নয়াদিল্লি, 2 অক্টোবর: ভারতের সঙ্গে মলদ্বীপের সম্পর্ক ভালো হচ্ছে ৷ তার প্রমাণ, মলদ্বীপ আশা করছে, 2025 সালে ভারত থেকে বিপুল আর্থিক সাহায্য পাবে তারা, যার পরিমাণ মলদ্বীপের মুদ্রা এমভিআর-এর হিসেবে 1.6 বিলিয়ন (প্রায় 104 মিলিয়ন ডলার বা 10.4 কোটি ডলার) ৷ ইতিমধ্যে এই বরাদ্দ দেশের বাজেটে পেশ করেছে মুইজ্জু সরকার ৷
গত বছর মহম্মদ মুইজ্জু প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরপরই মলদ্বীপের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ক্রমশ তিক্ত হতে শুরু করে ৷ সেদিন এখন অতীত ৷ 2025 সালে মিত্র দেশগুলির থেকে মলদ্বীপ সরকার 56.6 বিলিয়ন এমভিআর বৈদেশিক সাহায্য আশা করছে ৷ এই হিসেব ইতিমধ্যে জাতীয় সংসদে পেশ করা হয়েছে ৷ এর মধ্যে 2.5 বিলিয়ন এমভিআর বরাদ্দ করেছে একা ভারত ৷ এই অর্থের 72 শতাংশ সাহায্য মলদ্বীপকে দেবে মোদি সরকার ৷
মলদ্বীপের সংবাদমাধ্যমের ওয়েবসাইট Edition.mv-তে কোন দেশ কত অর্থ সাহায্য করবে, সেই সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে ৷ সেই রিপোর্ট অনুযায়ী, দ্বিতীয় বৃহত্তম সাহায্যকারী দেশ চিন ৷ মলদ্বীপ 502 মিলিয়ন এমভিআর অর্থ সাহায্য পাবে জিনপিংয়ের দেশ থেকে ৷ তৃতীয় স্থানে জাপান, 47 মিলিয়ন অর্থ সাহায্য করবে মলদ্বীপকে ৷ রিপোর্ট বলছে, "2025 সালে পাকিস্তান, ইতালি, সৌদি আরব এবং নেদারল্যান্ডসের কাছ থেকেও সাহায্য পেতে পারে মলদ্বীপ ৷"
গত বছরের নভেম্বরে মলদ্বীপের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মহম্মদ মুইজ্জু ৷ তারপর থেকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে ৷ বর্তমানে অবশ্য দক্ষিণ এশিয়ার এই দু'টি দেশের মধ্যে পরিস্থিতিটা বদলেছে, তার প্রমাণ ভারতের থেকে এই বিপুল অর্থ সাহায্য পাওয়ার আশা ৷ এদিকে ভারত-বিরোধী মনোভাবাপন্ন হওয়ার জন্যই গত বছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন মুইজ্জু ৷ প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তিনি সে দেশে থাকা ভারতীয় সেনাদের প্রত্যাহার করার কথাও জানান ৷ মলদ্বীপে মোতায়েন করা এই সেনাদের সংখ্যা একশোরও কম ৷ তাঁরা ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জে প্রাথমিকভাবে মানবিক সহযোগিতা, বিপর্যয় মোকাবিলা, উদ্ধারের মতো কাজকর্মে যুক্ত ছিলেন ৷ যদিও প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই মলদ্বীপ সরকারের থেকে ভারতের কাছে একটা সরকারি অনুরোধ আসে, ভারত যেন তাদের সেনাদের দেশে ফিরিয়ে নেয় ৷ এই সেনারা চলে আসার পর তাদের জায়গা নিয়েছে ভারতীয় নাগরিকরা ৷
প্রেসিডেন্ট মুইজ্জুর আমলে দেশের বিদেশনীতিতে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে ৷ প্রেসিডেন্ট হয়ে তিনি প্রথম তুরস্ক সফরে গিয়েছিলেন ৷ যেখানে তাঁর পূর্বসূরিরা প্রথমে ভারতে এসেছেন ৷ নিরাপত্তার কারণ দর্শিয়ে মুইজ্জু সরকার ভারতের সঙ্গে ইন্ডিয়ান হাইড্রোগ্রাফি চুক্তি পুনর্নবীকরণ করতে চায়নি ৷ উলটে চিনের জাহাজ ভিড়েছে মলদ্বীপের তীরে ৷ ভারত এর প্রতিবাদ করলেও তাতে কর্ণপাত করেনি মলদ্বীপ সরকার ৷ এরপর মলদ্বীপের রাজনৈতিক নেতারা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির খোলাখুলি সমালোচনা করেছেন ৷ স্বভাবত এর ফলে দু'দেশের মধ্যে সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে ৷
চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে মলদ্বীপের ভারত-বিরোধী মনোভাবে বদল দেখা যায় ৷ প্রেসিডেন্ট মহম্মদ মুইজ্জু ঘোষণা করেন, ভারতই তাদের সবচেয়ে কাছের মিত্র দেশ ৷ তিনি আশা করেন, দেনা মেটানোর ক্ষেত্রে ভারত মহাসাগরীয় এই দ্বীপপুঞ্জটিকে কিছুটা ছাড় দেবে ৷
একটি সংবামাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মুইজ্জু এও দাবি করেন যে, তিনি কখনও এমন কোনও পদক্ষেপ করেননি বা বিবৃতিও দেননি যাতে ভারত ও মলদ্বীপের মধ্যে সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে ৷ প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু বলেন, "এক দেশের সাহায্যকে খারিজ করা অথবা উপেক্ষা করাটা মোটেও ভালো দেখায় না ৷" তিনি এও আশা করেন যে, তাঁর পূর্বসূরিরা ভারতের কাছে বিপুল অর্থ দেনা করেছেন ৷ সেই ঋণের টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বস্তি দেবে ভারত ৷ সেই আবেদনে রাজি হয়েছে ভারত ৷
গত 9 জুন তৃতীয় বার ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ৷ সেই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে হাজির ছিলেন মুইজ্জু ৷ জুলাই মাসে ভারত সরকার 2024-25 অর্থবর্ষের বাজেট পেশ করে ৷ তাতে মলদ্বীপের উন্নয়ন খাতে আগের বছরের মতোই 400 কোটি টাকা বরাদ্দ করে তৃতীয় মোদি সরকার ৷
এরপর অগস্টে বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর মলদ্বীপ সফরে যান ৷ সেখানে ভারতীয় অর্থ সাহায্যে তৈরি বেশকিছু পরিকাঠামো প্রজেক্ট উদ্বোধন করেন তিনি ৷ পাশাপাশি আরও কয়েকটি নতুন প্রজেক্টের কথাও ঘোষণা করেন জয়শঙ্কর ৷
দু'মাস বাদে অক্টোবরে প্রথম দ্বিপাক্ষিক ভারত সফরে আসেন প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু ৷ নিরাপত্তা ক্ষেত্রে দু'দেশের মধ্যে সহযোগিতা এবং প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে একগুচ্ছ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে ভারত ও মলদ্বীপ ৷ এছাড়াও দু'পক্ষের তরফে একটি যুগ্ম নথি প্রকাশ করা হয়, 'আ ভিশন ফর কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক অ্যান্ড মেরিটাইম সিকিউরিটি পার্টনারশিপ' ৷
এই যুগ্ম নথিতে বলা হয়েছে, "দু'দেশের মধ্যে সর্বাত্মক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে সর্বাঙ্গীণ অর্থনীতি ও জলসীমায় নিরাপত্তা অংশীদারিতে রূপান্তরিত করার ক্ষেত্রে দু'দেশের কাছেই এটা একটা ভালো সুযোগ ও সময় ৷ এই সম্পর্ক মানুষ কেন্দ্রিক, ভবিষ্যতের কথা ভেবে এবং ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে একটা স্থিরতা আনতে কাজে লাগবে ৷"
এখন মলদ্বীপ আশা করছে ভারত তাদের অর্থসাহায্য করবে ৷ কারণ, ইতিমধ্যে তাদের অর্থনৈতিক দুরবস্থায় আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ভারত ৷ চলতি সেপ্টেম্বরে মলদ্বীপের থেকে বকেয়া 50 মিলিয়ন ডলার (5 কোটি ডলার) মকুব করতে রাজি হয়েছে ভারত সরকার ৷ এর পাশাপাশি 400 মিলিয়ন ডলার এবং 30 বিলিয়ন ডলার অর্থের মুদ্রা বিনিময় নিয়ে চুক্তি করেছে দু'দেশ ৷
এই প্রসঙ্গে মনোহর পারিক্কর ইনস্টিটিউট অফ ডিফেন্স স্টাডিজ-এর অ্যাসোসিয়েট ফেলো আনন্দ কুমার ইটিভি ভারতকে বলেন, "মুইজ্জু তাঁর দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অনুযায়ী নীতিগুলিকে পরিবর্তন করছেন ৷" আনন্দ কুমার 'মাল্টি-পার্টি ডেমোক্রেসি ইন দ্য মালদিভস অ্যান্ড দ্য ইমার্জিং এনভায়রনমেন্ট ইন দ্য ইন্ডিয়ান ওসেন রিজিয়ন' নামের বইয়ের লেখক ৷
তিনি বলেন, "ভারত মলদ্বীপকে তার অর্থনৈতিক দুর্দশা থেকে বের করে আনতে যা যা সম্ভব সে সবই করছে ৷ আমাদের নেবারহুড ফার্স্ট পলিসি-র অধীনে আমরা তাদের সাহায্য করার চেষ্টা করে চলেছি ৷"
এই নীতির উদ্দেশ্য হল- এলাকায় দ্বন্দ্ব মিটিয়ে শান্তি ও স্থিরতা নিশ্চিত করা, অর্থনৈতিক সহযোগিতার প্রচার, দু'দেশের পারস্পরিক উন্নয়নের জন্য প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে মিলেমিশে চলা ৷ সড়ক, রেলওয়ে এবং বন্দরগুলির মতো পরিকাঠামো প্রজেক্টগুলির মাধ্যমে যোগাযোগকে উন্নত করা ৷ যাতে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং মানুষে-মানুষে যোগাযোগে সুবিধে হয় ৷ শিক্ষা, পর্যটন, সাংস্কৃতিক কূটনীতির ক্ষেত্রে আদানপ্রদানের মধ্যে দিয়ে সাংস্কৃতিক এবং মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে শক্তিশালী করে তোলা ৷
সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিওনাল কোঅপারেশন (সার্ক), বে অফ বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টর টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কোঅপারেশনের (বিমস্টেক) মতো আঞ্চলিক ফোরামে সাধারণ সমস্যাগুলি নিয়ে আলোচনা এবং সমাধানের রাস্তা খুঁজে বের করা ৷
এদিক আরও একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি বাস্তবায়িত হতে চলেছে ৷ মলদ্বীপের সেনাবাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে প্রশিক্ষণ নেবে ৷ মলদ্বীপে ভারতীয় হাইকমিশন এক্স হ্যান্ডেলে ঘোষণা করেছে, 'একতা' অনুশীলনের সপ্তম সংস্কার বুধবার থেকে শুরু হয়েছে ৷ জলসীমায় দু'দেশের মধ্যে সাধারণ যে চ্যালেঞ্জগুলি, তার মোকাবিলায় এই অনুশীলন, উল্লেখ করেছে হাইকমিশন ৷