বর্ধমান, 14 জানুয়ারি: রাজ আমলে ছিল ময়ূরপঙ্খি মেলা ৷ বর্ধমানে মকর সংক্রান্তির সময় দামোদর নদের তীরে বসতো ময়ূরপঙ্খি গানের আসর ৷ আর সেই গানের আসরকে কেন্দ্র করে মেলাও বসতো ৷ পরবর্তীকালে ময়ূরপঙ্খি গান ও মেলা বন্ধ হয়ে যায় ৷ কিন্ত, সেই মেলায় যুক্ত হয়েছিল ঘুড়ি ওড়ানোর চল ৷ আর তখন থেকে শুরু হয় ঘুড়ির মেলা ৷ তবে একদিন নয়, তিনদিন ধরে চলে এই ঘুড়ির মেলা ৷
ইতিহাসের গবেষক সর্বজিৎ যশ জানিয়েছেন, তিনদিন ধরে ঘুড়ির মেলা ভারতবর্ষের আর কোথাও হয় বলে জানা নেই ৷ ঘুড়ির মেলাকে কেন্দ্র করে দিল্লি, হায়দরাবাদ, উত্তরপ্রদেশ, লখনউ, বিহার-সহ দেশে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা ভিড় করেন ৷ তিনমাসের জন্য দোকান ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করতে আসেন তাঁরা ৷
বাংলার লোকসাহিত্য থেকে জানা যায়, ময়ূরপঙ্খি নৌকার ইতিহাস প্রায় আড়াইশো থেকে তিনশো বছরের পুরনো ৷ মূলত, নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ৷ যেখানে নৌকার উপর মানুষের জীবন নির্ভর করত ৷ সেই সব জায়গায় ময়ূরপঙ্খি গান গাওয়া হতো ৷ ফলে অবিভক্ত বাংলার পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের নদী তীরবর্তী এলাকায় এই গান শোনা যেত ৷
সর্বজিৎ যশ বলেন, "ময়ূরপঙ্খি একধরনের লোকগান ৷ বিভিন্ন রাজ্য থেকে ময়ূরপঙ্খি গানের শিল্পীরা মকর সংক্রান্তির দিন রাজবাড়িতে আসতেন ৷ সেখানে ময়ূরপঙ্খি গানের লড়াই হতো ৷ এটা আসলে রাধাকৃষ্ণের লীলা নিয়ে গানের লড়াই ৷ সেখানে যাঁরা জিততেন, তাঁদের বর্ধমান রাজবাড়ির তরফে পুরস্কৃত করা হতো ৷ সেই ময়ূরপঙ্খি গানের লড়াইকে কেন্দ্র করে দামোদরের সদর ঘাটে ময়ূরপঙ্খি মেলা বসত ৷ এই সময় গরুর গাড়িগুলিকে ময়ূরের পেখমের মতো করে সাজানো হতো ৷"
কিন্তু, সেই মেলা কীভাবে ঘুড়ির মেলার রূপ নিল ? এ নিয়ে ইতিহাসবিদ সর্বজিৎ বলেন, "রাজবাড়িতে একটা সময় মকর সংক্রান্তিতে ঘুড়ি ওড়ানোর প্রথা শুরু হয় ৷ যা ধীরে-ধীরে তৎকালীন পুরো বর্ধমান রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে ৷ স্বাধীনতার পর 1950-এর দশকে রাজার শাসনের অবসান ঘটে ৷ সেই সময় ময়ূরপঙ্খি মেলাও বন্ধ হয়ে যায় ৷ কিন্তু, মকর সংক্রান্তিতে যে ঘুড়ি ওড়ানোর চল শুরু হয়েছিল, তা বজায় থাকে ৷ আর দামোদরের সদর ঘাটে ময়ূরপঙ্খি মেলার জায়গায় শুরু হয় ঘুড়ির মেলা ৷ সেটিও বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ৷"
উল্লেখ্য, বর্ধমানের রাজা বিজয়চাঁদ মহাতবের পৃষ্ঠপোষকতায় ঘুড়ি ওড়ানোর রীতি ছিল ৷ সেই রীতিই পরবর্তী সময়ে ঘুড়ির মেলার রূপ পায় ৷ তিনদিনের এই মেলার প্রথমদিনে অর্থাৎ, মকর সংক্রান্তির দিনে বর্ধমানের শহরের বাসিন্দারা নিজেদের বাড়ির ছাদে ঘুড়ি ওড়ান ৷ মেলা থেকে রাতভর ঘুড়ি বেচাকেনা চলে ৷ দ্বিতীয় দিনে মেলা বসে দামোদর নদের তীরে ৷ সেখানে নানা পসরা নিয়ে বসেন ব্যবসায়ীরা ৷ তৃতীয় দিনে ছোটখাটো মেলা বসে বাহিরসর্বমঙ্গলা পাড়ায় ৷
এই মেলার প্রস্তুতি শুরু হয় সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্বকর্মা পুজোর সময় থেকে ৷ ভিনরাজ্যের ব্যবসায়ীরা স্থানীয়দের থেকে দোকানভাড়া নিয়ে তিন মাস ধরে ব্যবসা করেন ৷ মাঝরাত থেকে ঘুড়ির দোকানগুলিতে লম্বা লাইন পড়ে প্রতিবছর ৷