ETV Bharat / opinion

ভারতের সঙ্গে দুর্দান্ত সম্পর্ককে নষ্ট করছে কানাডা - INDIA CANADA RELATIONSHIP

কানাডা অভিযোগ করেছে যে, ভারত উত্তর আমেরিকার দেশে বসবাসরত শিখদের হুমকি দিতে ও খতম করতে গুপ্তচরদের একটি নেটওয়ার্ককে ব্যবহার করছে ৷ লিখেছেন রাজকমল রাও ৷

ETV BHARAT
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (ছবি: এপি)
author img

By ETV Bharat Bangla Team

Published : Oct 22, 2024, 7:58 PM IST

নয়াদিল্লি, 22 অক্টোবর: কয়েক দশক ধরে ভারত ও কানাডার মধ্যে একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে ৷ দুটি গণতন্ত্রের মধ্যে অন্যতম স্বাস্থ্যকর সম্পর্কের দৃষ্টান্ত রেখেছে ভারত-কানাডা । উভয় দেশই 56টি দেশের কমনওয়েলথ গোষ্ঠীর সিনিয়র সদস্য ৷ কমনওয়েলথ দেশগুলি তাদের সার্বভৌমত্ব এবং সরকার বজায় রেখে গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের মতো বিভিন্ন বিষয়ে সহযোগিতা করে ।

14 অক্টোবর কানাডা এবং ভারতের মধ্যে সেই সহযোগিতার সম্পর্ক নিম্নমুখী হতে শুরু করে ৷ তার কারণ হল কানাডার আনা অভিযোগ ৷ কানাডা দাবি করে, সে দেশে বসবাসকারী শিখদের হুমকি দেওয়ার জন্য ও খতম করার জন্য গুপ্তচরদের একটি নেটওয়ার্ক ব্যবহার করছে ভারত । এই অভিযোগের পর কানাডা ঘোষণা করে যে, সে দেশে ভারতের রাষ্ট্রদূত হাইকমিশনার সঞ্জয় কুমার ভার্মা-সহ ছয় ভারতীয় কূটনীতিককে তারা বহিষ্কার করছে । কূটনৈতিক এধরনের দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে যেটা প্রায়শই হয়, সেইমতোই ভারত অবিলম্বে নয়াদিল্লিতে কানাডিয়ান দূতাবাস থেকে ছয়জন সিনিয়র কূটনৈতিককে বহিষ্কার করে ।

ETV BHARAT
নরেন্দ্র মোদি ও জাস্টিন ট্রুডো (ছবি: পিটিআই)

কী হয়েছিল ? দীর্ঘ গল্পটি শুরু হয়েছিল 2023 সালের জুন মাসে ৷ কানাডিয়ান নাগরিক 45 বছরের হরদীপ সিং নিজ্জরকে পশ্চিম কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল । শিখদের জন্য স্বাধীন আবাসভূমি তৈরির পক্ষে সওয়াল করা খালিস্তানপন্থী গোষ্ঠীর নেতা ছিলেন নিজ্জর ৷

এই ঘটনার তিন মাস পর, 18 সেপ্টেম্বর কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এমন একটি কাজ করেন, যা ছিল কল্পনার অতীত এবং সম্পূর্ণরূপে অকূটনৈতিক । তিনি ওটাওয়াতে কানাডার সংসদে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন যে, 'বিশ্বাসযোগ্য কিছু অভিযোগ খতিয়ে দেখছে' তাঁর সরকার ৷ ভারতীয় সরকারি এজেন্টরা নিজ্জরকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিলেন বলে অভিযোগ এসেছে বলে জানান ট্রুডো । যদিও মোদি সরকার এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে ।

চলতি সপ্তাহে যা ঘটেছে তা ভারত ও কানাডার মধ্যে কূটনৈতিক দ্বন্দ্বের ধারাবাহিক প্রবাহ । ট্রুডো জোর দিয়ে বলেন যে, ভারত কানাডার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ অব্যাহত রেখেছে: "কানাডার মাটিতে কানাডিয়ান নাগরিকদের হুমকি দেওয়া ও হত্যা করায় বিদেশি সরকারের জড়িত থাকার বিষয়টি আমরা কখনওই সহ্য করব না ।"

ETV BHARAT
কানাডার হাই কমিশন (ছবি: পিটিআই)

তিনি বলেন যে, তাঁর সরকার মার্কিন এফবিআই দ্বারা সমর্থিত প্রমাণ সংগ্রহ করেছে যে, খালিস্তানপন্থী শিখদের হুমকি, হয়রানি এবং আক্রমণ করার জন্য ভারতীয় কূটনীতিকরা একটি সংগঠিত অপরাধ চক্র পরিচালনা করছেন । "ভারত একটি বড় ভুল করেছে।" ট্রুডোর অভিযোগ ঠিক কী, তা বোঝার জন্য এই কথাটাই যথেষ্ট ৷

ট্রুডো ভারতের ইতিহাসের প্রশংসা করেননি: শিখরা ভারতের জনসংখ্যার একটি সম্মানিত এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল ৷ পঞ্চদশ শতকে গুরু নানক দেবজি পঞ্জাবে শিখ ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ।

শিখরা সামরিক পরিষেবা, রাজনীতি, কৃষি, শিল্প এবং খেলাধুলো-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারতের উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছেন । শিখ জনগণ এবং ভারতের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই ।

প্রায় 80 বছর আগে, শিখদের একাংশ যখন দেখে যে, ভারত অবশেষে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জন করতে চলেছে এবং সম্ভবত ধর্মীয় ভিত্তিতে বিভক্ত হতে চলেছে, তখন থেকেই তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রচার শুরু করে । তাঁদের প্রশ্ন ছিল, শিখ সংখ্যালঘুরা হিন্দু বা মুসলিম নয়, তাহলে কেন শুধু শিখদের জন্য খালিস্তান নামে আলাদা রাষ্ট্র হবে না ?

1947 সালে উদ্বেগ আরও বেড়ে যায় যখন ব্রিটিশরা কুখ্যাত র‌্যাডক্লিফ লাইন (ব্রিটিশ আইনজীবী সিরিল র‌্যাডক্লিফের নামানুসারে) ব্যবহার করে পূর্বের পঞ্জাব অঞ্চলকে পূর্ব পঞ্জাবে বিভক্ত করে, যা ভারতের অংশ হয়ে ওঠে, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা ছিল শিখ এবং হিন্দু ৷ আর পশ্চিম পঞ্জাব হয়ে ওঠে পাকিস্তানের অংশ, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল মুসলিম ।

খালিস্তান আন্দোলন এই বিভাজনগুলোকে কাজে লাগায় এবং 1980-এর দশকে জঙ্গি রূপ নেয় । শিখ জঙ্গিবাদের নেতা জার্নাইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে শিখদের একটি পবিত্র ধর্মীয় স্থান অমৃতসরের স্বর্ণ মন্দিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন ।

1984 সালের জুন মাসে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি অপারেশন ব্লু স্টারের নির্দেশ দেন ৷ স্বর্ণ মন্দির থেকে জঙ্গিদের তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য এটি একটি সামরিক পদক্ষেপ ছিল, যার ফলে মন্দিরের অনেকটাই ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং জঙ্গি ও সাধারণ মানুষ-সহ অনেকেই হতাহত হন ৷

প্রতিশোধ হিসেবে শিখ দেহরক্ষীরা ইন্দিরা গান্ধিকে 1984 সালের 31 অক্টোবর হত্যা করেন ৷ এই ঘটনা দিল্লিতে শিখ বিরোধী দাঙ্গার পথ প্রশস্ত করেছিল ৷ এগুলি ছিল ভারতীয় ইতিহাসের কিছু গুরুতর মুহূর্ত ।

ETV BHARAT
অমৃতসরের একটি বাজারের ছবি (ছবি: এপি)

বাকি জঙ্গিদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ করতে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর 10 বছর লেগেছে । প্রতিরোধের অবশিষ্টাংশ কিছু শিখ পরিবার সংখ্যালঘু হয়ে পড়ায় ভারত ছেড়ে বিদেশে বসতি স্থাপন করেছিল, প্রধানত অর্থনৈতিক অভিবাসী হিসাবে । ভারত ও পাকিস্তান ছাড়া সবচেয়ে বেশি শিখ জনসংখ্যা রয়েছে কানাডায় ৷ শিখ জনসংখ্যার প্রায় 2 শতাংশ (770,00 পরিবার) সেখানে রয়েছে ।

ট্রুডো অবিবেচকের মতো কাজ করেছেন । 1990 এর দশক থেকে প্রায় নিভে আসা আগুনে তেল ঢেলে ভারতের সংবেদশনশীল অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অগ্নিশিখা জ্বালিয়ে দিয়েছেন তিনি । তাঁর দেশে ভারত-বিরোধী চক্রান্তকে দমন না-করে ট্রুডোই ভারতীয় জনগণের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছেন ৷

ন্যাচারালাইজেশন একটি কাগজের নথি হিসাবে জন্মানো দেশের প্রতি ভালোবাসা এবং দেশপ্রেমকে অস্বীকার করে না । এটি এমন একটি আইনি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি বিদেশের নাগরিকত্ব অর্জন করেন ।

বছরের পর বছর ধরে, কানাডা বিশ্বব্যাপী দেশগুলিতে অভিবাসনের জন্য উন্মুক্ত হাত প্রসারিত করেছে । এর ক্র্যাডল-টু-গ্রেভ বেনিফিট সিস্টেমের সঙ্গে, কানাডা চায় তরুণরা সেখানে গিয়ে কাজ করে দেশের উচ্চ-আয়কর প্রদান করুক, যাতে তা দিয়ে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা এবং পেনশনের মতো অসাধারণ সুবিধাগুলি কানাডার নাগরিকদের মধ্যে বিতরণ করা যায় ।

একবার একজন অভিবাসী স্থায়ী বাসিন্দা কার্ড পেলে, তিনি প্রায় তিন বছরের মধ্যে কানাডার নাগরিক হতে পারবেন । কানাডা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ, ভারতের আয়তনের প্রায় তিনগুণ । তবুও এর জনসংখ্যা প্রায় 40 মিলিয়ন, দিল্লি-জাতীয় রাজধানী অঞ্চলের জনসংখ্যার থেকেও কম ।

ন্যাচারালাইজেশন উভয় দেশের চাহিদাই পূরণ করে - কানাডার প্রয়োজন নতুন কর্মী এবং ভারতীয়দের প্রয়োজন বিদেশে পড়াশোনা, কাজ, বসবাস এবং অভিবাসনের সুযোগ । দু'পক্ষের জন্যই ন্যাচারালাইজেশন প্রয়োজনীয় ৷

কানাডার নাগরিকত্ব গ্রহণ করা নাগরিকরা তাঁদের জন্মদাত্রী দেশের জন্য তাঁদের ভালোবাসা এবং দেশপ্রেম ছাড়তে পারেন না, তবে এটা মেনে নিতে পারেন না ট্রুডো ৷ বেশিরভাগ ন্যাচারালাইজড কানাডিয়ান মূলত দ্বৈত নাগরিক, জন্মদাত্রী দেশের প্রতি তাঁদের দৃঢ় আনুগত্য রয়েছে ।

কানাডার ভারতীয় (ইন্দো-কানাডিয়ান) জনসংখ্যা হল প্রায় 1.86 মিলিয়ন মানুষ, যা সে দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় 5 শতাংশ । ট্রুডোর পদক্ষেপ এবং ভারতের বিরুদ্ধে গভীরভাবে নেতিবাচক বক্তব্য ইন্দো-কানাডিয়ানদের তাঁদের গৃহীত দেশে অস্বস্তিকর করে তুলছে ।

এটি একটি শিশুকে তার পিতা ও মাতার মধ্যে একজনকে বেছে নিতে বাধ্য করার মতো - এবং এটি একটি জি 7 নেতার মর্যাদার জন্য পরিপন্থী ৷ এমনকি ট্রুডোর অভিযোগ সত্যি হলেও (একটি বড় যদি রয়েছে), ভারতের পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে গ্রহণযোগ্য । আন্তর্জাতিক আইনে এমন যথেষ্ট নজির রয়েছে যেখানে, নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি হতে পারে এমন কোনও কিছুকে বিদেশে নির্মূল করেছে বিভিন্ন দেশ ৷

উদাহরণস্বরূপ, ইজরায়েল 60 বছরেরও বেশি সময় ধরে মোসাদের হিট স্কোয়াড নিয়োগ করে চলেছে বিদেশে তার শত্রুদের অনুসরণ করার জন্য, যে শত্রুরা ইহুদি এবং ইজরায়েল রাষ্ট্রকে আঘাত করার চেষ্টায় রয়েছে । স্টিভেন স্পিলবার্গ প্রযোজিত এবং পরিচালিত 2005 সালের মহাকাব্যিক চলচ্চিত্র মিউনিখে তুলে ধরা হয়েছে একটি সত্য ঘটনা ৷ 1972 সালে মিউনিখ অলিম্পিকে সন্ত্রাসী হামলায় ইজরায়েলি ক্রীড়াবিদকে হত্যার প্রতিশোধ নিতে ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ার কীভাবে ইজরায়েলি এজেন্টদের মুক্তি দিয়েছিলেন, সেকথা তুলে ধরা হয়েছিল সেই মুভিতে ৷

ইজরায়েলি পদক্ষেপ একটি ভিন্ন দেশের (প্যালেস্তাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন) নাগরিকদের বিরুদ্ধে ছিল । ভারতের ক্রিয়াকলাপ কানাডিয়ানদের বিরুদ্ধে ছিল, এটা সত্যি, তবে তাঁদের বিরুদ্ধেও ছিল যাঁরা ভারতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যাঁরা বেশিরভাগ জীবন ভারতে কাটিয়েছেন এবং যাঁরা কিছুদিন আগে পর্যন্তও ভারতীয় ছিলেন । কানাডা থেকে ন্যাচারালাইজেশন পেপারের একটি টুকরো এই অপরাধীদের তাঁদের জন্মের দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার অধিকার দেয় না, কারণ কানাডা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেনি ।

ন্যাচারাইলেশনের দ্বন্দ্ব - এবং আনুগত্যের পরীক্ষা - শুধুমাত্র বিরল পরিস্থিতিতে ঘটে, যেমন যখন একটি দত্তক দেশ এবং জন্মের দেশ একে-অপরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত থাকে । এছাড়াও, পারস্পরিক সম্পর্ক হিসাবে, কানাডা কি ভারতকে সেই জঙ্গিদের আশ্রয় দেওয়ার অনুমতি দেবে, যারা কানাডার ক্ষতি করতে পারে ?

ট্রুডোর অবিলম্বে নিজের বক্তব্য থেকে পিছিয়ে যাওয়া উচিত এবং জনসমক্ষে এই কুৎসিত প্রচার করা থেকে বিরত থেকে প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে কাজ করা উচিত । বিবিসির কথা অনুযায়ী, কানাডার প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রিয়তা তলানিতে এসে ঠেকেছে ৷

এক পোল ট্র্যাকারের দেওয়া তথ্য অনুসারে, প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তাঁর নবম বছরে ট্রুডোর অ্যাপ্রুভাল রেট কমে চলতি বছরের জুনে হয়েছে 28 শতাংশ ৷ প্রথম নির্বাচিত হওয়ার সময় যা ছিল 63 শতাংশ ৷ ঘরোয়া রাজনীতিতে সাহায্য করার জন্য ট্রুডোর কূটনৈতিক এই খেলা করার সময় এটা নয় । অনেক শিখ ট্রুডোর সরকারে কাজ করেন ।

ভারতীয় করদাতারা ইতিমধ্যেই সাউথ ব্লকে, যেখানে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক রয়েছে, সেখানে বিশাল দফতরের জায়গার জন্য অর্থ প্রদান করেছেন ৷ সেই কনফারেন্স রুমে গোপনীয়তার সঙ্গে এই দ্বন্দ্বের অবশ্যই দ্রুত সমাধান করা উচিত ।

নয়াদিল্লি, 22 অক্টোবর: কয়েক দশক ধরে ভারত ও কানাডার মধ্যে একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে ৷ দুটি গণতন্ত্রের মধ্যে অন্যতম স্বাস্থ্যকর সম্পর্কের দৃষ্টান্ত রেখেছে ভারত-কানাডা । উভয় দেশই 56টি দেশের কমনওয়েলথ গোষ্ঠীর সিনিয়র সদস্য ৷ কমনওয়েলথ দেশগুলি তাদের সার্বভৌমত্ব এবং সরকার বজায় রেখে গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের মতো বিভিন্ন বিষয়ে সহযোগিতা করে ।

14 অক্টোবর কানাডা এবং ভারতের মধ্যে সেই সহযোগিতার সম্পর্ক নিম্নমুখী হতে শুরু করে ৷ তার কারণ হল কানাডার আনা অভিযোগ ৷ কানাডা দাবি করে, সে দেশে বসবাসকারী শিখদের হুমকি দেওয়ার জন্য ও খতম করার জন্য গুপ্তচরদের একটি নেটওয়ার্ক ব্যবহার করছে ভারত । এই অভিযোগের পর কানাডা ঘোষণা করে যে, সে দেশে ভারতের রাষ্ট্রদূত হাইকমিশনার সঞ্জয় কুমার ভার্মা-সহ ছয় ভারতীয় কূটনীতিককে তারা বহিষ্কার করছে । কূটনৈতিক এধরনের দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে যেটা প্রায়শই হয়, সেইমতোই ভারত অবিলম্বে নয়াদিল্লিতে কানাডিয়ান দূতাবাস থেকে ছয়জন সিনিয়র কূটনৈতিককে বহিষ্কার করে ।

ETV BHARAT
নরেন্দ্র মোদি ও জাস্টিন ট্রুডো (ছবি: পিটিআই)

কী হয়েছিল ? দীর্ঘ গল্পটি শুরু হয়েছিল 2023 সালের জুন মাসে ৷ কানাডিয়ান নাগরিক 45 বছরের হরদীপ সিং নিজ্জরকে পশ্চিম কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল । শিখদের জন্য স্বাধীন আবাসভূমি তৈরির পক্ষে সওয়াল করা খালিস্তানপন্থী গোষ্ঠীর নেতা ছিলেন নিজ্জর ৷

এই ঘটনার তিন মাস পর, 18 সেপ্টেম্বর কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এমন একটি কাজ করেন, যা ছিল কল্পনার অতীত এবং সম্পূর্ণরূপে অকূটনৈতিক । তিনি ওটাওয়াতে কানাডার সংসদে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন যে, 'বিশ্বাসযোগ্য কিছু অভিযোগ খতিয়ে দেখছে' তাঁর সরকার ৷ ভারতীয় সরকারি এজেন্টরা নিজ্জরকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিলেন বলে অভিযোগ এসেছে বলে জানান ট্রুডো । যদিও মোদি সরকার এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে ।

চলতি সপ্তাহে যা ঘটেছে তা ভারত ও কানাডার মধ্যে কূটনৈতিক দ্বন্দ্বের ধারাবাহিক প্রবাহ । ট্রুডো জোর দিয়ে বলেন যে, ভারত কানাডার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ অব্যাহত রেখেছে: "কানাডার মাটিতে কানাডিয়ান নাগরিকদের হুমকি দেওয়া ও হত্যা করায় বিদেশি সরকারের জড়িত থাকার বিষয়টি আমরা কখনওই সহ্য করব না ।"

ETV BHARAT
কানাডার হাই কমিশন (ছবি: পিটিআই)

তিনি বলেন যে, তাঁর সরকার মার্কিন এফবিআই দ্বারা সমর্থিত প্রমাণ সংগ্রহ করেছে যে, খালিস্তানপন্থী শিখদের হুমকি, হয়রানি এবং আক্রমণ করার জন্য ভারতীয় কূটনীতিকরা একটি সংগঠিত অপরাধ চক্র পরিচালনা করছেন । "ভারত একটি বড় ভুল করেছে।" ট্রুডোর অভিযোগ ঠিক কী, তা বোঝার জন্য এই কথাটাই যথেষ্ট ৷

ট্রুডো ভারতের ইতিহাসের প্রশংসা করেননি: শিখরা ভারতের জনসংখ্যার একটি সম্মানিত এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল ৷ পঞ্চদশ শতকে গুরু নানক দেবজি পঞ্জাবে শিখ ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ।

শিখরা সামরিক পরিষেবা, রাজনীতি, কৃষি, শিল্প এবং খেলাধুলো-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারতের উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছেন । শিখ জনগণ এবং ভারতের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই ।

প্রায় 80 বছর আগে, শিখদের একাংশ যখন দেখে যে, ভারত অবশেষে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জন করতে চলেছে এবং সম্ভবত ধর্মীয় ভিত্তিতে বিভক্ত হতে চলেছে, তখন থেকেই তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রচার শুরু করে । তাঁদের প্রশ্ন ছিল, শিখ সংখ্যালঘুরা হিন্দু বা মুসলিম নয়, তাহলে কেন শুধু শিখদের জন্য খালিস্তান নামে আলাদা রাষ্ট্র হবে না ?

1947 সালে উদ্বেগ আরও বেড়ে যায় যখন ব্রিটিশরা কুখ্যাত র‌্যাডক্লিফ লাইন (ব্রিটিশ আইনজীবী সিরিল র‌্যাডক্লিফের নামানুসারে) ব্যবহার করে পূর্বের পঞ্জাব অঞ্চলকে পূর্ব পঞ্জাবে বিভক্ত করে, যা ভারতের অংশ হয়ে ওঠে, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা ছিল শিখ এবং হিন্দু ৷ আর পশ্চিম পঞ্জাব হয়ে ওঠে পাকিস্তানের অংশ, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল মুসলিম ।

খালিস্তান আন্দোলন এই বিভাজনগুলোকে কাজে লাগায় এবং 1980-এর দশকে জঙ্গি রূপ নেয় । শিখ জঙ্গিবাদের নেতা জার্নাইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে শিখদের একটি পবিত্র ধর্মীয় স্থান অমৃতসরের স্বর্ণ মন্দিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন ।

1984 সালের জুন মাসে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি অপারেশন ব্লু স্টারের নির্দেশ দেন ৷ স্বর্ণ মন্দির থেকে জঙ্গিদের তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য এটি একটি সামরিক পদক্ষেপ ছিল, যার ফলে মন্দিরের অনেকটাই ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং জঙ্গি ও সাধারণ মানুষ-সহ অনেকেই হতাহত হন ৷

প্রতিশোধ হিসেবে শিখ দেহরক্ষীরা ইন্দিরা গান্ধিকে 1984 সালের 31 অক্টোবর হত্যা করেন ৷ এই ঘটনা দিল্লিতে শিখ বিরোধী দাঙ্গার পথ প্রশস্ত করেছিল ৷ এগুলি ছিল ভারতীয় ইতিহাসের কিছু গুরুতর মুহূর্ত ।

ETV BHARAT
অমৃতসরের একটি বাজারের ছবি (ছবি: এপি)

বাকি জঙ্গিদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ করতে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর 10 বছর লেগেছে । প্রতিরোধের অবশিষ্টাংশ কিছু শিখ পরিবার সংখ্যালঘু হয়ে পড়ায় ভারত ছেড়ে বিদেশে বসতি স্থাপন করেছিল, প্রধানত অর্থনৈতিক অভিবাসী হিসাবে । ভারত ও পাকিস্তান ছাড়া সবচেয়ে বেশি শিখ জনসংখ্যা রয়েছে কানাডায় ৷ শিখ জনসংখ্যার প্রায় 2 শতাংশ (770,00 পরিবার) সেখানে রয়েছে ।

ট্রুডো অবিবেচকের মতো কাজ করেছেন । 1990 এর দশক থেকে প্রায় নিভে আসা আগুনে তেল ঢেলে ভারতের সংবেদশনশীল অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অগ্নিশিখা জ্বালিয়ে দিয়েছেন তিনি । তাঁর দেশে ভারত-বিরোধী চক্রান্তকে দমন না-করে ট্রুডোই ভারতীয় জনগণের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছেন ৷

ন্যাচারালাইজেশন একটি কাগজের নথি হিসাবে জন্মানো দেশের প্রতি ভালোবাসা এবং দেশপ্রেমকে অস্বীকার করে না । এটি এমন একটি আইনি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি বিদেশের নাগরিকত্ব অর্জন করেন ।

বছরের পর বছর ধরে, কানাডা বিশ্বব্যাপী দেশগুলিতে অভিবাসনের জন্য উন্মুক্ত হাত প্রসারিত করেছে । এর ক্র্যাডল-টু-গ্রেভ বেনিফিট সিস্টেমের সঙ্গে, কানাডা চায় তরুণরা সেখানে গিয়ে কাজ করে দেশের উচ্চ-আয়কর প্রদান করুক, যাতে তা দিয়ে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা এবং পেনশনের মতো অসাধারণ সুবিধাগুলি কানাডার নাগরিকদের মধ্যে বিতরণ করা যায় ।

একবার একজন অভিবাসী স্থায়ী বাসিন্দা কার্ড পেলে, তিনি প্রায় তিন বছরের মধ্যে কানাডার নাগরিক হতে পারবেন । কানাডা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ, ভারতের আয়তনের প্রায় তিনগুণ । তবুও এর জনসংখ্যা প্রায় 40 মিলিয়ন, দিল্লি-জাতীয় রাজধানী অঞ্চলের জনসংখ্যার থেকেও কম ।

ন্যাচারালাইজেশন উভয় দেশের চাহিদাই পূরণ করে - কানাডার প্রয়োজন নতুন কর্মী এবং ভারতীয়দের প্রয়োজন বিদেশে পড়াশোনা, কাজ, বসবাস এবং অভিবাসনের সুযোগ । দু'পক্ষের জন্যই ন্যাচারালাইজেশন প্রয়োজনীয় ৷

কানাডার নাগরিকত্ব গ্রহণ করা নাগরিকরা তাঁদের জন্মদাত্রী দেশের জন্য তাঁদের ভালোবাসা এবং দেশপ্রেম ছাড়তে পারেন না, তবে এটা মেনে নিতে পারেন না ট্রুডো ৷ বেশিরভাগ ন্যাচারালাইজড কানাডিয়ান মূলত দ্বৈত নাগরিক, জন্মদাত্রী দেশের প্রতি তাঁদের দৃঢ় আনুগত্য রয়েছে ।

কানাডার ভারতীয় (ইন্দো-কানাডিয়ান) জনসংখ্যা হল প্রায় 1.86 মিলিয়ন মানুষ, যা সে দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় 5 শতাংশ । ট্রুডোর পদক্ষেপ এবং ভারতের বিরুদ্ধে গভীরভাবে নেতিবাচক বক্তব্য ইন্দো-কানাডিয়ানদের তাঁদের গৃহীত দেশে অস্বস্তিকর করে তুলছে ।

এটি একটি শিশুকে তার পিতা ও মাতার মধ্যে একজনকে বেছে নিতে বাধ্য করার মতো - এবং এটি একটি জি 7 নেতার মর্যাদার জন্য পরিপন্থী ৷ এমনকি ট্রুডোর অভিযোগ সত্যি হলেও (একটি বড় যদি রয়েছে), ভারতের পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে গ্রহণযোগ্য । আন্তর্জাতিক আইনে এমন যথেষ্ট নজির রয়েছে যেখানে, নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি হতে পারে এমন কোনও কিছুকে বিদেশে নির্মূল করেছে বিভিন্ন দেশ ৷

উদাহরণস্বরূপ, ইজরায়েল 60 বছরেরও বেশি সময় ধরে মোসাদের হিট স্কোয়াড নিয়োগ করে চলেছে বিদেশে তার শত্রুদের অনুসরণ করার জন্য, যে শত্রুরা ইহুদি এবং ইজরায়েল রাষ্ট্রকে আঘাত করার চেষ্টায় রয়েছে । স্টিভেন স্পিলবার্গ প্রযোজিত এবং পরিচালিত 2005 সালের মহাকাব্যিক চলচ্চিত্র মিউনিখে তুলে ধরা হয়েছে একটি সত্য ঘটনা ৷ 1972 সালে মিউনিখ অলিম্পিকে সন্ত্রাসী হামলায় ইজরায়েলি ক্রীড়াবিদকে হত্যার প্রতিশোধ নিতে ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ার কীভাবে ইজরায়েলি এজেন্টদের মুক্তি দিয়েছিলেন, সেকথা তুলে ধরা হয়েছিল সেই মুভিতে ৷

ইজরায়েলি পদক্ষেপ একটি ভিন্ন দেশের (প্যালেস্তাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন) নাগরিকদের বিরুদ্ধে ছিল । ভারতের ক্রিয়াকলাপ কানাডিয়ানদের বিরুদ্ধে ছিল, এটা সত্যি, তবে তাঁদের বিরুদ্ধেও ছিল যাঁরা ভারতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যাঁরা বেশিরভাগ জীবন ভারতে কাটিয়েছেন এবং যাঁরা কিছুদিন আগে পর্যন্তও ভারতীয় ছিলেন । কানাডা থেকে ন্যাচারালাইজেশন পেপারের একটি টুকরো এই অপরাধীদের তাঁদের জন্মের দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার অধিকার দেয় না, কারণ কানাডা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেনি ।

ন্যাচারাইলেশনের দ্বন্দ্ব - এবং আনুগত্যের পরীক্ষা - শুধুমাত্র বিরল পরিস্থিতিতে ঘটে, যেমন যখন একটি দত্তক দেশ এবং জন্মের দেশ একে-অপরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত থাকে । এছাড়াও, পারস্পরিক সম্পর্ক হিসাবে, কানাডা কি ভারতকে সেই জঙ্গিদের আশ্রয় দেওয়ার অনুমতি দেবে, যারা কানাডার ক্ষতি করতে পারে ?

ট্রুডোর অবিলম্বে নিজের বক্তব্য থেকে পিছিয়ে যাওয়া উচিত এবং জনসমক্ষে এই কুৎসিত প্রচার করা থেকে বিরত থেকে প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে কাজ করা উচিত । বিবিসির কথা অনুযায়ী, কানাডার প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রিয়তা তলানিতে এসে ঠেকেছে ৷

এক পোল ট্র্যাকারের দেওয়া তথ্য অনুসারে, প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তাঁর নবম বছরে ট্রুডোর অ্যাপ্রুভাল রেট কমে চলতি বছরের জুনে হয়েছে 28 শতাংশ ৷ প্রথম নির্বাচিত হওয়ার সময় যা ছিল 63 শতাংশ ৷ ঘরোয়া রাজনীতিতে সাহায্য করার জন্য ট্রুডোর কূটনৈতিক এই খেলা করার সময় এটা নয় । অনেক শিখ ট্রুডোর সরকারে কাজ করেন ।

ভারতীয় করদাতারা ইতিমধ্যেই সাউথ ব্লকে, যেখানে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক রয়েছে, সেখানে বিশাল দফতরের জায়গার জন্য অর্থ প্রদান করেছেন ৷ সেই কনফারেন্স রুমে গোপনীয়তার সঙ্গে এই দ্বন্দ্বের অবশ্যই দ্রুত সমাধান করা উচিত ।

ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.