হায়দরাবাদ, 4 এপ্রিল: লোকসভা ভোটের তারিখ যত এগিয়ে আসছে তত উত্তাপ বাড়ছে রাজনৈতিক ময়দানে । ভোটে জয়ী হওয়াই লক্ষ্য সবপক্ষের ৷ তাই সারা দেশের নেতারা কথার অস্ত্রে শান দিচ্ছেন ৷ সমালোচনা পালটা আক্রমণের পর্ব চলছে। কেউ কাউকে এক ইঞ্চি জমি ছাড়তে নারাজ ৷ এমন এক সময়ে যখন সমস্ত দল ও নেতারা জয়ের জন্য সব কিছু দিয়ে ভোট ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, তখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), ডিপফেক এবং ভয়েস ক্লোনিং প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে ।
প্রযুক্তি যত উন্নত হচ্ছে এর সঙ্গে তত ওঠানামা করছে লাভ ক্ষতির অংক। উন্নত প্রযুক্তির বিভিন্ন সরঞ্জামগুলির সাহায্য নিচ্ছে সাইবার অপরাধীরা ৷ তারা এর মাধ্যমে একজন ব্যক্তির চেহারা পরিবর্তন এবং শব্দ বদলে ছদ্মবেশ ধারণ করে জালিয়াতির নতুন নতুন পথ বের করছে ৷ যার ফলে ক্রমাগত হুমকির মুখে পড়ছে নাগরিক জীবন । ভোটারদের প্রভাবিত করার জন্য নির্বাচনেও এ ধরনের প্রযুক্তিগত কৌশল ব্যবহার করার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এটি একটি দলের পক্ষে/বিপক্ষে পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এগুলো সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যাহত করবে এবং জনগণের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করবে।
এখানকার পরিস্থিতি কয়েক বছর আগের মত আর নেই ৷ এখন অনেক সস্তায় পাওয়া যাচ্ছে এআই প্রযুক্তি। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, ডিপফেক দিয়ে সহজে মানুষকে বোকা বানানো যায় ৷ এখন ডিপফেক তৈরি করতে বড় কোম্পানির প্রয়োজন হয় না এবং এ বিষয়ে স্বল্প জ্ঞান রয়েছে এমন লোকেরা ল্যাপটপের সাহায্যে জালিয়াতি করতে পারে ৷ আমরা যে হুমকির আশংকা করছি ইতিমধ্যেই তার ট্রেলার দেখা গিয়েছে মধ্যপ্রদেশে ৷ সেখানে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান এবং কমলনাথের ফেক ভিডিয়োগুলি সোশাল মিডিয়া জুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল ৷
নির্বাচনে ডিপফেক প্রযুক্তির ব্যবহার
পাকিস্তান ও বাংলাদেশের নির্বাচনে সাইবার অপরাধীরা ডিপফেকের সাহায্য নিয়েছিল ৷ এর মাধ্যমে বিভিন্ন ভুলবার্তা ছড়িয়ে দিয়েছিল যা নাগরিকদের ভোটদানের আগ্রহকে নষ্ট করেছিল । বার্তায় লেখা হয়েছিল, ভোট দিতে আসবেন না । আমাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে । দুই দেশের ক্ষতিগ্রস্ত দলের নেতারা ভোটারদের কাছে আন্তরিক আবেদন করেছেন এবং তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছেন । কিন্তু ডিপফেক ইতিমধ্যেই তার কাজ করে ফেলেছে ।
বাংলাদেশে নির্বাচনের আগে প্রকাশ্যে এসেছে ডিপফেক ভিডিয়ো । এর মধ্যে বিরোধী দলের নেত্রী রুমিন ফারহানাকে বিকিনিতে এবং আরেক মহিলা নেত্রী নিপুণ রাইকে একটি সুইমিং পুলে দেখা গিয়েছে ।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে আমেরিকার নিউ হ্যাম্পশায়ারে প্রাথমিক নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কণ্ঠ অনুকরণ করে একটি ভুয়োবার্তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল । স্লোভাকিয়ায় এআই-এর সাহায্যে একজন প্রার্থীর কণ্ঠ নকল করা হয়েছিল । এই বার্তায় এই ব্যক্তি দাবি করেছিলেন, তিনি মদের দাম বাড়ানো এবং নির্বাচনে কারচুপির পরিকল্পনা করছেন ৷
ভুয়ো খবর ছড়াতে প্রযুক্তির ব্যবহার
ভারতে এখন সস্তায় মোবাইল ডেটা পাওয়া যায় ৷ স্মার্টফোনের ব্যবহার ব্যাপক বেড়েছে । এই অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, সোশাল মিডিয়ায় ডিপফেকগুলি দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ভোটারদের ক্ষোভ বাড়াতে পারে । ভোট দিলেও তা বৃথা যাবে বলে জনগণকে বিশ্বাস করানোর ঝুঁকি রয়েই যাচ্ছে । এআই দ্বারা তৈরি ভুয়ো খবর নির্বাচনী প্রক্রিয়া এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা নষ্ট করতে পারে ৷
2020 সালে বিজেপি নেতা মনোজ তিওয়ারি দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে হরিয়ানভি উপভাষায় ডাব করা একটি এআই-ভিত্তিক ভিডিয়ো বার্তা প্রকাশ করেছিলেন । তাতে বক্তৃতার সঙ্গে মনোজের ঠোঁট নড়াচড়ার মিল করাতে দেড় দিন সময় লেগেছিল । যদিও সেই ভয়েসটি প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি করা হয়নি একজন মিমিক্রি শিল্পীকে দিয়ে ডাব করানো হয়েছিল । কিন্তু এখন প্রযুক্তি বদলেছে । লিপ-সিঙ্কিং প্রযুক্তির পাশাপাশি ভয়েস ট্রেনিং মডিউল এসেছে । এগুলোর সাহায্যে ব্যক্তি যেভাবে কথা বলছে সেভাবে লিপ-সিঙ্ক করে দ্রুত ভিডিয়ো তৈরি করা যায় । অনেক দেশের ভারতের নির্বাচনে আগ্রহ রয়েছে ৷ এই আগ্রহ এআইয়ের ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরও হুমকির কারণ হতে পারে ।
ভালোর জন্য এআই ব্যবহার
নির্বাচনে ভালো কাজেও এআই ব্যবহার করা যেতে পারে । আকর্ষণীয় উদ্ভাবন হল ভোটারদের কাছে 'পার্সোনালাইজড ইন্টারেক্টিভ ফোন কল'। এই ধরনের ওয়ান-টু-ওয়ান কল ব্যবস্থা ভারতে এখনও বাস্তবায়িত হয়নি । তবে প্রার্থীর কণ্ঠস্বর-সহ আগে রেকর্ড করা বার্তাগুলি পৃথক ভোটারদের নাম উল্লেখ করে রাজস্থানে কংগ্রেস এবং দিল্লিতে আম আদমি পার্টি ব্যবহার করেছিল ।
সময়ে সময়ে একজন নেতার বক্তৃতা অন্য ভাষায় অনুবাদ করতেও এআই ব্যবহার করা যেতে পারে, যেমন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দিতে কণ্ঠস্বর স্বয়ংক্রিয়ভাবে মাইক্রোসফটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসের জন্য ইংরেজিতে রূপান্তরিত হয়েছিল ৷ তাদের সাম্প্রতিক বৈঠকের কথোপকথনে এটি করা হয় ।
এআই নিয়ে সরকার ও নিবার্চন কমিশনের পদক্ষেপ
নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যে ভুয়ো খবর এবং ভুল তথ্য সনাক্ত করতে ও দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানাতে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর জারি করেছে । ভারতীয় সাইবার ক্রাইম কোঅর্ডিনেশন সেন্টারকে (I4সি) নির্বাচনের সময় এআই দ্বারা সৃষ্ট হুমকি মোকাবিলা করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার নোডাল এজেন্সি হিসাবে নিযুক্ত করেছে । এর উদ্দেশ্য অনলাইনে আপত্তিকর বিষয়বস্তু গুলি সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলি থেকে সরিয়ে ফেলা ।
রাজ্য পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটগুলিও ভুয়ো খবর এবং আপত্তিকর বিষয়বস্তু সনাক্ত করতে অনলাইনে ক্রমাগত নজরদারি চালাচ্ছে । নির্বাচন কমিশনের আধিকারিকরা বলছেন, "দ্রুত ব্যবস্থা নিতে সব জেলায় সাইবার সেলের সঙ্গে সমন্বয় করে সোশাল মিডিয়া সেল গঠন করা হয়েছে । নির্বাচন কমিশনের 'মিডিয়া সার্টিফিকেশন অ্যান্ড মনিটরিং কমিটি'ও সোশাল মিডিয়া নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে ।"
আরও পড়ুন: