ETV Bharat / bharat

বিমা বাজারে ভারত অনেকটাই পিছিয়ে, স্বাস্থ্য-সুরক্ষার বন্দোবস্ত করতে পারে না ভারতীয়রা, রইল কিছু প্রস্তাব

author img

By ETV Bharat Bangla Team

Published : Feb 20, 2024, 9:03 PM IST

Indian Insurance Sector: 2021 সালে নীতি আয়োগ স্বীকার করেছে, গরিব শ্রেণির নয়, এমন 40 কোটি ভারতীয়ের স্বাস্থ্য বিমা কেনা বা স্বাস্থ্য পরিষেবায় সুরক্ষার ব্যবস্থা করার মতো ক্ষমতা নেই ৷ এ নিয়ে লিখছেন মিজোরাম সেন্ট্রাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ এনভিআর জ্য়োতি কুমার ৷

ETV Bharat
বিমা বাজারে ভারতের অবস্থান

ডঃ এনভিআর জ্য়োতি কুমার, মিজোরাম সেন্ট্রাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক

ভারতের বিমা সেক্টরে 34টি সাধারণ বিমা কোম্পানি আছে ৷ এরা জীবন বিমা নয় ৷ আর 24টি জীবন বিমা কোম্পানি রয়েছে ৷ এই জীবন বিমা কোম্পানিগুলির মধ্যে লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি অফ ইন্ডিয়া বা এলআইসি একটি মাত্র পাবলিক সেক্টর এন্টারপ্রাইজ বা পিএসই ৷ সাধারণ বিমা সেক্টরে ছ'টি পিএসইউ আছে ৷ এর সঙ্গে দেশে একটি জাতীয় রি-ইনসিওরার আছে, অর্থাৎ সব বিমা কোম্পানির বিমা যেখানে গচ্ছিত থাকে ৷ সেই রি-ইনসিওরার হল জেনারেল ইনস্যুরেন্স কর্পোরেশ অফ ইন্ডিয়া বা জিআইসি ৷

বিমা ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান

বিমার ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্য দেশগুলির তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে ভারত ৷ বিশ্বে বিমার আওতাভুক্ত 6.8 শতাংশ ৷ এদিকে ভারতে তা 4 শতাংশ (জিডিপি হারে দেয় প্রিমিয়াম অনুযায়ী) ৷ অন্যদিকে যদি আমরা বিমার ঘনত্ব পরিমাপ করি, তাহলে বিশ্বে মাথা পিছু প্রিমিয়াম যেখানে 853 মার্কিন ডলার, সেখানে ভারতে জন প্রতি মাত্র 92 ডলার প্রিমিয়াম দেয় ৷ বিশ্বে সবচেয়ে বড় বিমার বাজার রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৷ 2022 সালে জীবন বিমা এবং জীবন বিমা নয় এই দু'রকম বিমা মিলিয়ে মোট প্রিমিয়ামের পরিমাণ 3 ট্রিলিয়ন বা 3লক্ষ কোটি মার্কিন ডলার ৷ অবশ্য বিমা ব্যবসায় আমেরিকার আগে রয়েছে চিন ও ব্রিটেন ৷ আর এই আমেরিকা, চিন আর ব্রিটেন- তিনটি দেশের বাজারে মোট প্রিমিয়ামের পরিমাণ বিশ্বের 55 শতাংশেরও বেশি ৷ বিশ্বের বিমা বাজারে ভারত দশম স্থানে রয়েছে ৷ ভারতে এই প্রিমিয়ামের মূল্য 131 বিলিয়ন বা 13 হাজার 100 কোটি মার্কিন ডলার, যা বিশ্বের বাজারের 1.9 শতাংশ ৷ তবে বিশ্বে ভারতের বাজার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে ৷ তাই 2032 সালের মধ্যে ভারত ষষ্ঠ বৃহত্তম বিমা বাজারে পরিণত হতে পারে, তেমন লক্ষ্যমাত্রা রাখা হয়েছে ৷

বিমার বাজারে অনেক কিছুই জানা বাকি

ভারতে যে বিমাগুলি বিক্রি হয়, তার বেশিরভাগই সঞ্চয়ের সঙ্গে জড়িত ৷ এতে সুরক্ষার মূল্য খুবই সামান্য থাকে ৷ এর অর্থ, কোনও পরিবারের প্রধান রোজগেরে ব্যক্তিটির আকস্মিক মৃত্যু হলে সেই পরিবারকে অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের মুখোমুখি হতে হবে ৷ এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগে মৃত্যুর ক্ষেত্রে 93 শতাংশেরই কোনও বিমা করা থাকে না ৷ এমনকী নীতি আয়োগ তাদের 2021 সালের রিপোর্টে খোলাখুলি স্বীকার করেছে, দুঃস্থ নয় এমন শ্রেণির 40 কোটি ভারতীয়ের স্বাস্থ্যের সুরক্ষায় বিমা নেই ৷ এই শ্রেণির মানুষদের 'মিসিং মিডল' বলে আখ্যা দেওয়া হয় ৷ কারণ, তারা এতটাও গরিব নয় যে সরকারের ভরতুকি দেওয়া বিমার অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে ৷ আবার অন্যদিকে একটি বিমা কিনতে পারবে, তারা এতটাও ধনী নয় ৷ একটি যথাযথ মূল্যের, যা সরকার দেবে এবং তার জন্য কোনও ব্যক্তিকে টাকা দিতে হবে না, এমন বিমা তৈরির ভাবনাচিন্তা চলছে ৷ 2047 সালের মধ্যে প্রত্যেক নাগরিকের যাতে বিমা থাকে, তাই সবার জন্য বিমা লক্ষ্য রাখা হয়েছে ৷

সংস্কারের প্রস্তাব

এই লক্ষ্য পূরণে সম্প্রতি বাজেট অধিবেশনে সংসদের অর্থমন্ত্রকের স্ট্যান্ডিং কমিটি একটি রিপোর্ট পেশ করে ৷ এই কমিটির প্রধান ছিলেন জয়ন্ত সিনহা ৷ 'পারফরম্যান্স রিভিউ অ্যান্ড রেগুলেশন অফ ইনস্যুরেন্স সেক্টর' শীর্ষক এই রিপোর্টে দেশের ইনস্যুরেন্স সেক্টরে একটা ঢেউ উঠেছে বলা যায় ৷ ইনস্যুরেন্স ইন্ডাস্ট্রি এবং গ্রাহকদের জন্য এই কমিটি যে প্রস্তাব দিয়েছে, তা প্রশংসনীয়৷ তবে এই প্রস্তাবগুলিকে বাস্তবায়িত করতে সরকারকে একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ তৈরি করতে হবে ৷ এই গ্রুপটি তৈরি করবে ইনস্যুরেন্স রেগুলেটরি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অথরিটি অফ ইন্ডিয়া বা আইআরডিএআই ৷ এই গ্রুপে অংশীদারিদের নিয়ে একটি যথাযথ নীতির ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করার চেষ্টা করতে হবে, যাতে এই বিমা সংক্রান্ত সমস্যাগুলির সমাধান বের করা যায় ৷ এ নিয়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুর উল্লেখ করা হল ৷

সব ধরনের বিমার জন্য কম্পোজিট লাইসেন্সের ব্যবস্থা

এই কমিটি প্রস্তাব দিয়েছে, বিমা কোম্পানিগুলিকে কম্পোজিট লাইসেন্সের অনুমতি দিতে হবে ৷ কম্পোজিট লাইসেন্সের মাধ্যমে একটি বিমা কোম্পানি জীবন বিমা এবং অন্য ধরনের বিমা- দুই-ই বিক্রি করতে পারবে ৷ সাধারণত, জীবন বিমা এবং অন্য বিমাগুলি বিক্রির জন্য পৃথক পৃথক লাইসেন্স লাগে ৷ আইআরডিএআই একটি বিমা কোম্পানিকে কম্পোজিট লাইসেন্সের অনুমতি দেয় না ৷ এই কম্পোজিট লাইসেন্স হলে তা বিমার মূল্য কমাতে সাহায্য করবে, বিমা কোম্পানির সমস্যা কমবে ৷ যেমনটা আশা করে স্ট্যান্ডিং কমিটি ৷ এই সংস্কারের ফলে বিমা কোম্পানি তার গ্রাহকদের কাছে আরও বেশি ধরনের এবং বিভিন্ন মূল্যের বিমা পৌঁছে দিতে পারবে ৷ যেমন একটা সিঙ্গল পলিসির মধ্যেই জীবন, স্বাস্থ্য এবং সঞ্চয়- তিনটিই অন্তর্ভুক্ত থাকবে ৷ প্রয়োজনে গ্রাহক একটি বিমা কোম্পানির বিমায় সব সুরক্ষা পাবে ৷ আর তা হবে সহজ এবং কম মূল্যের প্রিমিয়াম বা কিস্তিতেই ৷

বিমা এজেন্টদের জন্য সহজ-খেলামেলা পরিকল্পনা

দেশে গ্রাহকদের কাছে বিমা পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার পরিকাঠামোটিকে আরও শক্তিশালী করতে হবে ৷ আরও বৃহৎ পরিসরে তা ছড়িয়ে দিতে হবে ৷ এই প্রস্তাবও দিয়েছে কমিটি ৷ আর এর জন্য বিমা এজেন্টদের জন্য একটি সহজ-সরল খোলামেলা পরিকল্পনা তৈরি করা প্রয়োজন ৷ এই রকম সংস্কারের ফলে একজন এজেন্ট একাধিক বিমা কোম্পানির সঙ্গে কাজ করতে পারবেন ৷ তার ফলে গ্রাহকের নির্দিষ্ট প্রয়োজনটিও মেটানো যাবে ৷ বর্তমানে একজন এজেন্ট বিমা পরিষেবার কাজে শুধুমাত্র একটি জীবন বিমা, একটি অ-জীবন বিমা এবং একটি স্বাস্থ্য বিমা কোম্পানির সঙ্গে কাজ করতে পারে ৷

জিএসটি হ্রাসের সঠিক সময়

বিমা কেবলমাত্র একটি বাণিজ্যিক পণ্য নয়, বরং একটি সামাজিক পরিষেবাও ৷ বিমা বিশেষজ্ঞ এবং এই বিমা ইন্ডাস্ট্রি দীর্ঘ দিন ধরেই বিমার উপর লাগু হওয়া গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স বা জিএসটি হ্রাসের পক্ষে সওয়াল করে আসছে ৷ স্বাস্থ্য বিমা, টার্ম ইনস্যুরেন্স প্ল্যান, ইউনিটের সঙ্গে যুক্ত ইনস্যুরেন্স প্ল্যানগুলিতে 18 শতাংশ জিএসটি লাগে ৷ সংসদীয় কমিটির পর্যবেক্ষণ, উচ্চহারে জিএসটি লাগু করার ফলে প্রিমিয়াম বা কিস্তির অর্থও বেড়ে যায়, যা ভারতে বিমা করার পথে বাধা ৷ বিমাকে সাধারণ মানুষের জন্য আরও সহজলভ্য করে তুলতে হবে ৷ তাই এই কমিটি সব বিমার জন্যই জিএসটি হ্রাসের প্রস্তাব দিয়েছে ৷ বিশেষত প্রধানমন্ত্রী জন আরোগ্য যোজনা বা পিএমজেএওয়াই-এর অধীনে থাকা প্রবীণ নাগরিকদের স্বাস্থ্য বিমা এবং মাইক্রো ইনস্যুরেন্স পলিসিগুলির ক্ষেত্রে ৷ এর পাশাপাশি টার্ম পলিসিগুলির জন্যও ৷

সবার জন্য সমান নিয়ম নিশ্চিত করা

কমিটি আরও উল্লেখ করেছে, বিমা সেক্টরে থাকা পাবলিক সেক্টর এন্টারপ্রাইজগুলিকে সরকারের বিমা প্রকল্পগুলিতে অংশ নিতে হবে ৷ এতে পিএসইউগুলির লাভের অর্থে প্রভাব পড়বে ৷ কিন্তু এই অংশ নেওয়াকে বাধ্যতামূলক করতে হবে ৷ তবে এই ব্যবস্থা সবার জন্য সমান প্রযোজ্য করার উপর জোর দিয়েছে কমিটি ৷ সাম্যতা বজায় রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে ৷ এর সঙ্গে স্ট্যান্ডিং কমিটি আরেকটি ব্যতিক্রমের কথাও উল্লেখ করেছে ৷ পিএসইউ কোম্পানিগুলির ক্ষেত্রেই শুধুমাত্র জিএসটিতে টিডিএস বা 'ট্যাক্স ডিডাক্টেড অ্যাট সোর্স' প্রযোজ্য ৷

সেন্ট্রাল গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস বা সিজিএসটি আইনের 51 নম্বর ধারায় পিএসইউগুলির কথা বলা হয়েছে ৷ এতে করযোগ্য সামগ্রী বা পরিষেবা বা দু'টি ক্ষেত্রে সরবরাহকারীর লেনদেনের অর্থ থেকে 2 শতাংশ টিডিএস কাটা হয় ৷ তবে এই লেনদেনের অর্থের মোট পরিমাণ 2.50 লক্ষ বা তার বেশি হতে হবে ৷

দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলির জন্য বিশেষ বিমা

সুইস রি-র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, 2018-22 সালে পাঁচ বছর সময়কালে প্রাকৃতি দুর্যোগে ভারতের 32.94 বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা 2 কোটি 73 লক্ষ 500 কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে, যার বিমা করা ছিল না ৷ 1900 সালের পর থেকে সবচেয়ে বেশি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঘটনায় ভারত তৃতীয় স্থানে রয়েছে ৷ ভারতের আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চিন আছে ৷ 2022 সালের প্রথম 9 মাসের প্রায় প্রত্যেক দিনই ভারতে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঘটনা চাক্ষুস করেছে ৷ কখনও তীব্র গরম, কখনও শৈত্যপ্রবাহ তো কখনও আবার ঘূর্ণিঝড় এবং বজ্রবিদ্যুৎ-সহ ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি, বন্যা এবং ভূমি ধসের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছে ভারতে ৷ এই বিপর্যয়ে 2 হাজার 700 জনের মৃত্যু হয়েছে ৷ 1.8 মিলিয়ন হেক্টর কৃষি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, 4.16 লক্ষেরও বেশি সংখ্যক বাড়ি ধ্বংস হয়েছে ৷ এছাড়া প্রায় 70 হাজার গবাদি পশুর মৃত্যু হয়েছে ৷ এই তথ্য দিয়েছে সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট বা সিএসই এবং ডাউন টু আর্থ জার্নাল ৷

এর ফলে কৃষির সঙ্গে জড়িত সম্প্রদায়, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরনের ব্যবসায়ী বা এমএসএমইতে কাজ করছেন এমন মানুষদের প্রভূত ক্ষতি হয়েছে ৷ সমাজের এই শ্রেণির মানুষের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নেই ৷ তাই এই বিশেষ সময় দুর্যোগের ফলে হওয়া ক্ষয়ক্ষতি থেকে রেহাই পেতে কীভাবে বিমা করা যায়, সেই দিকগুলি খতিয়ে দেখতে হবে ৷ এর জন্য পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ সাহায্য প্রয়োজন ৷

এরকম ঝুঁকিগুলি দক্ষতা ও সফলতার সঙ্গে সামলেছে ক্যালিফোর্নিয়া আর্থকুয়েক অথরিটি, অস্ট্রেলিয়ার হাউজহোল্ড রেজিলিয়েন্স প্রোগ্রাম এবং তুর্কির ক্যাটাসট্রফিক ইনস্যুরেন্স পুল ৷ এই সংস্থাগুলি দেখিয়েছে কীভাবে অলাভজনক সংস্থা চালানো যায় ৷ এই অলাভজনক সংস্থাগুলি বিমা কোম্পানিগুলির থেকে তহবিল সংগ্রহ করে ৷ আর তাতে সরকার এবং বেসরকারি বিমা কোম্পানি, উভয়েই অর্থ জমা দেয় ৷ এতে হঠাৎ কোনও বিপদ এলে তার মোকাবিলা করাটা সহজ হয়ে ওঠে ৷ ভারতেরও এরকম কাজ করা উচিত ৷ এর শুরুতে কোনও একটি পিএসই জেনারেল ইনস্যুরেন্স কোম্পানির দ্বারা বিশেষ বিমার ব্যবসা করা যায় ৷ আর এতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রবণ এলাকাগুলির জন্য ভরতুকি দেওয়া প্রিমিয়ামের ব্যবস্থা করা হবে ৷

পথ দুর্ঘটনায় ক্ষতি বা মৃত্যুতে বিমার প্রয়োজনীয়তা

ভারত সরকারের জাতীয় সড়ক পরিবহণ মন্ত্রক কয়েক মাসের মধ্যেই সারা দেশে পথ দুর্ঘটনায় আহতদের জন্য নগদহীন বা ক্যাশলেস চিকিৎসা পরিষেবা ব্যবস্থা আরম্ভ করতে পারে ৷ বিশ্বে পথ দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর রেকর্ড রয়েছে ভারতের ৷ একটি সরকারি রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে পথ দুর্ঘটনার কারণে প্রতি ঘণ্টায় 19জনের মৃত্যু হয় ৷ 2022 সালে সারা দেশে পথ দুর্ঘটনার ফলে 4.61 লক্ষ সংখ্যক পথ দুর্ঘটনা ঘটেছে ৷ এতে 1.68 লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে ৷ এর পরিপ্রেক্ষিতে কমিটি জানাচ্ছে, ভারতের রাস্তায় বিশাল সংখ্যক গাড়ির কোনও বিমা করা নেই ৷ বিশেষত ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যবহৃত গাড়িগুলি ৷ এক্ষেত্রে পথ দুর্ঘটনা হলে গাড়ির মালিক এবং তৃতীয় পক্ষের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে ৷ ইনস্যুরেন্স ইনফরমেশন ব্যুরো অফ ইন্ডিয়া বা আইআইবি-র দেওয়া মোটর অ্যানুয়াল রিপোর্ট অনুযায়ী, 2020 সালের মার্চ মাসে ভারতের রাস্তাগুলিতে 25.33 কোটিরও বেশি যান চলাচল করেছে ৷ এর মধ্যে প্রায় 56 শতাংশের কোনও বিমা নেই ৷ বাণিজ্যিক গাড়িগুলির ফলে হওয়া পথ দুর্ঘটনায় বহু নিরপরাধ মানুষ প্রাণ হারায় ৷ দুর্ঘটনার পরে ক্ষতি হলে তার জন্য কোনও যথাযোগ্য বিমা নেই ৷ এই ক্ষেত্রে কমিটির প্রস্তাব, রাজ্যগুলির সর্বত্র ই-চালান কার্যকর করা হোক ৷ এই কার্যকর করার ক্ষেত্রে তথ্য সরবরাহের কাজটি করবে আইআইবি, এমপরিবহণ এবং ন্যাশনাল ইনফরমেটিক্স সেন্টার ৷ ইনস্যুরেন্স ইন্ডাস্ট্রিকে 40-50 হাজার কোটি টাকার প্রয়োজনীয় পুঁজি দিতে পারে রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া (আরবিআই) ৷ এর জন্য ভারত সরকারের তরফে আরবিআই বিমা ইন্ডাস্ট্রিকে বিভিন্ন ধরনের ম্যাচিওরিটির 'অন-ট্যাপ' বন্ড ইস্যু করতে পারে ৷ এই পিএসই-গুলির ব্যবস্থাপনাকে উদ্ভাবনী করে তুলতে, তাকে কার্যকর করতে, তার দক্ষতা বৃদ্ধি করতে এবং উন্নত প্রতিযোগিতার জন্য একটা যথাযথ কৌশলী রোডম্যাপ করা এখনই প্রয়োজন ৷ এর ফলে ওই পিএসইউ-গুলি যথেষ্ট পুঁজি জোগাড় করতে পাবে ৷

2022 সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি সমীক্ষা করে ৷ তাতে জানা গিয়েছে, বার্ষিক 55 মিলিয়ন বা 5 কোটি 50 লক্ষ ভারতীয় নিজের ক্ষমতার বাইরে গিয়ে স্বাস্থ্যের জন্য খরচ করতে পারেন না ৷ সরকারের দেওয়া আরেকটি তথ্য আরও দুঃখের৷ সেখান থেকে জানা গিয়েছে, 63 মিলিয়ন বা 6 কোটি 30 লক্ষেরও বেশি ভারতীয় শুধুমাত্র স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দের বাইরে থাকে ৷ বিমায় স্বাস্থ্য ভালো রাখা বা স্বাস্থ্য পরিষেবার পুরো খরচ না যুক্ত থাকলে তাতে মানুষের আর্থিক চাপ বেড়ে যায় ৷ তখন আউট অফ পকেট এক্সপেনডিচার বা ওওপিই অর্থাৎ নিজের আর্থিক ক্ষমতার বাইরে গিয়ে স্বাস্থ্যের জন্য খরচ করতে হয়৷ ভারত সরকার 2022 সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষায় স্বীকার করে নিয়েছে, ভারতে স্বাস্থ্যে ওওপিই খরচ 48.2 শতাংশ ৷ এই খরচ সরকারের স্বাস্থ্য খাতে খরচ 40.6 শতাংশের চেয়ে বেশি ৷ ভারতে এই ওওপিই সাধারণ অনেকটাই বেশি হয় ৷ সেরকমই বিশ্বের অর্থনৈতিক দিক দিয়ে দুর্বল দেশগুলির ক্ষেত্রেও ৷

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, উত্তরপ্রদেশে রোগীদের ওওপিই খরচ 71 শতাংশ ৷ তারপরেই রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ ও কেরল ৷ দু'টি রাজ্যের প্রতিটিতে এই খরচ 68 শতাংশ ৷ এতেই বোঝা যায় বিভিন্ন রাজ্যে স্বাস্থ্য পরিষেবায় খরচের বৈষম্য কীরকম ৷ এদিকে 2022-23 সালের একটি হিসেব জানাচ্ছে, দেশের মোট স্বাস্থ্য বিমার প্রিমিয়ামের দুই-তৃতীয়াংশ জোগায় পাঁচটি রাজ্য- মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, গুজরাত এবং দিল্লি ৷ আর বাকি রাজ্যগুলি মাত্র এক-তৃতীয়াংশ ৷ 2017 সালের ন্যাশনাল হেলথ পলিসি অনুযায়ী ভারত একটা সর্বজনীন লক্ষ্য পূরণের চেষ্টা করেছিল ৷ যেখানে প্রতিটি নাগরিকের স্বাস্থ্য বিমা থাকবে ৷ প্রত্যেকে উন্নত মানের স্বাস্থ্য পরিষেবা পাবে ৷ এর জন্য যা খরচ হবে, তা হাতের নাগালেই থাকবে ৷ কিন্তু তা হয়নি ৷ তাই এই ইস্যুগুলির সমাধান না করলে এই লক্ষ্য পূরণ হওয়া সম্ভব নয় ৷

আরও পড়ুন:

  1. 'বাংলা শস্য বিমা'র আওতায় ক্ষতিগ্রস্ত চাষীদের জন্য 197 কোটি টাকা বরাদ্দ নবান্নের
  2. সরষে থেকে তিল-সয়াবিন চাষে জোর, বদলে যেতে পারে দেশের কৃষি-মানচিত্র
  3. অন্তর্বর্তী বাজেটে করের ক্ষেত্রে কী ঘোষণা নির্মলার ? জানুন প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ করের হালহকিকত

ডঃ এনভিআর জ্য়োতি কুমার, মিজোরাম সেন্ট্রাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক

ভারতের বিমা সেক্টরে 34টি সাধারণ বিমা কোম্পানি আছে ৷ এরা জীবন বিমা নয় ৷ আর 24টি জীবন বিমা কোম্পানি রয়েছে ৷ এই জীবন বিমা কোম্পানিগুলির মধ্যে লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি অফ ইন্ডিয়া বা এলআইসি একটি মাত্র পাবলিক সেক্টর এন্টারপ্রাইজ বা পিএসই ৷ সাধারণ বিমা সেক্টরে ছ'টি পিএসইউ আছে ৷ এর সঙ্গে দেশে একটি জাতীয় রি-ইনসিওরার আছে, অর্থাৎ সব বিমা কোম্পানির বিমা যেখানে গচ্ছিত থাকে ৷ সেই রি-ইনসিওরার হল জেনারেল ইনস্যুরেন্স কর্পোরেশ অফ ইন্ডিয়া বা জিআইসি ৷

বিমা ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান

বিমার ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্য দেশগুলির তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে ভারত ৷ বিশ্বে বিমার আওতাভুক্ত 6.8 শতাংশ ৷ এদিকে ভারতে তা 4 শতাংশ (জিডিপি হারে দেয় প্রিমিয়াম অনুযায়ী) ৷ অন্যদিকে যদি আমরা বিমার ঘনত্ব পরিমাপ করি, তাহলে বিশ্বে মাথা পিছু প্রিমিয়াম যেখানে 853 মার্কিন ডলার, সেখানে ভারতে জন প্রতি মাত্র 92 ডলার প্রিমিয়াম দেয় ৷ বিশ্বে সবচেয়ে বড় বিমার বাজার রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৷ 2022 সালে জীবন বিমা এবং জীবন বিমা নয় এই দু'রকম বিমা মিলিয়ে মোট প্রিমিয়ামের পরিমাণ 3 ট্রিলিয়ন বা 3লক্ষ কোটি মার্কিন ডলার ৷ অবশ্য বিমা ব্যবসায় আমেরিকার আগে রয়েছে চিন ও ব্রিটেন ৷ আর এই আমেরিকা, চিন আর ব্রিটেন- তিনটি দেশের বাজারে মোট প্রিমিয়ামের পরিমাণ বিশ্বের 55 শতাংশেরও বেশি ৷ বিশ্বের বিমা বাজারে ভারত দশম স্থানে রয়েছে ৷ ভারতে এই প্রিমিয়ামের মূল্য 131 বিলিয়ন বা 13 হাজার 100 কোটি মার্কিন ডলার, যা বিশ্বের বাজারের 1.9 শতাংশ ৷ তবে বিশ্বে ভারতের বাজার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে ৷ তাই 2032 সালের মধ্যে ভারত ষষ্ঠ বৃহত্তম বিমা বাজারে পরিণত হতে পারে, তেমন লক্ষ্যমাত্রা রাখা হয়েছে ৷

বিমার বাজারে অনেক কিছুই জানা বাকি

ভারতে যে বিমাগুলি বিক্রি হয়, তার বেশিরভাগই সঞ্চয়ের সঙ্গে জড়িত ৷ এতে সুরক্ষার মূল্য খুবই সামান্য থাকে ৷ এর অর্থ, কোনও পরিবারের প্রধান রোজগেরে ব্যক্তিটির আকস্মিক মৃত্যু হলে সেই পরিবারকে অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের মুখোমুখি হতে হবে ৷ এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগে মৃত্যুর ক্ষেত্রে 93 শতাংশেরই কোনও বিমা করা থাকে না ৷ এমনকী নীতি আয়োগ তাদের 2021 সালের রিপোর্টে খোলাখুলি স্বীকার করেছে, দুঃস্থ নয় এমন শ্রেণির 40 কোটি ভারতীয়ের স্বাস্থ্যের সুরক্ষায় বিমা নেই ৷ এই শ্রেণির মানুষদের 'মিসিং মিডল' বলে আখ্যা দেওয়া হয় ৷ কারণ, তারা এতটাও গরিব নয় যে সরকারের ভরতুকি দেওয়া বিমার অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে ৷ আবার অন্যদিকে একটি বিমা কিনতে পারবে, তারা এতটাও ধনী নয় ৷ একটি যথাযথ মূল্যের, যা সরকার দেবে এবং তার জন্য কোনও ব্যক্তিকে টাকা দিতে হবে না, এমন বিমা তৈরির ভাবনাচিন্তা চলছে ৷ 2047 সালের মধ্যে প্রত্যেক নাগরিকের যাতে বিমা থাকে, তাই সবার জন্য বিমা লক্ষ্য রাখা হয়েছে ৷

সংস্কারের প্রস্তাব

এই লক্ষ্য পূরণে সম্প্রতি বাজেট অধিবেশনে সংসদের অর্থমন্ত্রকের স্ট্যান্ডিং কমিটি একটি রিপোর্ট পেশ করে ৷ এই কমিটির প্রধান ছিলেন জয়ন্ত সিনহা ৷ 'পারফরম্যান্স রিভিউ অ্যান্ড রেগুলেশন অফ ইনস্যুরেন্স সেক্টর' শীর্ষক এই রিপোর্টে দেশের ইনস্যুরেন্স সেক্টরে একটা ঢেউ উঠেছে বলা যায় ৷ ইনস্যুরেন্স ইন্ডাস্ট্রি এবং গ্রাহকদের জন্য এই কমিটি যে প্রস্তাব দিয়েছে, তা প্রশংসনীয়৷ তবে এই প্রস্তাবগুলিকে বাস্তবায়িত করতে সরকারকে একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ তৈরি করতে হবে ৷ এই গ্রুপটি তৈরি করবে ইনস্যুরেন্স রেগুলেটরি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অথরিটি অফ ইন্ডিয়া বা আইআরডিএআই ৷ এই গ্রুপে অংশীদারিদের নিয়ে একটি যথাযথ নীতির ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করার চেষ্টা করতে হবে, যাতে এই বিমা সংক্রান্ত সমস্যাগুলির সমাধান বের করা যায় ৷ এ নিয়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুর উল্লেখ করা হল ৷

সব ধরনের বিমার জন্য কম্পোজিট লাইসেন্সের ব্যবস্থা

এই কমিটি প্রস্তাব দিয়েছে, বিমা কোম্পানিগুলিকে কম্পোজিট লাইসেন্সের অনুমতি দিতে হবে ৷ কম্পোজিট লাইসেন্সের মাধ্যমে একটি বিমা কোম্পানি জীবন বিমা এবং অন্য ধরনের বিমা- দুই-ই বিক্রি করতে পারবে ৷ সাধারণত, জীবন বিমা এবং অন্য বিমাগুলি বিক্রির জন্য পৃথক পৃথক লাইসেন্স লাগে ৷ আইআরডিএআই একটি বিমা কোম্পানিকে কম্পোজিট লাইসেন্সের অনুমতি দেয় না ৷ এই কম্পোজিট লাইসেন্স হলে তা বিমার মূল্য কমাতে সাহায্য করবে, বিমা কোম্পানির সমস্যা কমবে ৷ যেমনটা আশা করে স্ট্যান্ডিং কমিটি ৷ এই সংস্কারের ফলে বিমা কোম্পানি তার গ্রাহকদের কাছে আরও বেশি ধরনের এবং বিভিন্ন মূল্যের বিমা পৌঁছে দিতে পারবে ৷ যেমন একটা সিঙ্গল পলিসির মধ্যেই জীবন, স্বাস্থ্য এবং সঞ্চয়- তিনটিই অন্তর্ভুক্ত থাকবে ৷ প্রয়োজনে গ্রাহক একটি বিমা কোম্পানির বিমায় সব সুরক্ষা পাবে ৷ আর তা হবে সহজ এবং কম মূল্যের প্রিমিয়াম বা কিস্তিতেই ৷

বিমা এজেন্টদের জন্য সহজ-খেলামেলা পরিকল্পনা

দেশে গ্রাহকদের কাছে বিমা পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার পরিকাঠামোটিকে আরও শক্তিশালী করতে হবে ৷ আরও বৃহৎ পরিসরে তা ছড়িয়ে দিতে হবে ৷ এই প্রস্তাবও দিয়েছে কমিটি ৷ আর এর জন্য বিমা এজেন্টদের জন্য একটি সহজ-সরল খোলামেলা পরিকল্পনা তৈরি করা প্রয়োজন ৷ এই রকম সংস্কারের ফলে একজন এজেন্ট একাধিক বিমা কোম্পানির সঙ্গে কাজ করতে পারবেন ৷ তার ফলে গ্রাহকের নির্দিষ্ট প্রয়োজনটিও মেটানো যাবে ৷ বর্তমানে একজন এজেন্ট বিমা পরিষেবার কাজে শুধুমাত্র একটি জীবন বিমা, একটি অ-জীবন বিমা এবং একটি স্বাস্থ্য বিমা কোম্পানির সঙ্গে কাজ করতে পারে ৷

জিএসটি হ্রাসের সঠিক সময়

বিমা কেবলমাত্র একটি বাণিজ্যিক পণ্য নয়, বরং একটি সামাজিক পরিষেবাও ৷ বিমা বিশেষজ্ঞ এবং এই বিমা ইন্ডাস্ট্রি দীর্ঘ দিন ধরেই বিমার উপর লাগু হওয়া গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স বা জিএসটি হ্রাসের পক্ষে সওয়াল করে আসছে ৷ স্বাস্থ্য বিমা, টার্ম ইনস্যুরেন্স প্ল্যান, ইউনিটের সঙ্গে যুক্ত ইনস্যুরেন্স প্ল্যানগুলিতে 18 শতাংশ জিএসটি লাগে ৷ সংসদীয় কমিটির পর্যবেক্ষণ, উচ্চহারে জিএসটি লাগু করার ফলে প্রিমিয়াম বা কিস্তির অর্থও বেড়ে যায়, যা ভারতে বিমা করার পথে বাধা ৷ বিমাকে সাধারণ মানুষের জন্য আরও সহজলভ্য করে তুলতে হবে ৷ তাই এই কমিটি সব বিমার জন্যই জিএসটি হ্রাসের প্রস্তাব দিয়েছে ৷ বিশেষত প্রধানমন্ত্রী জন আরোগ্য যোজনা বা পিএমজেএওয়াই-এর অধীনে থাকা প্রবীণ নাগরিকদের স্বাস্থ্য বিমা এবং মাইক্রো ইনস্যুরেন্স পলিসিগুলির ক্ষেত্রে ৷ এর পাশাপাশি টার্ম পলিসিগুলির জন্যও ৷

সবার জন্য সমান নিয়ম নিশ্চিত করা

কমিটি আরও উল্লেখ করেছে, বিমা সেক্টরে থাকা পাবলিক সেক্টর এন্টারপ্রাইজগুলিকে সরকারের বিমা প্রকল্পগুলিতে অংশ নিতে হবে ৷ এতে পিএসইউগুলির লাভের অর্থে প্রভাব পড়বে ৷ কিন্তু এই অংশ নেওয়াকে বাধ্যতামূলক করতে হবে ৷ তবে এই ব্যবস্থা সবার জন্য সমান প্রযোজ্য করার উপর জোর দিয়েছে কমিটি ৷ সাম্যতা বজায় রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে ৷ এর সঙ্গে স্ট্যান্ডিং কমিটি আরেকটি ব্যতিক্রমের কথাও উল্লেখ করেছে ৷ পিএসইউ কোম্পানিগুলির ক্ষেত্রেই শুধুমাত্র জিএসটিতে টিডিএস বা 'ট্যাক্স ডিডাক্টেড অ্যাট সোর্স' প্রযোজ্য ৷

সেন্ট্রাল গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস বা সিজিএসটি আইনের 51 নম্বর ধারায় পিএসইউগুলির কথা বলা হয়েছে ৷ এতে করযোগ্য সামগ্রী বা পরিষেবা বা দু'টি ক্ষেত্রে সরবরাহকারীর লেনদেনের অর্থ থেকে 2 শতাংশ টিডিএস কাটা হয় ৷ তবে এই লেনদেনের অর্থের মোট পরিমাণ 2.50 লক্ষ বা তার বেশি হতে হবে ৷

দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলির জন্য বিশেষ বিমা

সুইস রি-র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, 2018-22 সালে পাঁচ বছর সময়কালে প্রাকৃতি দুর্যোগে ভারতের 32.94 বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা 2 কোটি 73 লক্ষ 500 কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে, যার বিমা করা ছিল না ৷ 1900 সালের পর থেকে সবচেয়ে বেশি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঘটনায় ভারত তৃতীয় স্থানে রয়েছে ৷ ভারতের আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চিন আছে ৷ 2022 সালের প্রথম 9 মাসের প্রায় প্রত্যেক দিনই ভারতে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঘটনা চাক্ষুস করেছে ৷ কখনও তীব্র গরম, কখনও শৈত্যপ্রবাহ তো কখনও আবার ঘূর্ণিঝড় এবং বজ্রবিদ্যুৎ-সহ ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি, বন্যা এবং ভূমি ধসের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছে ভারতে ৷ এই বিপর্যয়ে 2 হাজার 700 জনের মৃত্যু হয়েছে ৷ 1.8 মিলিয়ন হেক্টর কৃষি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, 4.16 লক্ষেরও বেশি সংখ্যক বাড়ি ধ্বংস হয়েছে ৷ এছাড়া প্রায় 70 হাজার গবাদি পশুর মৃত্যু হয়েছে ৷ এই তথ্য দিয়েছে সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট বা সিএসই এবং ডাউন টু আর্থ জার্নাল ৷

এর ফলে কৃষির সঙ্গে জড়িত সম্প্রদায়, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরনের ব্যবসায়ী বা এমএসএমইতে কাজ করছেন এমন মানুষদের প্রভূত ক্ষতি হয়েছে ৷ সমাজের এই শ্রেণির মানুষের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নেই ৷ তাই এই বিশেষ সময় দুর্যোগের ফলে হওয়া ক্ষয়ক্ষতি থেকে রেহাই পেতে কীভাবে বিমা করা যায়, সেই দিকগুলি খতিয়ে দেখতে হবে ৷ এর জন্য পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ সাহায্য প্রয়োজন ৷

এরকম ঝুঁকিগুলি দক্ষতা ও সফলতার সঙ্গে সামলেছে ক্যালিফোর্নিয়া আর্থকুয়েক অথরিটি, অস্ট্রেলিয়ার হাউজহোল্ড রেজিলিয়েন্স প্রোগ্রাম এবং তুর্কির ক্যাটাসট্রফিক ইনস্যুরেন্স পুল ৷ এই সংস্থাগুলি দেখিয়েছে কীভাবে অলাভজনক সংস্থা চালানো যায় ৷ এই অলাভজনক সংস্থাগুলি বিমা কোম্পানিগুলির থেকে তহবিল সংগ্রহ করে ৷ আর তাতে সরকার এবং বেসরকারি বিমা কোম্পানি, উভয়েই অর্থ জমা দেয় ৷ এতে হঠাৎ কোনও বিপদ এলে তার মোকাবিলা করাটা সহজ হয়ে ওঠে ৷ ভারতেরও এরকম কাজ করা উচিত ৷ এর শুরুতে কোনও একটি পিএসই জেনারেল ইনস্যুরেন্স কোম্পানির দ্বারা বিশেষ বিমার ব্যবসা করা যায় ৷ আর এতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রবণ এলাকাগুলির জন্য ভরতুকি দেওয়া প্রিমিয়ামের ব্যবস্থা করা হবে ৷

পথ দুর্ঘটনায় ক্ষতি বা মৃত্যুতে বিমার প্রয়োজনীয়তা

ভারত সরকারের জাতীয় সড়ক পরিবহণ মন্ত্রক কয়েক মাসের মধ্যেই সারা দেশে পথ দুর্ঘটনায় আহতদের জন্য নগদহীন বা ক্যাশলেস চিকিৎসা পরিষেবা ব্যবস্থা আরম্ভ করতে পারে ৷ বিশ্বে পথ দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর রেকর্ড রয়েছে ভারতের ৷ একটি সরকারি রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে পথ দুর্ঘটনার কারণে প্রতি ঘণ্টায় 19জনের মৃত্যু হয় ৷ 2022 সালে সারা দেশে পথ দুর্ঘটনার ফলে 4.61 লক্ষ সংখ্যক পথ দুর্ঘটনা ঘটেছে ৷ এতে 1.68 লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে ৷ এর পরিপ্রেক্ষিতে কমিটি জানাচ্ছে, ভারতের রাস্তায় বিশাল সংখ্যক গাড়ির কোনও বিমা করা নেই ৷ বিশেষত ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যবহৃত গাড়িগুলি ৷ এক্ষেত্রে পথ দুর্ঘটনা হলে গাড়ির মালিক এবং তৃতীয় পক্ষের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে ৷ ইনস্যুরেন্স ইনফরমেশন ব্যুরো অফ ইন্ডিয়া বা আইআইবি-র দেওয়া মোটর অ্যানুয়াল রিপোর্ট অনুযায়ী, 2020 সালের মার্চ মাসে ভারতের রাস্তাগুলিতে 25.33 কোটিরও বেশি যান চলাচল করেছে ৷ এর মধ্যে প্রায় 56 শতাংশের কোনও বিমা নেই ৷ বাণিজ্যিক গাড়িগুলির ফলে হওয়া পথ দুর্ঘটনায় বহু নিরপরাধ মানুষ প্রাণ হারায় ৷ দুর্ঘটনার পরে ক্ষতি হলে তার জন্য কোনও যথাযোগ্য বিমা নেই ৷ এই ক্ষেত্রে কমিটির প্রস্তাব, রাজ্যগুলির সর্বত্র ই-চালান কার্যকর করা হোক ৷ এই কার্যকর করার ক্ষেত্রে তথ্য সরবরাহের কাজটি করবে আইআইবি, এমপরিবহণ এবং ন্যাশনাল ইনফরমেটিক্স সেন্টার ৷ ইনস্যুরেন্স ইন্ডাস্ট্রিকে 40-50 হাজার কোটি টাকার প্রয়োজনীয় পুঁজি দিতে পারে রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া (আরবিআই) ৷ এর জন্য ভারত সরকারের তরফে আরবিআই বিমা ইন্ডাস্ট্রিকে বিভিন্ন ধরনের ম্যাচিওরিটির 'অন-ট্যাপ' বন্ড ইস্যু করতে পারে ৷ এই পিএসই-গুলির ব্যবস্থাপনাকে উদ্ভাবনী করে তুলতে, তাকে কার্যকর করতে, তার দক্ষতা বৃদ্ধি করতে এবং উন্নত প্রতিযোগিতার জন্য একটা যথাযথ কৌশলী রোডম্যাপ করা এখনই প্রয়োজন ৷ এর ফলে ওই পিএসইউ-গুলি যথেষ্ট পুঁজি জোগাড় করতে পাবে ৷

2022 সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি সমীক্ষা করে ৷ তাতে জানা গিয়েছে, বার্ষিক 55 মিলিয়ন বা 5 কোটি 50 লক্ষ ভারতীয় নিজের ক্ষমতার বাইরে গিয়ে স্বাস্থ্যের জন্য খরচ করতে পারেন না ৷ সরকারের দেওয়া আরেকটি তথ্য আরও দুঃখের৷ সেখান থেকে জানা গিয়েছে, 63 মিলিয়ন বা 6 কোটি 30 লক্ষেরও বেশি ভারতীয় শুধুমাত্র স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দের বাইরে থাকে ৷ বিমায় স্বাস্থ্য ভালো রাখা বা স্বাস্থ্য পরিষেবার পুরো খরচ না যুক্ত থাকলে তাতে মানুষের আর্থিক চাপ বেড়ে যায় ৷ তখন আউট অফ পকেট এক্সপেনডিচার বা ওওপিই অর্থাৎ নিজের আর্থিক ক্ষমতার বাইরে গিয়ে স্বাস্থ্যের জন্য খরচ করতে হয়৷ ভারত সরকার 2022 সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষায় স্বীকার করে নিয়েছে, ভারতে স্বাস্থ্যে ওওপিই খরচ 48.2 শতাংশ ৷ এই খরচ সরকারের স্বাস্থ্য খাতে খরচ 40.6 শতাংশের চেয়ে বেশি ৷ ভারতে এই ওওপিই সাধারণ অনেকটাই বেশি হয় ৷ সেরকমই বিশ্বের অর্থনৈতিক দিক দিয়ে দুর্বল দেশগুলির ক্ষেত্রেও ৷

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, উত্তরপ্রদেশে রোগীদের ওওপিই খরচ 71 শতাংশ ৷ তারপরেই রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ ও কেরল ৷ দু'টি রাজ্যের প্রতিটিতে এই খরচ 68 শতাংশ ৷ এতেই বোঝা যায় বিভিন্ন রাজ্যে স্বাস্থ্য পরিষেবায় খরচের বৈষম্য কীরকম ৷ এদিকে 2022-23 সালের একটি হিসেব জানাচ্ছে, দেশের মোট স্বাস্থ্য বিমার প্রিমিয়ামের দুই-তৃতীয়াংশ জোগায় পাঁচটি রাজ্য- মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, গুজরাত এবং দিল্লি ৷ আর বাকি রাজ্যগুলি মাত্র এক-তৃতীয়াংশ ৷ 2017 সালের ন্যাশনাল হেলথ পলিসি অনুযায়ী ভারত একটা সর্বজনীন লক্ষ্য পূরণের চেষ্টা করেছিল ৷ যেখানে প্রতিটি নাগরিকের স্বাস্থ্য বিমা থাকবে ৷ প্রত্যেকে উন্নত মানের স্বাস্থ্য পরিষেবা পাবে ৷ এর জন্য যা খরচ হবে, তা হাতের নাগালেই থাকবে ৷ কিন্তু তা হয়নি ৷ তাই এই ইস্যুগুলির সমাধান না করলে এই লক্ষ্য পূরণ হওয়া সম্ভব নয় ৷

আরও পড়ুন:

  1. 'বাংলা শস্য বিমা'র আওতায় ক্ষতিগ্রস্ত চাষীদের জন্য 197 কোটি টাকা বরাদ্দ নবান্নের
  2. সরষে থেকে তিল-সয়াবিন চাষে জোর, বদলে যেতে পারে দেশের কৃষি-মানচিত্র
  3. অন্তর্বর্তী বাজেটে করের ক্ষেত্রে কী ঘোষণা নির্মলার ? জানুন প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ করের হালহকিকত
ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.