শিক্ষাকে উপযোগী, অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈচিত্র্যময়, শিক্ষাকেন্দ্রিক, নমনীয় এবং বিশ্বব্যাপী সর্বোত্তম অনুশীলনের সঙ্গে সংযুক্ত করার লক্ষ্যে জাতীয় শিক্ষা নীতি (এনইপি)-2020-তে একটি বৈশিষ্ট্য হিসাবে মাল্টিপল এন্ট্রি এবং মাল্টিপল এক্সিট (এমইএমই) চালু করা হয়েছে ।
গত বছর শীতকালীন অধিবেশন চলাকালীন লোকসভায় একটি প্রশ্নের উত্তরে তৎকালীন শিক্ষা রাষ্ট্রমন্ত্রী সুভাষ সরকার বলেছিলেন, "এনইপি 2020 উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার করতে চায় ৷ সেই কারণে অন্যান্য অনেক কিছুর মধ্যে, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার জন্য বিষয় পছন্দের বাছাই এবং পঠনপাঠনের ক্ষেত্রে নমনীয়তা প্রদান করে । পড়াশোনায় শৃঙ্খলার সঙ্গে সৃজনশীলতার সমন্বয় সাধনে মাল্টিপল এন্ট্রি এবং মাল্টিপল এক্সিট (একাধিক প্রবেশ এবং প্রস্থান) পয়েন্টটিকে রাখা হয়েছে ৷"
বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমইএমই পরিচালনায় বাধাগুলি সমাধান করার জন্য এনইপি-তে মাল্টিপল এন্ট্রি ও মাল্টিপল এক্সিট-এর ক্ষেত্রে নতুন বিকল্প তৈরির করার কথা সরকার ভাবছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন এলুরুর (অন্ধ্রপ্রদেশ) সাংসদ শ্রীধর কোটাগিরি ৷ তার প্রেক্ষিতেই সুভাষ সরকার লোকসভায় এই উত্তর দিয়েছিলেন ৷
এমইএমই-র বিষয়টি আরও ভালোভাবে বোঝানোর জন্য সুভাষ সরকার বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা ইউজিসির তরফে দেওয়া বিস্তারিত নির্দেশিকাগুলির কথাও উল্লেখ করেন ।
এটা অর্জন করার লক্ষ্য কী ?
ইউজিসি-র নির্দেশিকায় এমইএমই-র জন্য তার কারণ হিসেবে সাতটি মূল বিষয় তালিকাভুক্ত করা হয়েছে । বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে এটা অনমনীয় সীমানা মুছে ফেলবে ও শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন সম্ভাবনার সুবিধা দেবে ৷ পাশাপাশি পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়া ও স্কুলে ভর্তি হওয়ার (গ্রস এনরোলমেন্ট রেসিও বা জিইআর) বিষয়টি উন্নত করবে ৷
এমইএমই পড়াশোনায় শৃঙ্খলার সঙ্গে সৃজনশীলতার সমন্বয় সাধন করবে । এটা শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যক্রম ও অভিনব কোর্সের বিকল্পগুলি এই বিষয়ে নমনীয়তা আনবে ৷ কোনও বিষয়ে স্পেশালাইজেশন ও মাস্টার্স প্রোগ্রামের বিভিন্ন রকমও আনবে ৷
এই প্রকল্পটি ক্রেডিট সংগ্রহ এবং স্থানান্তরের জন্য প্রদান করবে ৷ এছাড়া ডিগ্রি প্রদানের জন্য অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার মূল্যায়ন ও বৈধতা প্রদান করবে ৷ একই সঙ্গে আজীবন শিক্ষাকে উৎসাহিত করবে ৷ যখন শিক্ষার্থী তাঁর পড়াশোনা পুনরায় শুরু করবে, তখন ক্রেডিট নগদ করার সুবিধা প্রদান করবে ।
যদিও কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যগুলিতে জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের বেশ কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের জন্য চাপ দিচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমইএমই বিকল্পের বাস্তবায়নের বিষয়টি ৷ এটা বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে, আসুন সেগুলি নিয়ে আলোচনা করি ।
পাঠ্য়ক্রমে রদবদল
নমনীয় ও মডিউলার কোর্সগুলি পড়ানোর জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে তাদের পাঠ্যক্রমে রদবদল করতে হবে ৷ এর জন্য অ্যাকাডেমিক প্রোগ্রামগুলিতে ব্যাপক পরিবর্তনের প্রয়োজন এবং প্রচলিত ডিগ্রি প্রোগ্রামগুলিকে ছোট, প্রয়োজনীয় সার্টিফিকেট ও ডিপ্লোমা কোর্সে ভাগ করতে হবে ৷ শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রস্থান এবং পুনরায় প্রবেশের অনুমতি দেওয়া প্রয়োজন । স্থির কাঠামো ও একচেটিয়া পাঠ্যক্রম-সহ প্রতিষ্ঠানগুলির জন্য এটা একটি জটিল কাজ হতে পারে ।
ক্রেডিট ট্রান্সফার সিস্টেম
এমইএমই একটি শক্তিশালী অ্যাকাডেমিক ব্যাংক অফ ক্রেডিট (এবিসি)-র উপর নির্ভর করে রয়েছে ৷ এখানে শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠান জুড়ে ক্রেডিট জমা করতে এবং স্থানান্তর করতে পারবে । একটি বিস্তৃত এবং স্বচ্ছ ক্রেডিট ট্রান্সফার সিস্টেম তৈরি ও পরিচালনা করতে হবে, যা সর্বজনীনভাবে গৃহীত হয় এবং যা লজিস্টিক ও প্রশাসনিক বাধাগুলির সমাধান করতে পারে ৷
এছাড়াও, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় তাদের অ্যাকাডেমিক প্রোগ্রামের জন্য দেওয়া বিষয়গুলির জন্য বিভিন্ন ক্রেডিট সিস্টেম গ্রহণ করছে । একটি বিষয়ের জন্য ক্রেডিট ওয়েটেজ সারা দেশের সমস্ত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে একরকম নাও হতে পারে ৷
ফ্যাকাল্টির প্রশিক্ষণ এবং প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে ইতিমধ্যেই ফ্যাকাল্টির ঘাটতি রয়েছে ৷ এই পরিস্থিতিতেও তাদের নতুন শিক্ষণ পদ্ধতি এবং মূল্যায়নের ধরনগুলির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে ৷ এগুলি ঐতিহ্যগত মডেলগুলির থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে আলাদা হতে পারে । তাছাড়া, বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীদের প্রবেশ এবং প্রস্থানের বিষয়টি পরিচালনা করা ফ্যাকাল্টির কাজের চাপ বাড়িয়ে দিতে পারে, যা প্রত্যেকের প্রতি মনোযোগ নিশ্চিত করার বিষয়টিকে আরও কঠিন করে তোলে । শিক্ষার্থীদের ঘন ঘন আসা-যাওয়াতে প্রশাসনিক ব্যবস্থাতে চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে ৷ ছাত্রছাত্রীদের রেকর্ড রাখা, ফি কাঠামো এবং শিক্ষার্থীদের অগ্রগতি ট্র্যাক করার বিষয়গুলি এর মধ্যে রয়েছে । এই জটিলতাগুলি পরিচালনা করার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলিকে প্রযুক্তি এবং কর্মীদের উপর বিনিয়োগ করতে হতে পারে ।
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব আছে
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা, বিশেষ করে সরকারি টাকায় পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কর্মীদের পেনশনে সুবিধা এবং বেতন দেওয়ার জন্য যে লড়াই করছে, তা এখন লুকানো নেই ৷
বিভিন্ন কোর্সে নমনীয়তা বৃদ্ধিতে পরিকাঠামোর উন্নতি প্রয়োজন ৷ এর মধ্যে ফ্যাকাল্টি, ক্লাসরুম, ল্যাব, কর্মশালা এবং প্রশাসনিক সহায়তার প্রয়োজনীয়তার বিষয়গুলি রয়েছে । সম্পদের সীমাবদ্ধতা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির কাছে এমইএমই-র জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো প্রদান করা চ্যালেঞ্জিং মনে হতে পারে । উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতি সরকারের অলস মনোভাব এই পরিস্থিতিকে আরও বাড়িয়ে দেয় ।
নিয়োগকারীদের দ্বারা স্বীকৃতি ও নিয়োগের চ্যালেঞ্জ
যদিও এমইএমই ছাত্রদের একটি প্রোগ্রাম থেকে বেরিয়ে আসার পরে সার্টিফিকেট বা ডিপ্লোমা অর্জনের অনুমতি দেয় ৷ তবে এটা অনিশ্চিত যে এই শংসাপত্রগুলি নিয়োগকর্তাদের দ্বারা ব্যাপকভাবে গ্রহণ করা হবে কি না ! বিশেষ করে পেশাদার ক্ষেত্রে যেখানে ঐতিহ্যগতভাবে সম্পূর্ণ ডিগ্রি প্রয়োজন ।
আগামীর পথ
এই চ্যালেঞ্জগুলি ইঙ্গিত করে যে এমইএমই সিস্টেমে উচ্চশিক্ষায় নমনীয়তা এবং তা গ্রহণ করার সম্ভাবনা থাকলেও, এর বাস্তবায়নের জন্য বিদ্যমান পদ্ধতি, মানসিকতা ও সংস্থানগুলির একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন প্রয়োজন। সর্বোপরি, সমস্ত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এটা একটি অভিন্ন পাঠ্যক্রম ও ক্রেডিট স্কিম নীতি প্রয়োজন, যা তাঁদের স্বায়ত্তশাসনের সঙ্গে আরও আপস করে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলি থেকে প্রতিরোধকে উৎসাহিত করতে পারে।
সকলের স্বার্থে স্লেজহ্যামার পন্থা অবলম্বন করার পরিবর্তে, প্রাথমিক পর্যায়ে এমইএমইকে কিছু সীমিত স্নাতকোত্তর প্রোগ্রামে বাস্তবায়িত করা জরুরি, যেখানে নথিভুক্তি তুলনামূলকভাবে কম৷ একটি পাইলট প্রকল্প হিসাবে এবং এখান থেকে যা শিক্ষা পাওয়া যাবে, তার উপর ভিত্তি করে ভবিষ্যতের পদক্ষেপ নির্ধারণ করা যেতে পারে।
(এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের ৷ এখানে প্রকাশিত তথ্য ও মতামত ইটিভি ভারত-এর মতামতকে প্রতিফলিত করে না ৷)