ETV Bharat / opinion

প্রতিরক্ষা উৎপাদন ও রফতানিতে ভারতের সম্ভাবনা - Defence Production and Exports

author img

By ETV Bharat Bangla Team

Published : Jun 30, 2024, 12:01 PM IST

Defence Production and Exports: প্রতিরক্ষা উৎপাদন ও রফতানিতে ভারতের অগ্রগতি ক্রমশ দেখা যাচ্ছে ৷ তবে বিশ্বের শীর্ষসারির দেশগুলির সঙ্গে একাসনে বসতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রয়োজন ৷ তবে এ ক্ষেত্রের ভারতের সম্ভাবনা রয়েছে ৷ এই নিয়ে লিখেছেন বিডিএলের প্রাক্তন ডিরেক্টর (প্রোডাকশন) পি রাধাকৃষ্ণ ৷

Defence Production and Exports
প্রতিরক্ষা উৎপাদন ও রফতানিতে ভারতের সম্ভাবনা (ইটিভি ভারত)

প্রতিরক্ষা উৎপাদন ও রফতানির ক্ষেত্রে ভারতে অস্ত্র উৎপাদনের উত্থান একটি ধীরগতির প্রক্রিয়া ৷ এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে একাধিক ফ্যাক্টর ৷ তার মধ্যে রয়েছে নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগ, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ও ভূ-রাজনৈতিক গতিশীলতা ৷ ভারতের অস্ত্র উৎপাদনের একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে ৷ স্বাধীনতার আগে যখন প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত প্রয়োজনে আমদানির উপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করতে হত, সেই সময় থেকেই অস্ত্র উৎপাদন হয়ে আসছে ।

প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা ও দেশীয় সরঞ্জাম ব্যবহারের লক্ষ্যেই স্বাধীনতার পর হ্যাল, বিইএল, বিডিএল, বিইএমএল, শিপ বিল্ডিং ইন্ডাস্ট্রিজ ও অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি বোর্ডের মতো সরকারি মালিকানাধীন সংস্থাগুলি তৈরি হয় ৷ এই সংস্থাগুলিকে বিমান, ক্ষেপণাস্ত্র, ছোট অস্ত্র, আর্টিলারি ও ইলেকট্রনিক যুদ্ধ ব্যবস্থা-সহ বিস্তৃত প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়ে থাকে ।

বছরের পর বছর ধরে ভারতের প্রতিরক্ষা শিল্পের আধুনিকীকরণ এবং তা প্রসারিত করার জন্য একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা চলছে । ভারতের স্বনির্ভরতা এবং কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন বৃদ্ধিতে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে দেশীয় উৎপাদন বাড়ানো এবং প্রযুক্তি উন্নয়নের গুরুত্ব কতটা, তা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মাধ্য়মে বোঝা যায় ৷ ভারতের প্রতিরক্ষা শিল্পকে শক্তিশালী করা ও বিদেশি আমদানির উপর নির্ভরতা কমানোর জন্য এই ক্ষেত্রে সংস্কার ও বিনিয়োগের অনুঘটক হিসাবে কাজ করেছিল কার্গিল যুদ্ধ ।

‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ ও পাবলিক-প্রাইভেট অংশীদারিত্ব বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে প্রতিরক্ষায় দেশীয় উৎপাদন এবং উদ্ভাবনকে উন্নত করার জন্য । গত 10 বছরে ভারতের প্রতিরক্ষা খাতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে । বছরের পর বছর ধরে নীতি-নির্ধারকেরা বিতর্ক চলছে যে কিভাবে ভারতের উৎপাদন ক্ষেত্রে গতি আনা যায় ও ভারতকে একটি গ্লোবাল ম্যানুফ্যাকচারিং হাব করা যায় । কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার 'মেক ইন ইন্ডিয়া' ও 'আত্মনির্ভর ভারত'-এর অধীনে অনেক সংস্কার চালু করেছেন ৷ এর ফলে বিনিয়োগের সুবিধার্থে ভারতের মরিবন্ড প্রতিরক্ষা শিল্পকে শক্তিশালী করতে, উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করতে, দক্ষতার বিকাশ বৃদ্ধি করতে, মেধাসম্পদ রক্ষা করতে ও সর্বোত্তমভাবে গড়ে তুলতে সাহায্য হচ্ছে । প্রযুক্তি হস্তান্তর, যৌথ উদ্যোগ ও প্রতিরক্ষা খাতে বিদেশি প্রতিরক্ষা সংস্থাগুলির সহযোগিতা যেমন জড়িত, তেমনই দেশীয় উৎপাদনকে উন্নত করার লক্ষ্যে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ অভিযানও চলছে ৷

ভারতের প্রতিরক্ষা ক্রয় নীতিতে পরিবর্তন হয়েছে ৷ ডিফেন্স প্রকিউরমেন্ট প্রসিডিউর (ডিপিপি) ও কৌশলগত অংশীদারিত্ব মডেল তৈরি হয়েছে ৷ এর লক্ষ্য ছিল প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও উৎপাদনে দেশীয় সক্ষমতা বাড়ানো ৷ এই শিল্পকে উৎপাদনের জন্য বৃহত্তর দায়িত্ব নিতে সক্ষম করার পাশাপাশি সরকারের তরফে ডিআরডিও-র মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য ডিপিএসইউ-এর দ্বারা কিছুটা পর্যন্ত অধিগ্রহণ করা হয়েছে ৷ সরকারের তরফে ডিপিপি ও ডিএপি-এর ক্ষেত্রে 'মেক' নির্দেশিকাগুলিকে সরলীকরণ করা হয়েছে ৷ আর দুটি উদ্ভাবন-ভিত্তিক স্কিম চালু করা হয়েছে ৷ সেগুলি হল - প্রতিরক্ষায় শ্রেষ্ঠত্বের জন্য উদ্ভাবন (আইডিইএক্স) ও প্রযুক্তি উন্নয়ন তহবিল (টিডিএফ) ৷

এখন সরকারি উদ্যোগ, ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষা কোম্পানি ও বিদেশি সংস্থাগুলির সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে ভারতের অস্ত্র উৎপাদনের কাজ চলছে ৷ ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি, নৌ জাহাজ নির্মাণ এবং বিমান তৈরির মতো ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে দেশ । একই সঙ্গে এখন গবেষণা ও উন্নয়নের উপর ক্রমশ জোর দেওয়া হচ্ছে । এক্ষেত্রে প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা (ডিআরডিও)-র মতো প্রতিষ্ঠান উদ্ভাবন ও দেশীয় প্রযুক্তি উন্নত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ৷

ভারতের অস্ত্র উৎপাদনের ক্ষেত্র আজ একটি বৈচিত্র্যময় ও বিকশিত ইকোসিস্টেমকে প্রতিফলিত করে, যার মধ্যে বিস্তৃত ক্ষমতা ও অংশীদারিত্ব রয়েছে । আমলাতান্ত্রিক প্রতিবন্ধকতা, পরিকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা এবং প্রযুক্তিগত ব্যবধানের মতো চ্যালেঞ্জগুলি অব্যাহত থাকলেও, ভারতের প্রতিরক্ষা শিল্প ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং দেশের নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তা মেটাতে মানিয়ে চলেছে ৷

ভবিষ্যতে নতুন প্রযুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে শীর্ষ দেশগুলির সঙ্গে সমতা অর্জন করা একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ৷ তবে উদ্ভাবনের প্রতি ভারতের প্রতিশ্রুতি, গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ, কৌশলগত অংশীদারিত্ব এবং দেশীয় প্রযুক্তির উন্নয়ন প্রচেষ্টা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি প্রদান করে ৷ ক্রমাগত নজর, সহযোগিতা এবং অধ্যবসায় ভারতের জন্য বিশ্ব প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে একটি নেতৃস্থানীয় জায়গায় পৌঁছানোর জন্য অপরিহার্য হবে । গবেষণা ও উন্নয়ন এবং উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারলে ভারতের স্বদেশীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্র বিশ্বব্যাপী উৎপাদন কেন্দ্র হিসাবে আবির্ভূত হতে প্রস্তুত রয়েছে । দেশীয় প্রতিরক্ষা উৎপাদন বৃদ্ধিতে কেনার ক্ষমতা বৃদ্ধির তাৎপর্য একটি সমীক্ষায় উঠে এসেছে ৷ বর্তমানে ভারত 75টিরও বেশি দেশে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম রফতানি করে ৷ বিশ্বের প্রতিরক্ষা বাজারে ভারত ক্রমশ নিজের ক্ষমতা প্রদর্শন করতে শুরু করেছে ৷

2023-24 আর্থিক বছরে প্রতিরক্ষা রফতানি 21 হাজার 83 কোটি টাকা (আনুমানিক 2.63 বিলিয়ন মার্কিন ডলার) ছুঁয়েছে, যা গত অর্থবর্ষের তুলনায় 32.5 শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে ৷ গত আর্থিক বছরে এর পরিমাণ ছিল 15 হাজার 920 কোটি টাকা ৷ সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুয়ায়ী, প্রতিরক্ষা রফতানি গত 10 বছরে 2013-14 অর্থবর্ষের তুলনায় 31 গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে ।

দুই দশকের একটি তুলনামূলক তথ্য অনুযায়ী 2004-05 থেকে 2013-14 ও 2014-15 থেকে 2023-24 পর্যন্ত সময়কালে প্রতিরক্ষা রফতানি 21 গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে । 2004-05 থেকে 2013-14 পর্যন্ত মোট প্রতিরক্ষা রফতানির পরিমাণ ছিল 4 হাজার 312 কোটি টাকা ৷ 2014-15 থেকে 2023-24 পর্যন্ত সময়ে তা বেড়ে হয় 88 হাজার 319 কোটি টাকা ৷ নীতিগত সংস্কার ও ‘ইজ অফ ডুয়িং বিজনেস’-এর কারণে এই উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি হয়েছে ।

প্রতিরক্ষা রফতানি প্রচারের জন্য ভারতীয় শিল্পগুলিকে এন্ড-টু-এন্ড ডিজিটাল সমাধান ছাড়াও সরকারি তরফে একাধিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ৷ এই বৃদ্ধি ভারতীয় প্রতিরক্ষা পণ্য ও প্রযুক্তির বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতার প্রতিফলন । 2022 সালে বিশ্বব্যাপী মহাকাশ ও প্রতিরক্ষা বাজারের আকার ছিল প্রায় 750 বিলিয়ন মার্কিন ডলার ৷ 2023 থেকে 2030-এর মধ্যে চক্রবৃদ্ধি হারে প্রায় 8.2 শতাংশ বার্ষিক বৃদ্ধি হতে পারে ৷ যার ফলে এই বাজার 2030 সালের মধ্যে প্রায় 1388 বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছাবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে ।

প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম, প্রযুক্তি ও পরিষেবাগুলির ক্রমবর্ধমান চাহিদার মধ্যে ভারতের এয়ারো স্পেস এবং প্রতিরক্ষা সেক্টরে 2023-24 থেকে 2032 সাল পর্যন্ত 138 বিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি লাভজনক বরাতের সুযোগ রয়েছে, যা প্রতিরক্ষা উৎপাদন ও প্রযুক্তি উন্নয়নে নিযুক্ত কোম্পানিগুলির জন্য উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে বলে একটি রিপোর্টে জানা গিয়েছে ৷ ওই রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের প্রতিরক্ষা মূলধন ব্যয় 2030 সালের মধ্যে মোট বাজেটের 37 শতাংশে উন্নীত হতে চলেছে ৷ 2025-এ এই বাজেটের পরিমাণ 29 শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে অনুমান করা হয়েছিল ৷ ফলে নয়া রিপোর্টে বৃদ্ধির অনুমান যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য ৷ এটা 2030-এর তুলনায় 15.5 ট্রিলিয়ন টাকার ক্রমবর্ধমান মূলধন ব্যয়ের সমান, যা পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয় । ভারত সরকারে সক্রিয়ভাবে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রকে সহায়তা করছে ৷ এর জন্য নীতি সংস্কার, উৎসাহ ভাতা দেওয়া এবং দেশীয় উৎপাদন ও প্রযুক্তির উন্নয়নের কাজ করা হচ্ছে ৷ আমরা আশা করছি যে প্রতিরক্ষা মূলধন ব্যয়ের অংশ 2030 সালে মোট প্রতিরক্ষা বাজেটের 37 শতাংশ বৃদ্ধি পাবে ৷

অস্ত্র গবেষণা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে নতুন প্রযুক্তির বিষয়ে শীর্ষ দেশগুলির সঙ্গে সমতা অর্জন করা একটি জটিল ও বহুমুখী লক্ষ্য ৷ এর জন্য স্থায়ী প্রচেষ্টা, বিনিয়োগ ও কৌশলগত পরিকল্পনা প্রয়োজন । যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ভারত উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে ৷ তবুও এটি আরও প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত দেশগুলির সঙ্গে যোগাযোগ করার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে । যাই হোক, ভারতের ব্যবধান সংকুচিত করার ও শেষ পর্যন্ত ভবিষ্যতে শীর্ষ দেশগুলির সঙ্গে সমতা অর্জনের সম্ভাবনা যে রয়েছে, তার কয়েকটি কারণ আছে : ভবিষ্যতে নতুন প্রযুক্তির ক্ষেত্রে শীর্ষ দেশগুলির সঙ্গে সমতা অর্জন করা একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ ৷ উদ্ভাবন এবং বিনিয়োগের প্রতি ভারতের প্রতিশ্রুতি গবেষণা ও উন্নয়নে, কৌশলগত অংশীদারিত্ব এবং দেশীয় প্রযুক্তি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তৈরি করতে হবে ৷ এর ফলে শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি হবে ৷ ক্রমাগত নজর, সহযোগিতা ও অধ্যবসায় ভারতকে বিশ্ব প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে একটি নেতৃস্থানীয় জায়গায় পৌঁছাতে সাহায্য করবে ৷

প্রতিরক্ষা উৎপাদন ও রফতানির ক্ষেত্রে ভারতে অস্ত্র উৎপাদনের উত্থান একটি ধীরগতির প্রক্রিয়া ৷ এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে একাধিক ফ্যাক্টর ৷ তার মধ্যে রয়েছে নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগ, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ও ভূ-রাজনৈতিক গতিশীলতা ৷ ভারতের অস্ত্র উৎপাদনের একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে ৷ স্বাধীনতার আগে যখন প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত প্রয়োজনে আমদানির উপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করতে হত, সেই সময় থেকেই অস্ত্র উৎপাদন হয়ে আসছে ।

প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা ও দেশীয় সরঞ্জাম ব্যবহারের লক্ষ্যেই স্বাধীনতার পর হ্যাল, বিইএল, বিডিএল, বিইএমএল, শিপ বিল্ডিং ইন্ডাস্ট্রিজ ও অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি বোর্ডের মতো সরকারি মালিকানাধীন সংস্থাগুলি তৈরি হয় ৷ এই সংস্থাগুলিকে বিমান, ক্ষেপণাস্ত্র, ছোট অস্ত্র, আর্টিলারি ও ইলেকট্রনিক যুদ্ধ ব্যবস্থা-সহ বিস্তৃত প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়ে থাকে ।

বছরের পর বছর ধরে ভারতের প্রতিরক্ষা শিল্পের আধুনিকীকরণ এবং তা প্রসারিত করার জন্য একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা চলছে । ভারতের স্বনির্ভরতা এবং কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন বৃদ্ধিতে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে দেশীয় উৎপাদন বাড়ানো এবং প্রযুক্তি উন্নয়নের গুরুত্ব কতটা, তা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মাধ্য়মে বোঝা যায় ৷ ভারতের প্রতিরক্ষা শিল্পকে শক্তিশালী করা ও বিদেশি আমদানির উপর নির্ভরতা কমানোর জন্য এই ক্ষেত্রে সংস্কার ও বিনিয়োগের অনুঘটক হিসাবে কাজ করেছিল কার্গিল যুদ্ধ ।

‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ ও পাবলিক-প্রাইভেট অংশীদারিত্ব বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে প্রতিরক্ষায় দেশীয় উৎপাদন এবং উদ্ভাবনকে উন্নত করার জন্য । গত 10 বছরে ভারতের প্রতিরক্ষা খাতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে । বছরের পর বছর ধরে নীতি-নির্ধারকেরা বিতর্ক চলছে যে কিভাবে ভারতের উৎপাদন ক্ষেত্রে গতি আনা যায় ও ভারতকে একটি গ্লোবাল ম্যানুফ্যাকচারিং হাব করা যায় । কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার 'মেক ইন ইন্ডিয়া' ও 'আত্মনির্ভর ভারত'-এর অধীনে অনেক সংস্কার চালু করেছেন ৷ এর ফলে বিনিয়োগের সুবিধার্থে ভারতের মরিবন্ড প্রতিরক্ষা শিল্পকে শক্তিশালী করতে, উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করতে, দক্ষতার বিকাশ বৃদ্ধি করতে, মেধাসম্পদ রক্ষা করতে ও সর্বোত্তমভাবে গড়ে তুলতে সাহায্য হচ্ছে । প্রযুক্তি হস্তান্তর, যৌথ উদ্যোগ ও প্রতিরক্ষা খাতে বিদেশি প্রতিরক্ষা সংস্থাগুলির সহযোগিতা যেমন জড়িত, তেমনই দেশীয় উৎপাদনকে উন্নত করার লক্ষ্যে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ অভিযানও চলছে ৷

ভারতের প্রতিরক্ষা ক্রয় নীতিতে পরিবর্তন হয়েছে ৷ ডিফেন্স প্রকিউরমেন্ট প্রসিডিউর (ডিপিপি) ও কৌশলগত অংশীদারিত্ব মডেল তৈরি হয়েছে ৷ এর লক্ষ্য ছিল প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও উৎপাদনে দেশীয় সক্ষমতা বাড়ানো ৷ এই শিল্পকে উৎপাদনের জন্য বৃহত্তর দায়িত্ব নিতে সক্ষম করার পাশাপাশি সরকারের তরফে ডিআরডিও-র মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য ডিপিএসইউ-এর দ্বারা কিছুটা পর্যন্ত অধিগ্রহণ করা হয়েছে ৷ সরকারের তরফে ডিপিপি ও ডিএপি-এর ক্ষেত্রে 'মেক' নির্দেশিকাগুলিকে সরলীকরণ করা হয়েছে ৷ আর দুটি উদ্ভাবন-ভিত্তিক স্কিম চালু করা হয়েছে ৷ সেগুলি হল - প্রতিরক্ষায় শ্রেষ্ঠত্বের জন্য উদ্ভাবন (আইডিইএক্স) ও প্রযুক্তি উন্নয়ন তহবিল (টিডিএফ) ৷

এখন সরকারি উদ্যোগ, ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষা কোম্পানি ও বিদেশি সংস্থাগুলির সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে ভারতের অস্ত্র উৎপাদনের কাজ চলছে ৷ ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি, নৌ জাহাজ নির্মাণ এবং বিমান তৈরির মতো ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে দেশ । একই সঙ্গে এখন গবেষণা ও উন্নয়নের উপর ক্রমশ জোর দেওয়া হচ্ছে । এক্ষেত্রে প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা (ডিআরডিও)-র মতো প্রতিষ্ঠান উদ্ভাবন ও দেশীয় প্রযুক্তি উন্নত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ৷

ভারতের অস্ত্র উৎপাদনের ক্ষেত্র আজ একটি বৈচিত্র্যময় ও বিকশিত ইকোসিস্টেমকে প্রতিফলিত করে, যার মধ্যে বিস্তৃত ক্ষমতা ও অংশীদারিত্ব রয়েছে । আমলাতান্ত্রিক প্রতিবন্ধকতা, পরিকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা এবং প্রযুক্তিগত ব্যবধানের মতো চ্যালেঞ্জগুলি অব্যাহত থাকলেও, ভারতের প্রতিরক্ষা শিল্প ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং দেশের নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তা মেটাতে মানিয়ে চলেছে ৷

ভবিষ্যতে নতুন প্রযুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে শীর্ষ দেশগুলির সঙ্গে সমতা অর্জন করা একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ৷ তবে উদ্ভাবনের প্রতি ভারতের প্রতিশ্রুতি, গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ, কৌশলগত অংশীদারিত্ব এবং দেশীয় প্রযুক্তির উন্নয়ন প্রচেষ্টা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি প্রদান করে ৷ ক্রমাগত নজর, সহযোগিতা এবং অধ্যবসায় ভারতের জন্য বিশ্ব প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে একটি নেতৃস্থানীয় জায়গায় পৌঁছানোর জন্য অপরিহার্য হবে । গবেষণা ও উন্নয়ন এবং উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারলে ভারতের স্বদেশীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্র বিশ্বব্যাপী উৎপাদন কেন্দ্র হিসাবে আবির্ভূত হতে প্রস্তুত রয়েছে । দেশীয় প্রতিরক্ষা উৎপাদন বৃদ্ধিতে কেনার ক্ষমতা বৃদ্ধির তাৎপর্য একটি সমীক্ষায় উঠে এসেছে ৷ বর্তমানে ভারত 75টিরও বেশি দেশে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম রফতানি করে ৷ বিশ্বের প্রতিরক্ষা বাজারে ভারত ক্রমশ নিজের ক্ষমতা প্রদর্শন করতে শুরু করেছে ৷

2023-24 আর্থিক বছরে প্রতিরক্ষা রফতানি 21 হাজার 83 কোটি টাকা (আনুমানিক 2.63 বিলিয়ন মার্কিন ডলার) ছুঁয়েছে, যা গত অর্থবর্ষের তুলনায় 32.5 শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে ৷ গত আর্থিক বছরে এর পরিমাণ ছিল 15 হাজার 920 কোটি টাকা ৷ সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুয়ায়ী, প্রতিরক্ষা রফতানি গত 10 বছরে 2013-14 অর্থবর্ষের তুলনায় 31 গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে ।

দুই দশকের একটি তুলনামূলক তথ্য অনুযায়ী 2004-05 থেকে 2013-14 ও 2014-15 থেকে 2023-24 পর্যন্ত সময়কালে প্রতিরক্ষা রফতানি 21 গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে । 2004-05 থেকে 2013-14 পর্যন্ত মোট প্রতিরক্ষা রফতানির পরিমাণ ছিল 4 হাজার 312 কোটি টাকা ৷ 2014-15 থেকে 2023-24 পর্যন্ত সময়ে তা বেড়ে হয় 88 হাজার 319 কোটি টাকা ৷ নীতিগত সংস্কার ও ‘ইজ অফ ডুয়িং বিজনেস’-এর কারণে এই উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি হয়েছে ।

প্রতিরক্ষা রফতানি প্রচারের জন্য ভারতীয় শিল্পগুলিকে এন্ড-টু-এন্ড ডিজিটাল সমাধান ছাড়াও সরকারি তরফে একাধিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ৷ এই বৃদ্ধি ভারতীয় প্রতিরক্ষা পণ্য ও প্রযুক্তির বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতার প্রতিফলন । 2022 সালে বিশ্বব্যাপী মহাকাশ ও প্রতিরক্ষা বাজারের আকার ছিল প্রায় 750 বিলিয়ন মার্কিন ডলার ৷ 2023 থেকে 2030-এর মধ্যে চক্রবৃদ্ধি হারে প্রায় 8.2 শতাংশ বার্ষিক বৃদ্ধি হতে পারে ৷ যার ফলে এই বাজার 2030 সালের মধ্যে প্রায় 1388 বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছাবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে ।

প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম, প্রযুক্তি ও পরিষেবাগুলির ক্রমবর্ধমান চাহিদার মধ্যে ভারতের এয়ারো স্পেস এবং প্রতিরক্ষা সেক্টরে 2023-24 থেকে 2032 সাল পর্যন্ত 138 বিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি লাভজনক বরাতের সুযোগ রয়েছে, যা প্রতিরক্ষা উৎপাদন ও প্রযুক্তি উন্নয়নে নিযুক্ত কোম্পানিগুলির জন্য উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে বলে একটি রিপোর্টে জানা গিয়েছে ৷ ওই রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের প্রতিরক্ষা মূলধন ব্যয় 2030 সালের মধ্যে মোট বাজেটের 37 শতাংশে উন্নীত হতে চলেছে ৷ 2025-এ এই বাজেটের পরিমাণ 29 শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে অনুমান করা হয়েছিল ৷ ফলে নয়া রিপোর্টে বৃদ্ধির অনুমান যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য ৷ এটা 2030-এর তুলনায় 15.5 ট্রিলিয়ন টাকার ক্রমবর্ধমান মূলধন ব্যয়ের সমান, যা পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয় । ভারত সরকারে সক্রিয়ভাবে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রকে সহায়তা করছে ৷ এর জন্য নীতি সংস্কার, উৎসাহ ভাতা দেওয়া এবং দেশীয় উৎপাদন ও প্রযুক্তির উন্নয়নের কাজ করা হচ্ছে ৷ আমরা আশা করছি যে প্রতিরক্ষা মূলধন ব্যয়ের অংশ 2030 সালে মোট প্রতিরক্ষা বাজেটের 37 শতাংশ বৃদ্ধি পাবে ৷

অস্ত্র গবেষণা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে নতুন প্রযুক্তির বিষয়ে শীর্ষ দেশগুলির সঙ্গে সমতা অর্জন করা একটি জটিল ও বহুমুখী লক্ষ্য ৷ এর জন্য স্থায়ী প্রচেষ্টা, বিনিয়োগ ও কৌশলগত পরিকল্পনা প্রয়োজন । যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ভারত উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে ৷ তবুও এটি আরও প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত দেশগুলির সঙ্গে যোগাযোগ করার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে । যাই হোক, ভারতের ব্যবধান সংকুচিত করার ও শেষ পর্যন্ত ভবিষ্যতে শীর্ষ দেশগুলির সঙ্গে সমতা অর্জনের সম্ভাবনা যে রয়েছে, তার কয়েকটি কারণ আছে : ভবিষ্যতে নতুন প্রযুক্তির ক্ষেত্রে শীর্ষ দেশগুলির সঙ্গে সমতা অর্জন করা একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ ৷ উদ্ভাবন এবং বিনিয়োগের প্রতি ভারতের প্রতিশ্রুতি গবেষণা ও উন্নয়নে, কৌশলগত অংশীদারিত্ব এবং দেশীয় প্রযুক্তি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তৈরি করতে হবে ৷ এর ফলে শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি হবে ৷ ক্রমাগত নজর, সহযোগিতা ও অধ্যবসায় ভারতকে বিশ্ব প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে একটি নেতৃস্থানীয় জায়গায় পৌঁছাতে সাহায্য করবে ৷

ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.