পয়সা কথা বলে । হ্যাঁ, সত্যিই বলে । মহায়ুতিকে জিজ্ঞাসা করুন । তারা এমন অপ্রতিরোধ্য ফলাফল আশা করেনি । কেউই করেনি । এমনকি এক্সিট পোলগুলি এমভিএ-র জন্য সামান্য সম্ভাবনা রেখে একটি কঠিন প্রতিযোগিতার পূর্বাভাস দিয়েছিল । তবুও গত 23 নভেম্বর ইভিএম সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে । 'লাডকি বেহনা'রা দেবেন্দ্র ফড়নবীস, একনাথ শিন্ডে ও অজিত পাওয়ারকে একটি বড় ধন্যবাদ পাঠিয়েছেন । লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল এই ত্রয়ীকে আবার তাদের নির্বাচনী অঙ্ক কষতে বাধ্য করেছিল । সেই অঙ্কের ফলাফল হিসেবে মহারাষ্ট্রে 18 থেকে 60 বছর বয়সী প্রতিটি মহিলার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে প্রতি মাসে দেড় হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে ৷
4.7 কোটিরও বেশি মহিলা ভোটারদের মধ্যে প্রায় 66 শতাংশ বিধানসভা ভোটে ভোট দিয়েছেন, যা সাম্প্রতিক লোকসভা ভোটের তুলনায় ছয় শতাংশ বেশি ৷ লোকসভা ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বী জোটগুলির ভোট শতাংশের পার্থক্য নগণ্য ছিল, তার পরও এমভিএ মহায়ুতির চেয়ে বেশি আসনে জিতেছিল ৷ তবে মহিলা ভোটারদের ধন্যবাদের জন্য ভোটের পাল্লা শাসক জোটের পক্ষে ভারী হয়েছে ।
তাই, এমভিএ-র উচিত ইভিএমে ত্রুটি খোঁজা বা কয়েক সপ্তাহ ভোট পিছিয়ে দেওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনকে দোষারোপ করা বন্ধ করা ৷ তাদের ক্ষতি বেদনাদায়ক ৷ আপাতত শিন্ডে সেনা এবং অজিত পাওয়ারে এনসিপি-রই পাল্লা ভারী ৷ শরদ পাওয়ার এবং উদ্ধব ঠাকরে বা তাঁর পরামর্শদাতা সঞ্জয় রাউতের উচিত মহারাষ্ট্রের ভোটাররা তাঁদের যে বড় ধাক্কা দিয়েছেন, তা নিয়ে চিন্তা করা ।
লোকসভা ভোটে ভোটারের কাছে অপমানিত হয়নি মহায়ুতি । কিন্তু বিধানসভা ভোটে এমভিএ সম্মিলিতভাবে ভোটারদের কাছে অপমানিত হয়েছে ৷ এই জোটের নেতাদের ঔদ্ধত্যের ফানুস ফুটো হয়ে গিয়েছে ৷ তাঁরা বিজেপির ‘বাটোগে তো কাটোগে’ এবং ‘এক হ্যায় তো সেফ হ্যায়’ স্লোগানকে দোষারোপ করতেই পারেন ৷ কিন্তু শিন্ডে সরকার সয়াবিন ও তুলা চাষিদের সমস্যাকে উপেক্ষা করেনি ৷ আবার মুম্বইয়ের শহুরেদের উদ্বেগকেও উপেক্ষা করেনি । সেই কারণেই শিন্ডে সরকার টোল ট্যাক্স প্রত্যাহার করে এবং মহানগরে নতুন পরিকাঠামো প্রকল্পের উদ্বোধন করে ।
এটা এমন একটি সরকার ছিল, যা উদ্ধবের বিরুদ্ধে কাজ করেছিল ৷ এক্ষেত্রে উদ্ধব যেন একজন প্রত্যাখ্যাত প্রেমিকের মতো বিজেপির বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন ৷ নিঃসন্দেহে, লোকসভা ভোটে এমভিএ-র পক্ষে যেভাবে মুসলিমরা এক হয়েছিলেন, এবার তারই পালটা হিসেবে হিন্দুরা এক হন ৷ 2019 সালের বিধানসভা ভোটের পরে বিজেপি 105টি আসন এবং জোটের অংশীদার শিবসেনা (অবিভক্ত) 56টিতে জয়ী হওয়ার পরও যেসব ঘটনা ঘটেছিল, তা দুর্ভাগ্যজনক ছিল । উদ্ধব বিজেপি-সেনা জোটের নেতৃত্বের দাবি করে বসেন ৷ তার জেরেই অনিশ্চিয়তা তৈরি হয় ৷ যদিও উদ্ধবের দলের আসন সংখ্যা বিজেপির প্রায় অর্ধেক ছিল ।
এবার বিজেপির দুই শরিক যত আসনে জিতেছে, তার যোগফলের চেয়ে বেশি আসনে জিতেছে বিজেপি ৷ তাই দেবেন্দ্র ফড়নবীস মুখ্যমন্ত্রী পদের দাবি করতেই পারেন ৷ এছাড়াও, একজন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি উপ-মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কাজ করেছেন ৷ তাহলে এখন কেন স্থান অদলবদল করা যাবে না ! এমন হলে, তা শুধুমাত্র জনপ্রিয় ম্যান্ডেটকে সম্মান করবে না, বরং একটি উদ্দেশ্যমূলক শাসনের জন্য পরিবেশ তৈরি করবে ।
গুজরাতি ও মারাঠিদের মধ্যে বিভেদের চেষ্টা, বিজেপি ক্ষমতায় থাকলে মুসলিমরা অনিরাপদ, এমন নেতিবাচক রাজনীতিতে লিপ্ত না-হয়ে, বিরোধীরা যদি সহযোগিতামূলক রাজনীতি করে, তাহলে তারা আরও ভালো কাজ করবে ৷ স্বাভাবিক হিন্দুত্ববাদী মিত্র বিজেপি থেকে দূরে সরে যাওয়ার ফলে কী হয়েছে, তা নিয়েও উদ্ধব ঠাকরেকে ভাবতে হবে ৷ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি ভোটের ফলাফলের মূল বার্তাও উপলব্ধি করবেন, যা হল - সেনা ও বিজেপি একসঙ্গে থাকলেই ভালো হবে ৷
শরদ পাওয়ার আগেই জানিয়েছেন যে তাঁর অবসরের সময় হয়ে গিয়েছে ৷ তাঁর উচিত বৃহত্তর এনসিপি পরিবারকে এক করার জন্য নিজের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করা ৷ এই ভোটে সবচেয়ে বড় হেরো কে ? কেউ বলতেই পারেন রাহুল গান্ধি অযোগ্য ৷ তিনি তাঁর পরিবারের উত্তরাধিকারকে আরও এগিয়ে নেওয়ার জন্য একটি স্পষ্ট নীলনকশা তৈরি-সহ একজন বিশ্বাসী নেতাতে পরিণত হতে অক্ষম ।
মোদির প্রতি তাঁর লাগামহীন গালিগালাজ মোদির ভাবমূর্তিকে আরও ভালো করতে সাহায্য করেছে । এখন তাঁর বোন প্রিয়াঙ্কা বঢরাও লোকসভায় তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়েছেন ৷ দু’জনেরই উচিত আরও ভালো পরামর্শদাতা নিয়োগ করা, যাঁরা তাঁদের শক্তিশলী কিন্তু দায়িত্বশীল বিরোধী নেতারা ভূমিকা পালনে সাহায্য করবেন । সংসদে কোলাহল ও বিশৃঙ্খলা পরিবার-নিয়ন্ত্রিত দলকে ফের প্রচারের আলোয় আনতে পারবে না ৷ সারা দেশে শুধু গান্ধি হিসেবে ভোটে জেতা যাবে না ৷
প্রকৃতপক্ষে, ঝাড়খণ্ডে তুলনামূলকভাবে ভালো প্রদর্শনের জন্য কংগ্রেসের উচিত সম্পূর্ণভাবে তাদের বড় শরিক জেএমএমের প্রতি নজর রাখা । বিজেপি অনুপ্রবেশ ইস্যুতে সরব হয়েছিল ৷ কিন্তু উপজাতীয় ভোটারদের উপর জেএমএমের দখল কমাতে পারেনি । বরং বিজেপি আবার সম্পদ সমৃদ্ধ রাজ্যে একটি শক্তিশালী বিরোধী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে । উত্তর প্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, পঞ্জাব প্রভৃতি রাজ্যে আবারও উপ-নির্বাচনের ফল সংশ্লিষ্ট রাজ্যের ক্ষমতাসীন দলগুলোর পক্ষে গিয়েছে ।
এই ফলাফলগুলির মধ্যে অনেক কিছু রয়েছে ৷ উত্তর প্রদেশ ও বিহারে অখিলেশ যাদব এবং লালু যাদবের কাছে হার অপ্রত্যাশিত ছিল ৷ এছাড়াও, বিহারে প্রশান্ত কিশোরের সুরজ পার্টি বিহারে নির্বাচনী জল মাপার প্রথম পরীক্ষায় ভোট কাটার ভূমিকা পালন করেছে ৷ তাঁর দল বর্ণ-বৈষম্যের বাইরে বেরিয়ে বিহারের রাজনীতিকে একটি নতুন দিকনির্দেশ দেওয়ার চেষ্টা করছে ৷ এই ফলাফল প্রশান্ত কিশোরের সৎ উদ্দেশ্যমূলক প্রচেষ্টাকে ধাক্কা দিয়েছে ।
এদিকে, সাধারণভাবে বিধানসভা নির্বাচন থেকে এবং বিশেষ করে মহারাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তাটি হল লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের পর কিছুটা ঝাপসা হয়ে গেলেও ব্র্যান্ড মোদি আবারও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক পরিসরে ৷ তাঁকে মুখোমুখি চ্যালেঞ্জ করার মতো কেউ নেই ৷ ইন্ডি ব্লকের আড়ালে রাহুল গান্ধিকে নিজেকে একজন বিশ্বাসী নেতা হিসেবে পরিণত করতে পারেনি । সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে বিরোধীদের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত যে তারা শোরগোল ও হট্টগোল চালিয়ে যাবে, নাকি এটা বন্ধ করবে ৷ সর্বশেষ আদানি-বোমা একটি দ্বি-ধারী অস্ত্র । এতে হয়তো তাঁর সঙ্গে শাসকের সম্পর্ক সামনে আসবে ৷ কিন্তু এটাও প্রকাশ্যে আসবে যে বিরোধীদের বড় নেতারাই আদানির থেকে ঘুষ নিয়েছেন ৷
রাহুল যদি তাঁর ক্ষোভের জন্য নিজের নাক কাটতে চান, তাহলে তিনি তাঁর সৈন্যদের লোকসভার ওয়েলে নিয়ে যেতে পারেন, মোদি বিরোধী স্লোগান দিতে পারেন, নিয়ম লঙ্ঘন করে হাউসে কিছু পোস্টার ছিঁড়ে ফেলতে পারেন এবং তারপরে আদানি-আদানি স্লোগান তুলতে পারেন ক্যামেরার সামনে ৷ তবে অন্য এবং বুদ্ধিদীপ্ত বিকল্পটি হল মহারাষ্ট্রের ভোটারদের কাছ থেকে বড় বার্তা গ্রহণ করা এবং একটি গঠনমূলক ও দায়িত্বশীল বিরোধীর মতো আচরণ করা । রাহুলের খারাপ কথা দেখে মোদির অমনোযোগী থাকার কারণ আছে । মহারাষ্ট্রের ফলাফল এখন বিরোধী দলের দলনেতার সঙ্গেও সংযুক্ত করা উচিত ৷
(এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের । এখানে প্রকাশিত তথ্য এবং মতামত ইটিভি ভারত-এর মতামতকে প্রতিফলিত করে না ৷)