সমৃদ্ধ গণতন্ত্রের একটি সুস্পষ্ট লক্ষণ হল সরকারকে দায়বদ্ধ রাখতে নাগরিকদের ক্ষমতা । অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সরকারকে নিয়ন্ত্রণে রাখার সবচেয়ে স্পষ্ট চিহ্ন। নির্বাচনের মধ্যবর্তী সময়ে দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা হয় বিভিন্ন উপায়ে ৷ যার মধ্যে একটি হল নাগরিকদের তথ্যের অধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে । 2005 সালে প্রণীত তথ্যের অধিকার আইনের ('আরটিআই অ্যাক্ট') প্রয়োগে ভারতের মিশ্র অভিজ্ঞতা হয়েছে । আইনটি যেমন বড় কিছু সাফল্য অর্জন করেছে, তেমনই বিগত বছরগুলিতে তার কিছু ব্যর্থতার দিকও রয়েছে ৷
একটি আন্দোলনের সূচনা…
তথ্যের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস পেরিয়ে কয়েক বছর আগে এই আইন প্রণীত হয় । এই আন্দোলনের প্রথম পদক্ষেপগুলির মধ্যে অন্যতম, 1994 সালে রাজস্থানে শুরু হওয়া মজদুর কিষান শক্তি সংগঠন (এমকেএসএস) নামে একটি জনগণের আন্দোলন । বিশিষ্ট সমাজকর্মী অরুণা রায়ের নেতৃত্বে এমকেএসএস ছিল কৃষক ও শ্রমিকদের একটি আন্দোলন, যা গ্রামে সামাজিক নিরীক্ষার দাবি করে এবং অবশেষে প্রশাসনের নিম্নস্তরে দুর্নীতির উদাহরণ তুলে ধরে । সংগঠনটি চতুরতার সঙ্গে তথ্যের অধিকারের জন্য লড়াই করতে জন শুনওয়াই বা জনসাধারণের শুনানি নামে একটি প্রত্যক্ষ কৌশল প্রয়োগ করেছিল ৷
এমকেএসএস দ্বারা বপন করা বীজ অবশেষে 1996 সালে জনগণের তথ্যের অধিকারের জন্য জাতীয় প্রচারণার (ক্যাম্পেইন ফর পিপলস রাইট টু ইনফরমেশন) জন্ম দেয় ৷ এই প্রচারাভিযানটি এমকেএসএস-এর জন্য সমর্থন হিসাবে কাজ করেছিল এবং এটি জাতীয় স্তরে তথ্যের অধিকারের পক্ষে সওয়াল করে । বিশিষ্ট মিডিয়া ব্যক্তিবর্গ, আমলা এবং বার ও বিচার বিভাগের সদস্যদের দ্বারা পরিচালিত এনসিপিআরআই -সহ অন্যান্য সুশীল সমাজ আন্দোলন ও প্রেস কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া, ভারত সরকারের কাছে তথ্যের অধিকার বিলের একটি খসড়া প্রেরণ করে । সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি তথা তৎকালীন প্রেস কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান বিচারপতি পিবি সাওয়ান্ত এই বিলের খসড়া তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, যার নাম দেওয়া হয়েছিল 'প্রেস কাউন্সিল - ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ রুরাল ডেভেলপমেন্ট ফ্রিডম অফ ইনফরমেশন অ্যাক্ট, 1997"।
আরটিআই আইনের দীর্ঘ পথ, 2005...
তথ্যের অধিকারের উপর কেন্দ্রের আইন পাশ করার দৌড়ের মধ্যেই বেশ কয়েকটি রাজ্য এই ধরনের আইন পাশ করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নেয় । তামিলনাড়ু 1997 সালে প্রথম ভারতীয় রাজ্য হয়ে ওঠে যেটি তথ্যের অধিকার সংক্রান্ত একটি আইন পাশ করে । মাত্র 7টি ধারার একটি সংক্ষিপ্ত আইন, তামিলনাড়ু তথ্য অধিকার আইন, 1997 কিছু কিছু তথ্য যেমন প্রতিরক্ষা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, মন্ত্রী ও রাজ্যপালের মধ্যে গোপনীয় যোগাযোগ সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে । গোয়াও 1997 সালে তথ্যের অধিকারের উপর একটি আইন প্রণয়ন করে। আর মধ্যপ্রদেশ রাজ্য সরকার এই অধিকার বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন সরকারি বিভাগকে প্রশাসনিক নির্দেশ জারি করেছিল ।
সুপ্রিম কোর্টও এবিষয়ে বিশেষ করে ভোটারদের অধিকারের প্রসঙ্গে তার প্রগতিশীল রায় দিল ৷ । অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস প্রার্থীরা অপরাধমূলক রেকর্ড, সম্পদ, দায়বদ্ধতা এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রকাশ করার বাধ্যবাধকতা দিয়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা চেয়ে দিল্লি হাইকোর্টে মামলা শুরু করেছিল । বিষয়টি শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছয় এবং কেন্দ্রীয় সরকার বনাম অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস [(2002) 5 এসসিসি 294] এর যুগান্তকারী রায় হয় ।
সুপ্রিম কোর্ট বলেছে যে, প্রার্থীদের সম্পর্কে জানার ভোটারদের অধিকার সংবিধানের 19(1)(এ) অনুচ্ছেদের অধীনে বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার মৌলিক অধিকারের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ । আদালত নিশ্চিত করেছে যে, নির্বাচন কমিশনের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য নির্দেশ জারি করার ক্ষমতা রয়েছে, যার মধ্যে প্রার্থীদের তাঁদের অপরাধমূলক রেকর্ড, সম্পদ, দায় এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রকাশ করতে হবে। এদিকে, 2000 সালে সংসদে তথ্যের স্বাধীনতা বিল তোলা হয়েছিল ।
এনসিপিআইরআই এবং পিসিআই খসড়ার সংস্করণটি প্রস্তুত করেন এবং এনসিপিআরআইকে এই খসড়াটির সংশোধনী প্রণয়ন করতে বাধ্য করেছিল, যা অবশেষে বর্তমানে বিলুপ্ত জাতীয় উপদেষ্টা পরিষদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া হয় । অবশেষে, তথ্যের অধিকার বিলটি ইউপিএ সরকার 2004 সালের 23 ডিসেম্বর সংসদে পেশ করে । এই খসড়াটি সমালোচনার মুখে পড়ে - সংসদে উত্থাপিত সংস্করণটি শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য প্রযোজ্য ছিল । এনসিপিআরআই এবং অন্যান্য আন্দোলনের নেতারা এই নিয়ে হস্তক্ষেপের পর, আইনটি রাজ্য সরকার এবং অন্যান্য সরকারি কর্তৃপক্ষের জন্যও প্রযোজ্য হয় এবং অবশেষে 2005 সালের 12 অক্টোবর থেকে আইন হিসাবে কার্যকর হয় ।
সাফল্যের খতিয়ান...
নাগরিকদের জানার অধিকার নিশ্চিত করতে বারবার সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের 19 অনুচ্ছেদ ব্যবহার করেছে, যা বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার নিশ্চিত করে । আরটিআই আইন 2005 এই অধিকারকে বাস্তব রূপ দেয় ৷ এই আইন সরকারি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে থাকা তথ্যে নাগরিকদের অ্যাক্সেস সুরক্ষিত করতে পারে । আইনটি বিস্তৃতভাবে - 'তথ্য' এবং 'পাবলিক অথরিটি' - উভয় বিষয়কেই সংজ্ঞায়িত করে । রেকর্ড, নথি, মেমো, ইমেল, মতামত, পরামর্শ, প্রেস রিলিজ, সার্কুলার, অর্ডার, লগবুক, চুক্তি, প্রতিবেদন, কাগজপত্র ও যে কোনও ইলেকট্রনিক আকারে ধারণ করা ডেটা উপাদান-সহ যে কোনও আকারে যে কোনও উপাদানের তথ্যের কথা এই আইনে বলা হয়েছে ৷ এটিতে কোনও ব্যক্তিগত সংস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত তথ্যও অন্তর্ভুক্ত, তবে একটি সরকারি কর্তৃপক্ষকে তাতে আইনত অ্যাক্সেস করার অনুমতি দেয় । পাবলিক অথরিটি বলতে বোঝায়, সংবিধানের অধীনে বা আইন বা নির্বাহী বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত কোনও কর্তৃপক্ষ/সংস্থা/প্রতিষ্ঠান । এই শব্দটি এমন কোনও সংস্থা বা বেসরকারি সংস্থাকেও অন্তর্ভুক্ত করে, যাকে সরকার দ্বারা যথেষ্ট অর্থায়ন করা হয় (প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ তহবিলের মাধ্যমে)।
আরটিআই আইনের বিধানগুলির বেশকিছু ভালো ব্যবহার প্রত্যক্ষ করা যায় ৷ যেমন দুর্নীতির হাই-প্রোফাইল ঘটনাগুলি প্রকাশ্যে আনতে সাহায্য করেছে এই আইন ৷ মেধা পাটেকরের নেতৃত্বে ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স অফ পিপলস মুভমেন্ট, আদর্শ হাউজিং সোসাইটি কেলেঙ্কারি প্রকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, যারা জমির মালিকানা সম্পর্কিত নিয়মগুলির গুরুতর লঙ্ঘনে জড়িত ছিল। এটি প্রতিরক্ষা বিভাগ, মহারাষ্ট্র সরকার এবং অন্যান্য রাজ্য কর্তৃপক্ষের কাছে আরটিআই অনুরোধের পাশাপাশি অভিযোগও দায়ের করেছিল । হাউজিং অ্যান্ড ল্যান্ড রাইটস নেটওয়ার্ক নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দ্বারা দায়ের করা একটি আরটিআই অনুরোধ 2010 সালের কমনওয়েলথ গেমসে টাকা আত্মসাতের ঘটনা উদঘাটন করে ৷
ব্যর্থতার দিক...
এই আইনের কতগুলি ব্যর্থতার দিকও রয়েছে ৷ 2019 সালে আইনটি কেন্দ্রীয় সরকারকে একতরফা ক্ষমতা দেওয়ার জন্য সংশোধন করা হয়েছিল ৷ যে তথ্য কমিশনাররা আরটিআই অনুরোধের অসন্তোষজনক প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে আপিল শুনবে, তারা কতদিন কাজ করতে পারবে তা ঠিক করতে পারবে কেন্দ্র ।
এই সংশোধনীর আগে তথ্য কমিশনারদের নির্দিষ্ট 5 বছরের মেয়াদ, অথবা 65 বছর বয়স অতিক্রান্ত, দুটির মধ্যে যেটি আগে আসত ততদিন সেই আপিল শুনতে পারতেন ৷ এটি তথ্য কমিশনারদের অফিসের স্বাধীনতার সরাসরি অবমাননা । সম্প্রতি, ডিজিটাল ব্যক্তিগত ডেটা সুরক্ষা আইন, 2023 (ডিপিডিপি আইন)-এর মাধ্যমে আরটিআই আইনে পরিবর্তন আনা হয়েছে ।
আরটিআই আইনের কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে এবং জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব সম্পর্কিত কারণে কিছু তথ্য গোপন রাখার অনুমতি রয়েছে । আরটিআই আইন সরকার কর্তৃক নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশকেও নিষিদ্ধ করে, যদি না এর পেছনে বড় কোনও জনস্বার্থ জড়িয়ে থাকে । ডিপিডিপি আইন এই নিষেধাজ্ঞাটিকে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞায় সংশোধন করেছে । এনসিপিআরআই-সহ আরটিআই কর্মীরা আশঙ্কা করছেন যে, ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশের উপর এই সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞাটি সরকারি কর্মকর্তারা তথ্য প্রকাশকে প্রত্যাখ্যান করতে এবং জবাবদিহিতা এড়ানোর জন্য ব্যবহার করতে পারে ।
আগামী দিনে কী হবে...
কিছু আইনী হস্তক্ষেপের মাধ্যমে আরটিআই আইনের ডানা ছাঁটা সত্ত্বেও, এই আইনের সাফল্যগুলি বেশ চমকপ্রদ । এটি নিম্ন-স্তরের দুর্নীতি মোকাবিলা করার পাশাপাশি হাই-প্রোফাইল কেলেঙ্কারিগুলি উন্মোচন করতে কার্যকর হয়েছে । আরটিআই আইন হল নাগরিকদের হাতে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার এবং এটিতে যখন ভালো ভাবে ব্যবহার করা হয়, তখন তা প্রশাসনের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে পারে ৷ আরটিআই আইন আরও শক্তিশালী হবে এবং ভারতে সুশাসনকে শক্তিশালী করবে বলেই আশা করা যায় ।
[লেখক নয়াদিল্লির বিধি সেন্টার ফর লিগ্যাল পলিসিতে কর্মরত, যেখানে তিনি বিধির নিবেদিত সাংবিধানিক আইনি দল চরখার নেতৃত্ব দেন । তাঁর বর্তমান গবেষণায় সংসদীয় গণতন্ত্র, নির্বাচনী এলাকার সীমাবদ্ধতা এবং নির্বাচনী সংস্কারের বিষয় রয়েছে । তিনি গুরু গোবিন্দ সিং ইন্দ্রপ্রস্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম বর্ষের ছাত্রী মিসেস শাঞ্জালি গুপ্তাকে তাঁর গবেষণায় সহায়তার জন্য ধন্যবাদ জানাতে চান ৷]