়ন করছে ভারত । এটি ইজরায়েলি টার্গেট হওয়ার সম্ভাবনা কম । এখনও পর্যন্ত, ভারত সংঘাতের কোনও পক্ষের বিরুদ্ধে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকলেও আলোচনা ও সংযত আচরণের পক্ষে সওয়াল করেছে ৷ পশ্চিম এশিয়ার পরিস্থিতি কীভাবে বিকশিত হবে, তা আগামী সপ্তাহ নির্ধারণ করবে ।
(এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ৷ এখানে প্রকাশিত তথ্য ও মতামত ইটিভি ভারত-এর মতামতকে প্রতিফলিত করে না ৷)