খড়দহ, 18 জুলাই : পরিবর্তনে অভ্যস্ত হওয়াতেই লুকিয়ে জীবন যুদ্ধ জয়ের রসায়ন । কোরোনা প্যানডেমিক কবলিত জীবনে নতুন থিম সং মেনে এখন আমরা সবাই লড়াইয়ের ময়দানে । তাই পেশা বদলের গল্প এখন গা সওয়া । তবে মঞ্চের শিল্পী যখন বাস্তবের রঙ্গমঞ্চে নতুন চরিত্রে অবতীর্ণ হন, তখন বলতেই সব চরিত্র কাল্পনিক নয় ।
খড়দহ স্টেশন থেকে পূর্বদিক দিয়ে বেরিয়ে ডান হাতের লম্বা রাস্তা ধরে হাঁটলে আপনি পৌঁছে যাবেন শান্তিনগর শতদল পল্লিতে । খড়দহের একটি পরিচয় যদি রহড়া রামকৃষ্ণ মিশনের উজ্বল উপস্থিতি হয়, তাহলে এই অঞ্চলের লড়াকু ছবি খড়দহের আরও একটি দিক । যেখানে আপনি জীবন জীবিকার লড়াইয়ে ব্যস্ত থাকা মানুষের খোঁজ পাবেন । এমনই একজন তপন দাস ।
46 বছর বয়সের মানুষটি পেশা এবং নেশায় নাট্যকর্মী । কিন্তু, নিউ নর্মাল লাইফে স্ট্যান্স বদলে তিনিই এখন মাছ বিক্রেতা । স্থানীয় এলাকায় পেটের টানে সকাল হলেই রাস্তার ধারে প্লাস্টিক এবং কলাপতা বিছিয়ে মাছ বিক্রি করতে বসে পড়ছেন ।
রয়্যাল শেক্সপিয়র কম্পানির হয়ে টিম সাপলের পরিচালনায় "অ্যা মিডসামার নাইটস ড্রিম" নাটকের অভিনয়ের জন্য দুনিয়া ঘুরে বেড়িয়েছেন তপন দাস । বর্তমানে খড়দহ থিয়েটার জ়োন নাট্যদল নিয়ে নাটকের চর্চা করে চলেছেন । সেই কারণে স্বাভাবিক সময়ে রাজ্য এবং দেশের বিভিন্ন জায়গায় শো করে বেড়ান । নিজের দলের নতুন নাটক মেলে ধরাই লক্ষ্য । নাটক নিয়ে তাঁর এই ছটফটানি এখন কোরোনা ভাইরাসের প্রকোপে স্তব্ধ । তবে সৃষ্টিশীল মানুষ প্রতিকূলতার মধ্যেও প্রকাশিত হওয়ার চেষ্টা করেন । তাই অনলাইনে অন্যভাবে নাটক তুলে ধরার চেষ্টা করছেন তপনবাবু ।
মঞ্চের সামনে অন্ধকারে থাকা কালো কালো মাথাগুলো যে কোনও মঞ্চ অভিনেতার কাছে অনুপ্রেরণা । কিন্তু, এখন সেসব অতীত । অন্ধকার গ্রাস করেছে মঞ্চকে । ফলে রং মাখা মুখগুলো বাস্তবের রঙ্গমঞ্চে জীবন বাঁচাতে দিশেহারা । রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছেন । নতুনভাবে জীবনের অর্থ বুঝতে হচ্ছে ।
প্রতিকুলতার মধ্যেই আশার আলো । তাই নিজের পরিবার ও দলের বাকি সদস্যদের বাঁচাতে পথে নামতে দ্বিধা করেননি তপন দাস । ‘‘নাট্যমঞ্চে অভিনয় আমার এক রকম ট্যালেন্ট । আবার নতুনভাবে আবিষ্কার করে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা ট্যালেন্টের আর একটি দিক ৷ জীবনের এই পর্বে নতুন ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়েছে, কিন্তু কোনও আক্ষেপ নেই । আমি যখন এই পদক্ষেপের কথা আমার শুভানুধ্যায়ীদের সামনে বলেছিলাম, তখন অনেকেই অবাক হয়েছিল । আমি পিছিয়ে যায়নি । বরং চ্যালেঞ্জ উপভোগ করছি,’’ মাছ বিক্রি করতে করতে বলছিলেন খড়দহ থিয়েটার জ়োনের কর্ণধার ।
একাধিক প্রশংসিত নাট্য প্রযোজনার পরেও ভোররাতে গাড়ি ভাড়া করে নৈহাটির আড়ত থেকে মাছ কিনতে যাচ্ছেন তপন দাস । তার ফিরে আসার আগে ছেলে সাগর দোকান সাজিয়ে রাখে । 1990 সালে প্রবীর দাসের অল্টারনেটিভ লিভিং থিয়েটারে যোগদানের মধ্যে দিয়ে তপন দাসের নাট্যচর্চার শুরু । সাইকো ফিজ়িক্যাল থিয়েটারে বিশেষজ্ঞ তপন দাস মার্শাল আর্টেও হাত পাকিয়েছেন । শুধু মঞ্চ নয়, তথ্যচিত্র এবং বাপ্পাদিত্য বন্দোপাধ্যায়ের কাগজের বউ ছায়াছবিতেও অভিনয় করেছেন ।
বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, জাপান, হংকং, থাইল্যান্ড, অ্যামেরিকা, ইংল্যান্ড, কানাডা, ইট্যালিতে কাজ করে আসা মানুষটি লকডাউনের প্রথম প্রহরেই বুঝতে পেরেছিলেন স্ট্যান্স বদলের প্রয়োজনীয়তা । বললেন, ‘‘মাছ কাটার খুঁটিনাটি আমাকে শিখতে হয়েছে । মাছওয়ালাদের কাছ থেকে দেখে মাছ কাটা শিখেছি । কাজ করতে গিয়ে হাত কেটেছে । পিছিয়ে যাইনি । বিকল্প আয়ের এটাই আমার কাছে একমাত্র সহজ পথ ছিল,’’ বলছিলেন তপন দাস । প্রায় একই সঙ্গে যোগ করলেন, ‘‘এই পর্বটা আমাকে আর একটা শিক্ষা দিল । তাই বিকল্প আয়ের উপায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও ছাড়ব না ।’’
দিনে 50 কেজি মাছ নিয়ে এসে হাজার থেকে 1200 টাকা নিয়ে ঘরে ফেরেন তপন দাস । তবে নিজের বিকল্প উপায়ে আত্মতুষ্ট হননি । বরং কঠিন সময়ে দুরবস্থায় পড়া সতীর্থদের আর্থিক সাহায্য করছেন ।
এক লাখ থিয়েটার কর্মীদের মধ্যে থেকে প্রতিযোগিতায় লড়াই করে রয়্যাল শেক্সপিয়র কম্পানির সঙ্গে একসময় কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন তপন দাস । একাধিক চরিত্রে অভিনয়ের মুন্সিয়ানা সেখান থেকেই আয়ত্ত করেছেন । মঞ্চের মুন্সিয়ানা জীবনের রঙ্গমঞ্চে নতুন চরিত্রে মানিয়ে নিতে উদ্বুদ্ধ করছে । তবে কোরোনা পরিস্থিতি তপন দাসকে থামিয়ে রাখতে পারেনি । বর্তমানে চিত্রনাট্য লিখে তা কুশীলবদের দিয়ে অনলাইনে অন্যভাবে অভিনয় করিয়ে থিয়েটারওয়ালা এখন নতুন প্রযোজনার খোঁজে ।