প্রায় ছ’বছর আগে, সুপ্রিম কোর্ট তথ্যপ্রযুক্তি আইনের 66এ ধারাটিকে খারিজ করে দিয়ে বলেছিল যে, এটা অতিরিক্ত এবং মাত্রাহীনভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে । আইনটি খারিজ করতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্ট বাকস্বাধীনতার মৌলিক অধিকারের ওপরেই রোজ দিয়েছিল । যদিও আদালত কয়েক জায়গায় নিয়ন্ত্রণ সহ তথ্যপ্রযুক্তি আইনের 69এ এবং 79 ধারা বহাল রাখায় অনুমতি দিয়েছে ।
সেপ্টেম্বরে একটি বিতর্কিত টিভি-অনুষ্ঠান সংক্রান্ত মামলা চলাকালীন কেন্দ্র সরকার আক্ষেপ করে বলেছিল যে, ডিজিটাল মাধ্যম সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে এবং মিডিয়াকে প্রথমেই নিয়ন্ত্রণ করা উচিত । দু’সপ্তাহ আগে সরকার সেই অনুযায়ী পদক্ষেপও নিয়েছে । তথ্যপ্রযুক্তি আইনের 69ও ধারার আওতায় নিয়মাবলী আরও কঠোর করা হয়েছে । ‘মুক্ত গণমাধ্যম’-কে নিয়ন্ত্রণ করার নামে সরকার মিডিয়ার ওপর নজরদারি এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে শিকল পরাতে চেয়েছে ।
সরকারের পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায় এডিটর্স গিল্ড অফ ইন্ডিয়া জানিয়েছে, যে 69এ ধারার আওতায় নতুন নিয়মাবলী ডিজিটাল মিডিয়াকে মূলগতভাবে বদলে দেওয়ার পাশাপাশি অযৌক্তিক নিয়ন্ত্রণ আনবে । এই নিয়মাবলী প্রত্যাহার করতে সরকারের কাছে আবেদনও করা হয়েছে ।
আরও পড়ুন :সোশাল মিডিয়া, ডিজিটাল প্ল্য়াটফর্মে নজরদারি; নয়া নির্দেশিকা কেন্দ্রের
যদিও কেন্দ্র বলছে যে, এইসব নিয়মকানুন কার্যকর করার ক্ষমতা একমাত্র তারই রয়েছে । সঠিক পদক্ষেপ হল সেইসব অগণতান্ত্রিক নিয়ম প্রত্যাহার করা, যা ডিজিটাল মিডিয়াকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনে এবং তাকে তরোয়াল দিয়ে তৈরি খাঁচার মধ্যে ভরে রাখতে চায় ।
যে দলেরই হোক না কেন, সরকারগুলো সবসময় চেয়েছে সেইসব মিডিয়া প্ল্যাটফর্মকে দাবিয়ে রাখতে, যারা সত্যি কথাগুলো নির্ভীকভাবে প্রচার করে । প্রায় 12 বছর আগে ইউপিএ সরকার বৈদ্যুতিন মিডিয়ায় কনটেন্ট কোড চাপাতে গিয়ে ধাক্কা খেয়েছিল ।
ডিজিটাল মিডিয়ার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে তাদের হলফনামায় বর্তমান কেন্দ্র সরকার বলেছে, “ঘৃণার বিষ, ইচ্ছাকৃতভাবে উসকানি শুধু হিংসা নয়, সন্ত্রাসবাদেরও জন্ম দেয় । ডিজিটাল মিডিয়া কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তিকেও বিকৃত করতে সক্ষম ।” কোনও স্তরে কারও সঙ্গে কথা না বলেই সরকার ডিজিটাল মিডিয়ার জন্য আচরণবিধি তৈরি করে ফেলেছে । তথ্যপ্রযুক্তি (মধ্যবর্তী নির্দেশিকা এবং এথিক্স কোড) নিয়ম 2021-এ ডিজিটাল মিডিয়ার ওপর ত্রিস্তরীয় নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছে ।
সবার ওপরে থাকবে একটি সরকারি কমিটি, যেখানে বিভিন্ন মন্ত্রকের প্রতিনিধিরা থাকবেন । এই কমিটি যখন তার সর্বময় ক্ষমতা প্রয়োগ করবে, তখন ডিজিটাল মিডিয়াকে সাপের ছায়ায় বসে থাকা ব্যাঙের মতো হয়ে টিকে থাকতে হবে ।
ডিজিটাল মিডিয়া হল একটি ভবিষ্যতমুখী প্ল্যাটফর্ম, যা দেশের তরুণ প্রজন্মের ভাবনা ও মতামতের প্রতিনিধিত্ব করে । এমন মাধ্যম যদি সরকারি নিয়ন্ত্রণের আওতায় চলে যায়, তার থেকে মারাত্মক কিই বা হতে পারে? বহু দশক ধরে দেশের সংবাদমাধ্যম সংবিধানে বর্ণিত মতপ্রকাশের স্বাধীনতার গণ্ডির মধ্যে থেকে কাজ করছে । ইন্টারনেট ভিত্তিক সংবাদমাধ্যমের ওপর এই সাম্প্রতিক নিয়ন্ত্রণ দেশের বৃহত্তর স্বার্থের পরিপন্থী । আগে থেকেই বহু আইন রয়েছে, যা দুষ্কৃতীদের ইন্টারনেটের মাধ্যমে অপকর্ম আটকাতে পারে । ডিজিটাল মিডিয়ার বিরুদ্ধে সরকারের একপেশে আচরণকে অবাঞ্ছিতই বলা যায় ।
আইনজগতের বিশিষ্টরাই যখন বলছেন যে এই নতুন নিয়মগুলো অসাংবিধানিক, তখন কেন্দ্রের উচিত এখান থেকে পিছিয়ে আসা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা করা ।