হায়দরাবাদ, 5 জুন: ভারতীয় জনতা পার্টি তাদের দাবি অনুযায়ী 400টি আসন জিততে পারেনি ৷ তবু দিল্লিতে সরকার গঠন করবে বিজেপি ৷ গত 10 বছরে দেশ যা দেখেছে, এটা তার থেকে একেবারেই বিপরীত ৷ মঙ্গলবার শেষ হওয়া এই চমকপ্রদ নির্বাচনী প্রতিযোগিতার পরে যে এনডিএ সরকার গঠিত হবে, তা অনেক দিক থেকে আলাদা হতে চলেছে ৷ প্রথমত, এটি ভারতীয় জনতা পার্টির একটি জোট সরকার হবে ৷ নিজেদের ক্ষমতায় সরকার গঠনের থেকে প্রায় 42টি আসন কম পেয়েছে বিজেপি ৷ দ্বিতীয়ত, সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের জন্য নীতীশ কুমার, চন্দ্রবাবু নাইডু এবং জয়ন্ত চৌধুরির মতো তিনটি দলের উপর খুব বেশি নির্ভর করতে হবে তাদের ৷
বিজেপি এই সংসদীয় নির্বাচনে 400টি আসন জয়ের স্বপ্ন দেখছিল ৷ কিন্তু, এমন সময়ে চরম হতাশার পরিস্থিতি বিজেপি কীভাবে পৌঁছল ? নির্বাচন ও গণতন্ত্রে যেখানে প্রয়োজন ছিল জনগণের কাছে তাদের কাজের জবাবদিহি করা, সেখানে বিজেপির সরকার ভবিষ্যতের উত্তরণের জন্য ব্যবহার করেছে ক্ষমতাকে ৷ আর সেই নজরে দেখতে গিয়ে 2024 সালের লোকসভা নির্বাচন বিজেপির জন্য একটি বড় ধাক্কা ৷ অন্যদিকে, কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন 'ইন্ডিয়া' জোট যেখানে শক্তিশালী প্রার্থী দিয়েছে, সেখানে বিজেপি প্রার্থী বাছাইয়ে তেমন গুরুত্ব দেয়নি ৷ আর সেই সব আসনে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে ৷
উত্তরপ্রদেশ বিজেপির জন্য সবচেয়ে বড় ধাক্কা এই নির্বাচনের ফলাফলে ৷ বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাজকীয় প্রচার চালিয়েছিলেন ৷ তাঁর এমন একটা ভাব ছিল যে, এখানে তিনি ছাড়া আর কেউ নেই নির্বাচনে লড়াই করার মতো ৷ দলের অন্যান্য প্রার্থীদের নাম ও পরিচয়ে কিছু যায় আসে না ৷ এই মনোভাব ভোটাররা কোনও ভাবেই গ্রহণ করেনি ৷ ভোটাররা প্রত্যেক প্রার্থীকে তাঁদের কাজ-পরিচয় ও অতীত দেখে তারপর ভোট দিয়েছে ৷ বিজেপি অনেক সাংসদকে এবার টিকিট দেয়নি ৷ কিন্তু, তাতে কোনও লাভ হয়নি ৷ নবনির্বাচিত এই প্রার্থীদের মধ্যে কয়েকজনকে বহিরাগত ছিলেন এবং প্রত্যাশিতভাবে তারা পরাজিত হয়েছেন ৷ উত্তরপ্রদেশ বিজেপির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল ৷ কারণ এখানে ধর্মীয় বিরোধকে হাতিয়ার করে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছিল ৷
এবছর 22 জানুয়ারি নরেন্দ্র মোদি রাম মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ৷ এই তারিখটা বেছে নেওয়া হয়েছিল, কারণ রাম মন্দিরের প্রাণ প্রতিষ্ঠাকে হাতিয়ার করে লোকসভা নির্বাচনে জিতে, ফের ক্ষমতায় আসতে চেয়েছিল বিজেপি ৷ যেখানে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ এবং অন্যান্য সাধু সন্তদের উপস্থিতিতে রাম মন্দিরের উদ্বোধন, সেই উদ্দেশ্যকে সফল করতে একটা চেষ্টা ছিল ৷ প্রচারের প্রথম দিকে বিজেপি এই সরকারের সাফল্য হিসাবে রাম মন্দির নির্মাণকে তুলে ধরে ছিল ৷ কিন্তু, সেই চেষ্টা সফল হয়নি ৷ মানুষকে তা আকর্ষণ করতে পারেনি ৷
বিজেপি নেতৃত্বকে বিভ্রান্ত করতে সমাজবাদী পার্টির অখিলেশ যাদব যুবসমাজকে ব্যবহার করেছেন ৷ এমনকী এক্সিট পোল বিজেপিকে একদিনের স্বস্তি দিলেও, দেওয়াল লিখন আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল ৷ এই ফলাফল অবশ্য শাসকদলের এক নেতা আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন ৷ তিনি বলেছিলেন, "বিজেপি 40টির মতো আসন কম পাবে ৷" আর সেটা করেছিলেন এপ্রিল মাসের শুরুর দিকে ৷ কিন্তু, শাসকদলের তরফে কেউ তখন সেই ভবিষ্যদ্বাণীকে গ্রাহ্য করেনি ৷
এমন অনেক প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল, যেখানে দেখা গিয়েছে বিজেপি উত্তরপ্রদেশে তাদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে ৷ ওই নেতা বারাণসী অর্থাৎ, প্রধানমন্ত্রীর কেন্দ্রের মানুষের মধ্যে তিক্ততার আভাস পেয়েছিলেন ৷ যাদের বিজেপির সমর্থক বলে মনে করা হচ্ছিল, তারাই প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে বিরক্ত ছিলেন ৷ এটা স্পষ্ট ছিল যে, প্রধানমন্ত্রীর প্রতি যে সম্মান বা ভীতি যাই ছিল, তা ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছিল ৷ মনে করা হয়েছিল, যেহেতু মোদি নিজে বারাণসী থেকে লড়াই করছিলেন, সেহেতু পূর্ব উত্তরপ্রদেশে অন্তত 13টি আসন বিজেপি পাবে ৷ কিন্তু, বিজেপির সেই আসা পুরোপুরি ভেঙে গিয়েছে ৷
রায়বরেলি ও আমেঠিতে রাহুল গান্ধি এবং প্রিয়াঙ্কা গান্ধি খুব ভালো প্রচার করেছেন ৷ আর সেখানে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে স্মৃতি ইরানির ৷ যিনি 2019 সালে রাহুল গান্ধিকে আমেঠি থেকে হারানোর পর, এবার কংগ্রেসের কিশোরী লাল শর্মার কাছে পরাজিত হয়েছেন ৷ এমনকী রাহুল গান্ধি নিজে রায়বরেলি থেকে বিপুল ব্যবধানে জয়লাভ করেছেন ৷ সেখানে নরেন্দ্র মোদি বারাণসী থেকে জয়ী হলেও, তাঁর জয়ের ব্যবধান এক লক্ষ ভোটের বেশি কমেছে ৷ ভোটের হারও প্রায় 11 শতাংশ কমেছে মোদির ৷
বিজেপি রাজস্থানে বেশ কয়েকটি আসন খুইয়েছে ৷ তবে, নির্বাচনী বিশেষজ্ঞদের ভবিষ্যদ্বাণী উত্তর ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে সঠিক প্রমাণিত হয়েছে ৷ তার মধ্যে দিল্লি ও মধ্যপ্রদেশ অন্যতম ৷ গুজরাতে বিরোধী শিবির মাত্র 2টি আসন পেয়েছে 27টির মধ্যে ৷ আবার ওড়িশা ও অন্ধ্রপ্রদেশে এনডিএ জোট দারুণ ফলাফল করেছে ৷ বিজেপি যে 240টি আসন এককভাবে পেয়েছে, এর পিছনে অন্যতম কারণ ওড়িশা ৷ সেখানে বিজেপি প্রথমবার ওড়িশায় সরকার গঠন করতে চলেছে ৷ তবে, দিল্লিতে আম আদমি পার্টি একেবারেই ব্যর্থ ৷ সেখানে তাদের রাজ্য সরকারে আপ থাকা সত্ত্বেও অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দল মাথা তুলতে পারেনি ৷
এই মুহূর্তে 'ইন্ডিয়া' জোটও তাদের সরকার গঠনের চেষ্টায় রয়েছে ৷ কিন্তু, এটা তাদের কাছে নিজেদের জোটকে টিকিয়ে রাখার লড়াইও ৷ আমরা আগামী দিনে যা দেখতে চলেছি তা হল, ভুয়ো স্থায়িত্বের বিসর্জন ৷ ধর্মনিরপেক্ষতা পথে এই সরকার চলতে শুরু করবে ৷ এখানে দেশের বিভিন্ন সংস্থা যেমন, বিচারব্যবস্থা ও সংবাদ মাধ্যমে, যেগুলিকে প্রতিনিয়ত দখলে রাখা হয়েছিল তারা ফের নিজেদের স্বমহিমায় ফিরে আসবে ৷ ভারতবর্ষ আগামী দিনে খুবই আকর্ষণীয় রাজনৈতিক লড়াইয়ের সাক্ষী হতে চলেছে ৷