রাজনীতিতে এমন কিছু বছর থাকে যেখানে কিছুই ঘটে না ৷ তারপর এমন দিন থাকে, যখন এক দশকে ঘটার মতো সমান ঘটনা ঘটে । 4 জুন ও তার পরের দিনগুলিতে যে বিষয়গুলি সামনে এসেছে, তা দেখে এটা খুব স্পষ্ট যে ভারতীয় রাজনীতিতে আগামী পাঁচ বছর খুবই দীর্ঘ সময় হতে চলেছে ।
রবিবার সন্ধ্যায় নরেন্দ্র মোদি টানা তৃতীয়বারের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন ৷ কিন্তু মোদি 3.0-এর সঙ্গে মোদির প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম দফা ও মোদি 2.0-এর কোনও মিল নেই । এবার মন্ত্রিসভায় শরিকদের জায়গা দিতে বাধ্য হচ্ছেন মোদি । তবে তিনি তাঁর মন্ত্রিসভার মূল অংশকে ধরে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ৷ এর উদ্দেশ্য ‘সব আগের মতোই আছে’ ধারণাটিকে ছড়িয়ে দেওয়া ৷ কিন্তু বাস্তবে মোদিকে সম্পূর্ণ অপরিচিত পরিসরে কাজ করতে হবে, যা তাঁর পুরো রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে আগে কখনও ঘটেনি ৷
নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক কর্মজীবন মূলত ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতৃত্বের দ্বারা এমনভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে জোট রাজনীতিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি ৷ তাঁর শাসন শৈলী ও কৌশলগুলি প্রধানত একক-দলীয় আধিপত্যকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে ।
2024 সালের ফলাফল ভারতে সেই দৃশ্যপটকে বদলে দিয়েছে এবং ভারতীয় রাজনৈতিক ইতিহাসে এটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হতে চলেছে । এমনকি সাবধানে তৈরি করা ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল এবং শপথ অনুষ্ঠানের ভয়েসওভার নেতৃত্বের শারীরিক ভাষায় অস্বস্তি আড়াল করতে ব্যর্থ হয়েছে ।
তাহলে এখন কী হবে ?
জোটের শরিকরা তাদের নিজেদের ভাগ চাইবে । তাদের বিশাল দর কষাকষির ক্ষমতা ব্র্যান্ড মোদির বৈশিষ্ট্যকে কমিয়ে দেবে । চেহারা ও অ্যাকশনে একই মোদিকে না দেখা গেলে, তাঁর বিশাল ফ্যান ফলোয়িং হ্রাস পাবে ।
নরেন্দ্র মোদির জন্য তাঁর শক্তিশালী ভাবমূর্তি ধরে রাখাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হতে চলেছে । 12 বছর ধরে তিনি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার সঙ্গে গুজরাত শাসন করেছিলেন ৷ 10 বছর ধরে মোদি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ভারত শাসন করেছেন । এই প্রথম বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি ৷ মোদির জন্য এটা সম্পূর্ণ অপরিচিত পরিস্থিতি ।
মোদির শাসন শৈলী দৃঢ় এবং কেন্দ্রীভূত সিদ্ধান্ত গ্রহণ হিসেবে চিহ্নিত ৷ যা বরাবর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ভূমিকার উপর জোর দিয়ে এসেছে । এই পদ্ধতিটি একটি একদলীয় সরকারে বেশি সম্ভব, যেখানে অভ্যন্তরীণ ভিন্নমত আরও সহজে পরিচালনা করা যেতে পারে । এমনকি 2001 থেকে 2014 পর্যন্ত গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে, মোদি এমন একটি সরকারের নেতৃত্ব দিয়েছেন, যেখানে বিজেপি জোট শরিকদের উপর নির্ভর করতে হয়নি ।
মোদির কাজের ধরনের মধ্য়ে রয়েছে সর্বাধিক ক্ষমতা প্রয়োগ, মিডিয়া বর্ণনার উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ, বিরোধীদের ক্রমাগত অবমাননা, সরকারি প্রতিষ্ঠানের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ, চিন্তাশীল নেতা ও স্বাধীন কণ্ঠস্বরকে চেপে দেওয়া, প্রতিবাদকারীদের উপহাস করা ইত্যাদি ৷ অনুগামীরাও তাঁদের নেতার এই ধর্মীয়, লোভনীয়, জঙ্গি ও পুরুষালি ভাবমূর্তি পছন্দ করেন । তাঁরা তাঁদের অপরাজেয় নেতাকে পছন্দ করেন, যিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী । বুলডোজার, যা একটি ধ্বংসাত্মক যন্ত্র, সেটাও হিন্দি অঞ্চলে শাসকের শাসনের বিখ্যাত প্রতীক হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে ।
জোটের রাজনীতিতে একাধিক দলের স্বার্থ মেটানোর জন্য ব্যাপক আলোচনার প্রয়োজন । ফলে জোট পরিচালনার জন্য ফোকাস স্থানান্তরিত হওয়ার ফলে লক্ষ লক্ষ অনুগামীরা মোদিকে যেভাবে দেখতে অভ্যস্ত, সেভাবে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা কম ৷
মোদি অবশ্যই জানেন যে জোটের প্রধান দুই নেতা, জেডিইউ-এর নীতীশ কুমার ও টিডিপি-র চন্দ্রবাবু নাইডু অতীতে তাঁর বিরুদ্ধে খুব কড়া শব্দ ব্যবহার করেছেন । যদি ইন্ডিয়া ব্লক তাঁদের বড় কোনও প্রস্তাব দেয়, তাহলে তাঁরা সরে যেতে দ্বিধাবোধ করবেন না ।
ব্র্যান্ড নরেন্দ্র মোদির জন্ম 2002 গুজরাতের সাম্প্রদায়িক হিংসার সময় । কেশুভাই প্যাটেলের জায়গায় মোদি যখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হন, তখন তাঁর বিষয়ে খুব কম লোকই জানতেন ৷ তিনি তৎকালীন উপ-প্রধানমন্ত্রী এল কে আদবাণীর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ছিলেন । মোদি 1990 সালে আদবাণীর কুখ্যাত রথযাত্রা সংগঠিত করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, যা অবশেষে 1992 সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের দিকে পরিচালিত করেছিল এবং কেন্দ্রে বিজেপিকে ক্ষমতায় নিয়ে গিয়েছিল ।
ইতিহাস বলছে যে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারালে নেতৃত্ব দুর্বল হয়ে পড়ে ৷ রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয় এবং শাসন ব্যবস্থাও নড়বড়ে হয়ে যায় ৷ একজন রাজনৈতিক নেতা, যিনি তাঁর মেয়াদের শেষের দিকে জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন, এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হল মার্গারেট থ্যাচার ৷ তিনি ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী (1979-1990) । ‘দ্য আয়রন লেডি’ নামে পরিচিত মার্গারেট থ্যাচার 1987 সালে তৃতীয় মেয়াদের জন্য পুনরায় নির্বাচিত হন । কিন্তু ইউরোপীয় সম্প্রদায় সম্পর্কে তাঁর ক্রমবর্ধমান ইউরোসেপ্টিক মতামতের সঙ্গে তাঁর মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যরা সহমত হননি ৷ তাঁর নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে ৷ 1990 সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী ও দলের নেতৃত্ব থেকে ইস্তফা দেন ৷ জন মেজর তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন ৷
বিজেপির একক সংখ্য়াগরিষ্ঠতা হয়তো নেই ৷ কিন্তু নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহের জন্য এই পরিস্থিতি সম্পূর্ণ অপরিচিত নয় । 2017 সালে 182 আসনের গুজরাত বিধানসভায় 99টি আসনে জিতেছিল বিজেপি ৷ যা সংখ্যাগরিষ্ঠতার চেয়ে সামান্য বেশি ছিল ৷ যা বিজেপির জন্য খুব একটা আরামদায়ক পরিস্থিতি ছিল না । এর পরই বিখ্যাত 'গুজরাত মডেল' কার্যকর হয় এবং পরবর্তী পাঁচ বছরে কয়েক ডজন কংগ্রেস নেতা বিজেপিতে যোগ দেন । বেশ কয়েকটি উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যার বেশিরভাগই বিজেপি জিতেছিল ৷ 2022 সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে তাদের শক্তি 99 থেকে 112 আসনে পৌঁছয় । 2022 সালে বিজেপি 156টি আসনে জিতে সুপার সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, যা গুজরাতের ইতিহাসে কোনও দলের দ্বারা সবচেয়ে বেশি আসন জয় ৷ তিন দশকের মধ্যে ওই রাজ্যে কংগ্রেস সর্বনিম্ন সংখ্যায় নেমে যায় ।
মোদি ও শাহ তাঁদের সংখ্যা বাড়াতে কেন্দ্রে এই গুজরাত মডেলটি বাস্তবায়ন করতে পারেন ৷ কারণ, যদি তাঁরা সফল না হন, এনডিএ পুরো পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ করার জন্য উপযুক্ত সময়ে প্রধানমন্ত্রীর চেহারা পরিবর্তন করার কথা বিবেচনা করতে বাধ্য হতে পারে ।
বিজেপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল মোদি ও শাহের এখন সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ হতে চলেছে । উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র ও মধ্যপ্রদেশেই কোন্দল বেশি হবে ৷
শাসনব্যবস্থা পরিচালনার জন্য সরকারে যোগ্য লোকের অভাব, বিশেষ করে মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব ও কৃষকদের দুর্দশা সারা দেশে প্রতিবাদের ঢেউ তৈরি হতে পারে । 2024 সালের ফলাফলে এনডিএ (43.7) এবং ইন্ডিয়া ব্লকের (41.4%) মধ্যে মাত্র 2.3% ভোট ভাগের ব্যবধান বিজেপিকে চিন্তায় রাখবে । হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র, দিল্লি এবং জম্মু ও কাশ্মীরের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচন ব্র্যান্ড মোদিকে আরও পরীক্ষায় ফেলবে ৷