কানাডার আধিকারিকরা সাম্প্রতিক সময়ে যে বিবৃতি দিয়েছেন, তা একত্রিত করলে দেখা যাচ্ছে যে তাঁরা সকলেই কানাডায় খালিস্তানি সমর্থক বলে পরিচিত হরদীপ সিং নিজ্জরের হত্যাকাণ্ডে ভারতকে অভিযুক্ত করেছে ৷ কিন্তু সেখানে তদন্ত সংক্রান্ত কোনও বিস্তারিত তথ্য ছিল না ৷ বরং পুরো বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়ার প্রচেষ্টা বেশি করে দেখা যাচ্ছে ৷ কানাডিয়ান সরকারের মিথ্যে যুক্তির বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়েছে যখন সেদেশের নাগরিকরাই এই বিবৃতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ৷ কারণ, তাদের যুক্তিগুলি অনেকাংশে পরস্পরবিরোধী ছিল ৷ 'ট্রুডোকে বাঁচান'-এর প্রচার করাই এর একমাত্র উদ্দেশ্য বলে মনে হয়েছে ৷
কানাডিয়ানরা সোশাল মিডিয়ায় নিজের দেশের সরকারের বিরুদ্ধে যে সব মন্তব্য করেছেন, সেগুলি ভারতের চেয়েও বেশি সমালোচনামূলক ছিল । ইন্দো-কানাডিয়ান সম্পর্কের অবনতির সূচনা নিজ্জরের মৃত্যুতে হয়নি ৷ বরং 2018 সালের ফেব্রুয়ারিতে ট্রুডো পরিবারের সাত দিনের বিপর্যয়কর ভারত সফর থেকে শুরু হয়েছিল । প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ষষ্ঠ দিনে জাস্টিন ট্রুডোর সঙ্গে দেখা করেন ৷ সেটাও আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকার ছিল ৷ ফলে সেই সফরের ফলাফল কিছুই ছিল না ৷ শুধু পারিবারিক ছবি তোলার মাধ্যমেই তা শেষ হয়েছিল ৷ এই বিষয়টি ট্রুডোর আত্মসম্মানে আঘাত করেছিল ৷ কারণ, নিস্ফলা সফরে অযৌক্তিক ব্যয়ের জন্য অভ্যন্তরীণ সমালোচনার সম্মুখীন হন তিনি ৷ এমনকি, শিখ সম্প্রদায়কে আকৃষ্ট করার জন্য তাঁর প্রচেষ্টাও বিপর্যস্ত হয়েছিল ।
ট্রুডোর জন্য আরও খারাপ দুঃস্বপ্ন ছিল 2023 সালের সেপ্টেম্বরে জি-20 শীর্ষ সম্মেলনের সময়ের ভারত সফর । তিনিই সম্ভবত একমাত্র বিশ্বনেতা, যাঁর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মোদির কোনও আনুষ্ঠানিক দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয়নি । খালিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করার জন্যও তাঁকে জবাব দেওয়া হয়েছিল । তিনি যে শীর্ষ সম্মেলনে অন্যদের মতোই একজন হিসেবে উপস্থিত হয়েছেন, সেই বিষয়ে সচেতন ছিলেন ট্রুডো ৷ তাই তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতির দেওয়া আনুষ্ঠানিক নৈশভোজ এড়িয়ে যান ৷ পরিবর্তে, তাঁর ছেলেকে নিয়ে একটি রেস্তরাঁয় খেতে যান ।
সেই কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিয়েছিল কানাডিয়ান প্রধানমন্ত্রীর বিমানের যান্ত্রিক ত্রুটি ৷ এর জেরে তিনি দিল্লিতে অতিরিক্ত একদিন কাটাতে বাধ্য হন ৷ এই ঘটনার জেরে তিনি বিশ্বব্যাপী হাসির পাত্র হয়ে ওঠেন ৷ দিল্লি থেকে ফেরার সময় তাঁকে তাঁর ব্যর্থ সফর ও জি20-তে শূন্য অবদানের বিষয়ে প্রশ্ন করা হয় ৷ এমনকী, বিমানের যান্ত্রিক ত্রুটি নিয়েও তাঁকে উপহাসের মুখে পড়তে হয় ৷ সেই সময়ই ট্রুডো কি প্রথমবারের মতো নিজ্জর হত্যায় ভারতীয় কারও জড়িত থাকার কথা উল্লেখ করেছিলেন ?
এই বক্তব্যের জেরে তাঁর বিব্রতকর সফর থেকে জাতীয় মনোযোগ সরে যায় । বক্তব্যের সর্বশেষ অংশও এমন একটি সময়ে এসেছে, যখন তিনি একই রকম বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হন । ট্রুডো দাবি করেছেন যে 11 অক্টোবর লাওসের ভিয়েনতিয়েনে আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলনে তাঁর এবং প্রধানমন্ত্রী মোদির মধ্যে একটি 'সংক্ষিপ্ত মত বিনিময়' হয়েছিল । তিনি উল্লেখ করেন, "আমি জোর দিয়েছিলাম যে এমন কিছু কাজ আছে, যা আমাদের করতে হবে । কানাডিয়ানদের নিরাপত্তা এবং আইনের শাসন বজায় রাখা যেকোনও কানাডিয়ান সরকারের মৌলিক দায়িত্বগুলির মধ্যে একটি এবং এটাতেই আমি মনোযোগ দেব ।"
ভারতীয় মুখপাত্র জাস্টিন ট্রুডোর মন্তব্যকে উড়িয়ে দিয়েছেন ৷ তিনি উল্লেখ করেন, "ভিয়েনতিয়েনে প্রধানমন্ত্রী (মোদি) এবং প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর মধ্যে কোনও ফলপ্রসূ আলোচনা হয়নি । ভারত আশা করে যে কানাডার মাটিতে ভারতবিরোধী খালিস্তানি কার্যকলাপ হতে দেওয়া হবে না এবং সেই সংস্থা যাঁরা কানাডার ভূখণ্ড থেকে ভারতের বিরুদ্ধে হিংসা, চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের পক্ষে কথা বলছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে ।"
এমনকি সাম্প্রতিক ঘোষণাগুলোতেও মতানৈক্য ছিল । কানাডা দাবি করেছে যে তারা ভারতীয় কূটনীতিকদের বহিষ্কার করেছে ৷ অন্যদিকে ভারত উল্লেখ করেছে যে কানাডা যখন তদন্তে 'আগ্রহী ব্যক্তি' বলে ঘোষণা করেছে, তখন ভারত তাঁদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে । কানাডা দাবি করেছে যে তারা ভারতের জড়িত থাকার প্রমাণ জমা দিয়েছে ৷ কিন্তু ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে বলেছে কোনও প্রমাণ শেয়ার করা হয়নি ।
কানাডার বিদেশমন্ত্রী মেলানি জোলি উল্লেখ করেছেন যে ভারত 'কানাডিয়ান নাগরিকদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করার অভিযানে' জড়িত । আরসিএমপি তদন্তের নেতৃত্বে থাকা প্রধান বলেছেন যে ভারত "বিষ্ণোই গ্যাংকে নিয়োগ করে খালিস্তান কর্মীদের" আক্রমণের নিশানা করছে ৷ মজার বিষয় হল, 2022 সালে ভারত কানাডাকে বিষ্ণোই গ্যাংয়ের সদস্যদের প্রত্যর্পণের জন্য অনুরোধ করেছিল । তখন কানাডা তা প্রত্যাখ্যান করে । আজ, এই একই গ্যাংয়ের সঙ্গে কানাডা ভারতীয় কূটনীতিকদের যুক্ত থাকার কথা বলছে । অদৃষ্টের কী পরিহাস ! তবে সামগ্রিক উদ্দেশ্য হল কানাডার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতীয় হস্তক্ষেপকে হাইলাইট করা বলে মনে হচ্ছে ।
ভারত সরকারের বিবৃতিতেও একই বিষয়কে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা বিদেশমন্ত্রকের বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, "কানাডার রাজনীতিতে বিদেশি হস্তক্ষেপের প্রতি অন্ধ হয়ে যাওয়ার জন্য সমালোচনার মধ্যে ক্ষতি কমানোর জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে ভারত টেনে নিয়ে এসেছে তাদের সরকার ।" এর সঙ্গে যোগ করা হয়েছে যে ট্রুডো "বিদেশি হস্তক্ষেপ সংক্রান্ত কমিশনের সামনে জবানবন্দি দেওয়ার ঠিক আগে" এই মন্তব্য করেছিলেন ।
কয়েকদিন আগে সিএসআইএস ডিরেক্টর ভেনেসা লয়েড বিদেশি হস্তক্ষেপের তদন্তে সাক্ষ্য দিয়ে উল্লেখ করেছেন যে "পাকিস্তান খালিস্তানি চরমপন্থাকে সমর্থন করার লক্ষ্যে কানাডায় গোয়েন্দা অভিযান এবং আন্তর্জাতিক দমন-পীড়ন পরিচালনা করে ।" সেখানে ভারতের কথা বলা হয়নি । তাঁর বিবৃতিটি বোঝায় যে কানাডা সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে খালিস্তানের প্রচারে কাজ করছে । এটা কি কানাডাকে সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষক করে তুলছে ?
একই সঙ্গে ট্রুডো চিনের কথা উল্লেখ করবেন না ৷ অথচ চিনা কানাডিয়ানদের ভয় দেখানোর জন্য কানাডার বিভিন্ন স্থানে চিন পুলিশ স্টেশন তৈরি করে রেখেছে ৷ কানাডায় চিনা হস্তক্ষেপের বিশ্বাসযোগ্য তথ্য আগের তদন্তগুলি থেকেই সামনে এসেছে ৷ এর ফলে বেজিংয়ের সঙ্গে ট্রুডোর লিবারেল পার্টির ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে প্রকাশ্যে চলে আসেছে ।
ট্রুডোর সরকার বর্তমানে সংসদে সংখ্যালঘু । খালিস্তান সমর্থক জগমিত সিংয়ের নেতৃত্বাধীন এনডিপি (নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি) সমর্থন প্রত্যাহার করেছে । কুইবেকের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপ-নির্বাচনে সাম্প্রতিক পরাজয়ের ফলে লিবারেল পার্টির 20 জনেরও বেশি এমপি তাঁর পদত্যাগ দাবি করেছেন । ট্রুডো বিরোধী এমপির সংখ্যা বাড়ছে । ট্রুডো লাওসে থাকাকালীন তাঁর পদত্যাগের দাবি উঠতে শুরু করে ৷ সেই সময়ই তিনি দাবি করেন যে প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে ।
লাওস থেকে ফেরার পরপরই ভারত ও কানাডার মধ্যে কূটনীতিকদের বহিষ্কারের পর অভিযোগ পালটা অভিযোগ শুরু হয় ৷ তাঁর পদত্যাগের দাবি থেকে আবারও দেশের মনোযোগ ভারতের আঘাতের দিকে সরিয়ে নেওয়াই উদ্দেশ্য ছিল । আগামী বছর কানাডায় নির্বাচন হওয়ার কথা । ট্রুডোর ব্যর্থ অর্থনৈতিক ও অভিবাসন নীতির ফলে তাঁর দল জমি হারিয়েছে । তাঁর দলের সংসদ সদস্যরা তাঁকে বের করে দেওয়ার আগে তিনি কতদিন টিকে থাকবেন, সেটাই দেখার বিষয় ? ট্রুডোও জানেন যে তিনি শিখ কানাডিয়ানদের কাছে জনপ্রিয় । সর্বোপরি, তিনি ভারতে কৃষকদের আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন এবং সেই সব শিখদের নাগরিকত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রেও উদার ছিলেন, যাঁরা জাল পাসপোর্ট নিয়ে কানাডায় আসার সময় নিপীড়নের দাবি করেছিলেন ।
জগমিত সিং তাঁর পাশ থেকে সরে যাওয়ার পর তিনি ভোট পাওয়ার আসায় ভারতের বিরুদ্ধে শিখ সম্প্রদায়ের একজন সদস্যকে টার্গেট করার এবং ভারতীয় কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কার্যকলাপের প্রতি সমর্থনের অভিযোগ করেছেন ৷ কানাডার এই অভিযোগে সম্ভবত শুধুমাত্র মার্কিন সমর্থন আছে । শুধুমাত্র মার্কিন মিডিয়াতেই ট্রুডোর অভিযোগকে শিরোনামে রাখা হয়েছিল । সমর্থনের একটি প্রধান কারণ হল ভারতের ক্রমবর্ধমান উত্থান এবং কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন। অন্যান্য দেশ ট্রুডোর প্রকৃত মূল্য জানে ।
ট্রুডো ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমারের সঙ্গে ভারত সংক্রান্ত বিতর্ক নিয়ে কথা বলেছেন । বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে দু’জন "ঘনিষ্ঠ ও নিয়মিত যোগাযোগে থাকতে সম্মত হয়েছেন ।" ভারতের বিষয়ে কোনও মন্তব্য করা হয়নি । নিউজিল্যান্ডের বিদেশমন্ত্রী উইনস্টন পিটার্স টুইট করেছেন যে কানাডা নিউজিল্যান্ডকে বিষয়টি জানিয়েছে । তিনি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে অভিযোগগুলি এখনও প্রমাণিত হয়নি । ট্রুডো ঝাঁপিয়ে পড়েছেন এবং যতবারই তাঁর ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, ততবারই ভারতকে আঘাত করে এগিয়ে চলেছেন । তিনি সমর্থন আদায়ে মরিয়া ।
প্রধানমন্ত্রী মোদি ট্রুডো সম্পর্কে কখনও মন্তব্য করেননি ৷ এই বিষয়টি তাঁর বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্রদের উপর ছেড়ে দিয়েছেন । তিনি প্রমাণ করেছেন যত চাপই আসুক না কেন, ভারত মাথা নত করবে না । মোদি জানেন যে ট্রুডো বেঁচে থাকার জন্য মরিয়া লড়াইয়ে জড়িত । তিনি জানেন অন্য দেশের এমন একজন প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে মুখ খোলা তাঁর জন্য সম্মানজনক হবে না ৷ যতদিন ট্রুডো ক্ষমতায় আছেন, ততদিন ভারতের পক্ষে কানাডার সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা সম্ভব নয় ৷ সেটাও বেশিদিনের জন্য নয় । ভারত সরকার জানে যে ট্রুডো সরে যাওয়ার পর ফের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা হবে ৷