প্রাচীন সময় থেকে ভারতে একাধিক সমস্যার সেরা চিকিৎসা হোম রেমেডি তথা বাড়িতে প্রাপ্ত জিনিস দিয়ে আরোগ্য লাভের উপায় । পেটেব্যথা, বদহজম, সর্দি—কাশি, মাথাব্যথা, বমিভাব প্রভৃতির নিরসনে আপনার দাদু-দিদা কিংবা অভিভাবকরা হয়তো প্রায়ই আপনাকে বাড়ির রান্নাঘরে প্রাপ্ত জিনিসপত্র ব্যবহার করতেন । তবে বিশেষ করে এই বছর, অর্থাৎ 2020 সালে গোটা পৃথিবী যখন লকডাউনের আওতায় ছিল কোভিড-19 প্যানডেমিকের জন্য, সবচেয়ে বেশি আরোগ্যলাভের উপায় হিসাবে কাজে এসেছে এই হোম রেমেডিগুলিই, যা প্রতিটি ভারতীয় ঘরে সুপরিচিত এবং সহজলভ্য । সুতরাং, চলুন দেখে নেওয়া যাক, এই বছরের কিছু সবচেয়ে ‘কমন’ সমস্যা এবং রান্নাঘরের প্রাপ্ত উপাদান দিয়ে তার সমাধানের প্রক্রিয়া।
সুপরিচিত উপাদানসমূহ:
1. আদা (অদ্রক)-আদা সবসময়ই ভারতীয় রান্নাঘরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে সমাদৃত হয়ে এসেছে এর অ্যান্টিভাইরাল এবং অ্যান্টিব্যাকটিরিয়াল গুণাগুণের জন্য । আদা শরীরের ইমিউনিটি বাড়াতে কাজে লাগে এবং এটি নানা ধরনের সংক্রমণও দূর করে । আদা শুকিয়ে গুঁড়ো করে, তার এক চামচ গরম জলে মিশিয়ে পান করুন । এটি হজমের ক্ষমতা বাড়ায় এবং পেট ফাঁপা কমায়। আদা গ্রেট করে জলে ফুটিয়ে নিন । এবার এর মধে্য মধু মেশান এবং মিশ্রণটি পান করুন । জ্বর, সর্দি-কাশি দূর হয়ে যাবে । এর মধে্য কয়েক ফোঁটা লেবুর রস যোগ করলে তো এটা আরও বেশি উপকারি হবে । আদার রসে গুড় মিশিয়ে খেলে ত্বকের অ্যালার্জি দূর হবে ।
চার কাপ জল একটি পাত্রে নিন আর তাতে তাজা গ্রেট করা দুই টেবিলচামচ আদা নিন । তারপর ততক্ষণ জল ফোটান যতক্ষণ না সেটি ফুটে ফুটে অর্ধেক হয়ে পড়ছে । এবার জলটা ছেঁকে নিন একটা কাপে আর তাতে 1 টেবিলচামচ মধু যোগ করুন । এটা ঠান্ডা হতে দিন যাতে ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় চলে আসে । তারপর পান করুন । এতে পিঠের ব্যথা কমবে । আদার রসের সঙ্গে মধু মিশিয়ে খেলে শুকনো কাশির সমস্যা দূর হবে ।
2. তুলসি (বেসিল)- মানুষ সাধারণত তুলসিকে সঞ্জীবনী ওষুধের সঙ্গে তুলনা করেন কারণ এর ঔষধি গুণাগুণ প্রচুর । তুলসি পাতাকে অ্যান্টিবায়োটিকের সমতুল বলে গণ্য করা হয়। মরসুমি জ্বর লাঘব করতে এক চামচ আদা আর এক মুঠো তুলসি পাতা জলে ফুটিয়ে নিন, যতক্ষণ না জল ফুটে ফুটে অর্ধেক হয়ে যায়। এই মিশ্রণের মধে্য মধু যোগ করতেও পারেন, আপনার স্বাদমতো । পিঠের ব্যথা দূর করার জন্য, পাত্রে এক কাপ জল ঢালুন আর তাতে 8 থেকে10 টি তাজা তুলসি পাতা ফেলে দিন । এবার সেটা ফুটিয়ে নিন যতক্ষণ না জল ফুটে অর্ধেক হয়ে যায় । এবার সেই জলটা ছেঁকে নিন । সেটা ঠান্ডা করে নিন, যাতে তা ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় চলে আসে । এবার স্বাদমতো নুন তাতে যোগ করুন এবং পান করুন । রোজ সকালে 5 থেকে 8টি তুলসি পাতা চবিয়ে খান । এতে শুকনো কাশির সমস্যা কমবে।
3. রসুন (লেহসুন)- রসুনের অ্যান্টি ব্যাকটিরিয়াল এবং অ্যান্টি ভাইরাল গুণাগুণ স্বাভাবিকভাবেই অনেক রোগজ্বালা এবং উপসর্গ লাঘব করে । শুকনো কাশির সমস্যা দূর করতে এক কাপ জলে 2 থেকে 3 রসুনের কোয়া ফেলে, জল ফুটিয়ে নিন । এতে মধু যোগ করুন । জল ঈষদুষ্ণ হলে সেটি পান করুন । মরসুমি জ্বরের সমস্যার সমাধানে কাজে আসে রসুনে থাকা ডায়ালিল সালফাইড । এটি শরীরের বেড়ে যাওয়া তাপমাত্রা কমায় । গরম জলে থেঁতো করা রসুন যোগ করুন এবং 10 মিনিট পর জলটা খেয়ে নিন । পিঠের ব্যথায় ম্যাসাজ করতে, একটি পাত্রে 4 থেকে 5 টেবিলচামচ নারকেল তেল নিয়ে তাতে খোসা ছাড়ানো রসুনের 6টি কোয়া ফেলে দিন । এবার রসুনটিকে ভেজে নিন যতক্ষণ না সেটির রং গাঢ় বাদামি হচ্ছে । এবার এটা ঠান্ডা করে নিন এবং যেখানে ব্যথা, সেখানে তেলটা ম্যাসাজ করুন । এছাড়াও বহু মানুষ আরও কিছু উপাদানেরও গুণাগুণ আবিষ্কার করেছেন, যেমন:
1. মেথি দানা পিত্তের রোগ- ডায়াবিটিস দূরীকরণ, সৌন্দর্য-বর্ধক, রক্তচাপের সমস্যা নিরসন এবং ওজন হ্রাসে সাহায্য করে।
2. হিং সেবন স্নায়ুতন্ত্র, শ্বাসযন্ত্র, সংবহন তন্ত্র, পরিপাক তন্ত্র, রেচন তন্ত্র এবং জননতন্ত্রের জন্য ভাল ।
3. অ্যাপেল সিডার ভিনিগার ডায়াবিটিস-স্থূলতার সমস্যা রোধে, হার্টের স্বাস্থ্য ভাল রাখতে, ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস-ডায়ারিয়া-সাইনাসের সমস্যা সমাধানে এবং ত্বক আর নখের যত্নে সহায়ক ।
4. কারি পাতা পরিপাকগত সমস্যা, মর্নিং সিকনেস, বমি-বমি ভাব, ডায়াবিটিস নিয়ন্ত্রণে, চোখের স্বাস্থ্য ভাল রাখতে, স্থূলতা হ্রাসে, ক্ষত-পোড়া নিরাময় এবং চুলপড়ার সমস্যা সমাধানে কাজে লাগে। কিছু সাধারণ শর্ত কোভিড-১৯ এবং ইমিউনিটি বৃদ্ধি মেডিকেল এবং সরকারি কর্তৃপক্ষ ইমিউনিটি বৃদ্ধির উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন বিশেষ করে তাদের জন্য, যারা কোমরবিড রোগব্যধিতে ভুগছেন এবং যারা ইমিউনো-সাপ্রিসেন্ট, যাতে তাদের কোভিড-19 এর গুরুতর প্রভাব থেকে রক্ষা করা যায় । রান্নাঘরে এমন অনেক মশলাপাতি এবং ঔষধি গাছগাছড়া মেলে, যা এই ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে।-সারা দিনে উষ্ণ জল পান করুন । আয়ুষের সুপারিশ করা কাঢ়া (হার্বাল টি) যা তুলসি, দালচিনি, কালিমির্চ অর্থাৎ কালো মরিচ, শুণ্ঠি (শুকনো আদা) এবং মুনাক্কা (কিশমিশ) দিয়ে তৈরি করা হবে, সেটি খেতে হবে দিনে দু’বার। এর সঙ্গে গুড় (স্বাভাবিক চিনি) অথবা তাজা লেবুর রস নিজের স্বাদমতো যোগ করা যেতে পারে, তবে প্রয়োজন অনুসারে।
রসুনে থাকা ‘অ্যালিসিন’ এর প্রধান সক্রিয় উপাদান যা দেহের অভ্যন্তরীণ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে । কাঁচা রসুন খেলে শরীরের ইমিউনিটি বাড়ে । হলুদ দুধ তথা গোল্ডেন মিল্ক হল ইমিউনিটি বাড়ানোর জন্য সেরা । 150 মিলিলিটার গরম দুধে অর্ধেক চা-চামচ হলুদ গুঁড়ো যোগ করুন এবং দিনে এক বা দু’বার সেই দুধ খান । বদহজম এবং পেটফাঁপা বাড়িতে অধিকাংশ সময় থেকেও, একাধিক অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের ফলে পেটের ব্যথা, পেট ফাঁরা এবং বদহজমের সমস্যা দেখা দিতে পারে । সেই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে নিচের কিছু রেমেডি অনেকেই পরীক্ষা করে দেখেছেন । ভোরে উঠে 2 টেবিলচামচ মেথি সেবন করুন। এটা পেটের সমস্য দূর করবে।1 টেবিলচামচ ব্ল্যাকসল্টের সঙ্গে 1 টেবিলচামচ জিরে নিয়ে গুঁড়ো করে নিন । এটা এক গ্লাস জলে মেশান এবং খাবার খাওয়ার পর তা খেয়ে নিন ।
5 গ্রাম লবঙ্গের সঙ্গে 10 গ্রাম মৌরি, 10 গ্রাম জোয়ান, 10 গ্রাম জিরে, 5 গ্রাম ব্ল্যাক সল্ট নিয়ে গুঁড়ো করে নিন । এই মিশ্রণের অর্ধেক টেবিলচামচ নিয়ে খাবার খাওয়ার 1 ঘণ্টা পর খেয়ে নিন । এতে গ্যাসের সমস্যা মিটবে । এক গ্লাস গরম জলে 1 টেবিলচামচ আদার রস মেশান । এতে স্বাদমতো 2 বা 3 টেবিলচামচ মধু মিশিয়ে নিন এবং পান করে ফেলুন। সুতরাং, এবছর বাড়িতেই ছোটখাটো স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধান করার উপায় মানুষ পেয়ে গিয়েছে এবং তা করতে গিয়ে রাসায়নিক ভাবে প্রস্তুত ওষুধপত্র সেবন থেকে বিরত থেকেছে, বিশেষ করে তখন, যখন লকডাউনের জন্য তা অমিল ছিল । বেশিরভাগ রাসায়নিক উপায়ে প্রস্তুত ওষুধপত্রেই কিছু না কিছু পাশ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে । কিন্তু অধিকাংশ হোম রেমেডিতেই কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে না বা থাকলেও নগণ্য থাকে । এই কারণেই ছোটখাটো স্বাস্থ্য সমস্যা মেটাতে এগুলি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে । যদিও সবসময়ই এই পরামর্শ দেওয়া হয় যে যদি কোনও শারীরিক সমস্যার সমাধান দীর্ঘসময় ধরে না হয়ে থাকে অথবা আপনি এমন কোনও রোগে আক্রান্ত, যার জন্য নির্দিষ্ট কোনও ডায়েট মেনে চলা প্রয়োজন বা কিছু নির্দিষ্ট খাবার এড়িয়ে চলা প্রয়োজন, সেক্ষেত্রে অতি অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে ।