মন্দার খুব সাধারণ নিয়ম হল, পরপর দুই ত্রৈমাসিকের জন্য জিডিপিতে যে কোনও নেতিবাচক প্রবণতা মন্দা হিসাবে বিবেচিত হয় । এটি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যাপক প্রভাব ফলে এবং দীর্ঘ সময় ধরে মন্দা চলে, যা বিশ্বজুড়ে অর্থনীতির বিভিন্ন দিককে প্রতিফলিত করে ।
2023 সালে কঠিন অর্থনৈতিক অবস্থার সম্মুখীণ হয়েছে বিশ্ব ৷ এর ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতি অপ্রীতিকর অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং 2024 জুড়েও তা বজায় থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে ৷ সর্বশেষ ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের জানুয়ারি 2024 চিফ ইকোনমিক আউটলুক অনুসারে, এটি পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে যে চলতি বছর অর্থাৎ 2024 সালে বিশ্ব অর্থনীতি দুর্বল হবে ।
তবে 2024 সালে ভূ-অর্থনৈতিক বিভাজনের গতি ত্বরান্বিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে । আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পূর্বাভাস অনুযায়ী, 2024 সালে বৈশ্বিক মূল্য বৃদ্ধির হার সামান্য হ্রাস হয়েছে ৷ 2023 সালে 3 শতাংশ থেকে চলতি বছরে 2.9 শতাংশ হ্রাস হয়েছে ৷ এই মূল্য বৃদ্ধির হার বেশিরভাগই উদীয়মান বাজারের কার্যকলাপের ফলে ঘটেছে ৷ তবে উন্নত অর্থনীতিতে মূল্য বৃদ্ধির হার কমে গিয়েছে ৷
বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা মন্দার আগুনে আঁচ দিচ্ছে এবং এটি 2024 সালে শ্রম বাজার ও আর্থিক অবস্থার উপর প্রভাব ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে । অর্থনীতিবিদরা আশা করছেন, উন্নত দেশগুলিতে শ্রম বাজারে 77 শতাংশ এবং আর্থিক ক্ষেত্রে 70 শতাংশের মধ্যে স্লিপ ওভার হবে ৷ বিশেষজ্ঞদের 56 শতাংশ আশা করছেন যা বাজারের অবস্থা তাতে আগামী বছর বিশ্ব অর্থনীতি দুর্বল হবে । 69 শতাংশ বিশেষজ্ঞ আবার চলতি বছর ভৌগলিক-অর্থনৈতিক বিভাজনের গতি ত্বরান্বিত হবে বলে আশা করছেন ৷
অর্থনীতিবিদদের আশা, আগামী তিন বছরে সাম্প্রতিক ভূ-রাজনৈতিক উন্নয়নগুলি বিশ্ব অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্যভাবে 87 শতাংশ অস্থিরতা, 86 শতাংশ অর্থনৈতিক কার্যকলাপের স্থানীয়করণ, 80 শতাংশ শেয়ার বাজারের অস্থিরতা, 80 শতাংশ ভূ-অর্থনৈতিক ব্লকে, 57 শতাংশ অসমতা এবং উত্তর-দক্ষিণ বিমুখতা, 36 শতাংশ বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে বিপর্যয় এবং 13 শতাংশ অর্থনৈতিক কার্যকলাপের বিশ্বায়নে বৃদ্ধি পাবে ৷
জাপান ও ব্রিটেনে মন্দা
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের আউটলুক অনুসারে, বিশ্বব্যাপী মূল্য বৃদ্ধির হার 2022 সালে 3.5 শতাংশ থেকে 2023 সালে 3 শতাংশে এবং 2024 সালে আরও 2.9 শতাংশে হ্রাস পাবে বলে অনুমান করা হয়েছে ৷ বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি জাপান এবং ব্রিটেনের ৷ তারা সম্প্রতি মন্দার মধ্যে পড়েছে বলে জানা গিয়েছে ৷ গার্হস্থ্য খরচ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার কারণে আজ জাপান আর বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি নেই, দেশটিকে মন্দার দিকে ঠেলে দিয়েছে এবং অর্থনীতিতে জার্মানির পরে চতুর্থ স্থানে নেমে গিয়েছে জাপান । আগের ত্রৈমাসিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর ত্রৈমাসিক) 3.3 শতাংশ মন্দার পরে জাপানে জিডিপির পরিপ্রেক্ষিতে 2023 সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর ত্রৈমাসিক অর্থনীতি 0.4 শতাংশে নেমে গিয়েছে । এটি বাজারের পূর্বাভাসের চেয়ে অনেক কম ।
ব্রিটেন বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম অর্থনীতি ছিল ৷ সেখান থেকে স্থানচ্যুত হয়েছে ৷ 2023 সালে একটি প্রযুক্তিগত মন্দার মধ্যে পড়ে গিয়েছে এই দেশে । এটি সমগ্র বিশ্বের জন্য ভালো লক্ষণ নয় । কান্ট্রিস অফিস ফর ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিকস (ওএনএস) এর তথ্য অনুযায়ী, ব্রিটেনের জিডিপি অক্টোবর-ডিসেম্বর, 2023 এর মধ্যে 0.3 শতাংশ এবং জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে 0.1 শতাংশে নেমে গিয়েছে । ওএনএসের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্রিটেনের প্রায় 46 শতাংশ মানুষের জীবনযাত্রার খরচ বৃদ্ধির পেয়েছে ৷ এর থেকে বোঝা যাচ্ছে ইউরোপের কিছু দেশও ধীরে ধীরে মন্দার মধ্যে ডুবে যাচ্ছে এবং এটি সারা বিশ্বে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে ।
ভারতীয় অর্থনীতির হালহকিকৎ
শক্তিশালী আর্থিক বৃদ্ধি হারের সম্ভাবনা নিয়ে বিশ্বে আজ এগিয়ে রয়েছে ভারত । বিশ্বের একটি বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারত ৷ ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, জনসংখ্যার সমস্যা এবং অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ভারতের অর্থনীতি জ্বলজ্বল করছে । ভারত বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি ৷ এই প্রেক্ষাপটে ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার নিয়ে আইএমএফের অনুমান লক্ষণীয় । আইএমএফ অনুসারে, 2024 এবং 2025 উভয় বছরেই ভারতের অর্থনীতি শক্তিশালী থাকবে এবং অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার 6.5 শতাংশে থাকবে বলে অনুমান করা হয়েছে ।
আইএমএফsর মতে, আগামী বছরগুলিতে ভারতের অর্থনীতি জাপান, জার্মানি এবং অন্যান্যকে ছাড়িয়ে যাবে। জাপানের নমিনাল জিডিপি প্রায় 4.19 ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং জার্মানির জিডিপি 2023 সালের শেষ নাগাদ প্রায় 4.55 ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিল । ভারত দশ বছর আগে 10 অবস্থানে ছিল ৷ সেসময় ভারতের জিডিপি ছিল 1.9 ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিল ৷ বর্তমানে 3.7 ট্রিলিয়ন জিডিপি বেড়ে ভারত বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে । ভারত আগামী তিন বছরে 5 ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থনীতিতে পরিণত হবে এবং 2030 সালের মধ্যে 7.0 ট্রিলিয়ন ছুঁয়ে যাবে ৷ এমনটি চলতি বছরের 29 জানুয়ারি কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন জানিয়েছেন ৷ 2047 সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশ থেকে ভারত উন্নত দেশে পরিণত হবে ৷ এমনটাই লক্ষ্যমাত্রার কথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রক জানিয়েছে ৷
ভারতের জিডিপি 1960 থেকে 2020 সাল পর্যন্ত গড়ে 741.93 বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিল ৷ এরপর 2022 সালে সর্বোচ্চ রেকর্ড গড়ে 3416.65 বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে ৷
আইবিআই গভর্নর শক্তিকান্ত দাস দাভোস 2024 অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ভারতের মুদ্রাস্ফীতি 4 শতাংশে চলছে এবং 4 শতাংশের এই মাঝারি হার পরের বছর অব্যাহত থাকবে । তিনি জানিয়েছেন বিশ্বব্যাপী মন্দার প্রভাব ভারতে পড়েনি এবং পরে নাও পরতে পারে ৷ তিনি দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন, উন্নত এবং উদীয়মান অর্থনীতির ভালো অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে মন্দার সম্মুখীণ হয়নি ভারত । আইবিআই প্রধানের কথায়, চলতি বছর-সহ টানা তিন বছরে জিডিপি বৃদ্ধির হার বেড়েছে । 2024-25 আর্থিক বছরে জিডিপি প্রত্যাশিত বৃদ্ধি পেয়ে 7 শতাংশ হবে এবং অন্যান্য দেশের তুলনায় ভারতের জিডিপি অনেক বেশি চাঙ্গা ।
অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) এর সর্বশেষ জিডিপি বৃদ্ধির হার অনুমান অনুসারে, 2023 সালে ভারতের বৃদ্ধির হার ছিল 6.3 শতাংশ, যা চিন (5.2 শতাংশ) এবং ব্রাজিল (3 শতাংশ) থেকে অনেক বেশি এগিয়ে ৷ ভারত2024 সালে 6.1 শতাংশ জিডিপি বৃদ্ধির হার আশা করছে এবং চিন 4.7 শতাংশ হারে । অন্যদিকে আমেরিকা, ব্রিটেন, জাপানের আগামী বছর জিডিপি বৃদ্ধির হার নামমাত্র বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে । 2023 সালে বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় অর্থনীতির হাল অনেক ভালো ছিল ।
গোল্ডম্যান শ্যাক্স তাঁর 'ইন্ডিয়া 2024 আউটলুক'-এ বলেছে যে রিপিটেড সাপ্লাই সাইড শক 2024 সালে মূল মুদ্রাস্ফীতিকে 5.1 শতাংশের উপরে রাখতে পারে । গোল্ডম্যান শ্যাক্স 2024 সালে ভারতের জিডিপি বৃদ্ধি 6.3 শতাংশ অনুমান করেছেন ।
অর্থনীতি চাঙ্গা করতে প্রয়োজন
মন্দা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আর্থিক নীতির কাঠামোগত সংস্কার এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার অন্তর্ভুক্ত একটি বহুমুখী পদ্ধতির প্রয়োজন । জাপানকে গৃহ খরচে নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনকে কাজে লাগাতে হবে ৷ জাপানের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে জনসংখ্যার ভারসাম্য মোকাবিলা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । ব্রিটেনেj অর্থনীতি চাঙ্গা করতে দরকার একটি অনুকূল ব্যবসায়িক পরিবেশ গড়ে তোলা, বৈশ্বিক অংশীদারদের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদার করা এবং অবকাঠামো ও দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগ, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ৷
আরও পড়ুন: