অশোকনগর, 14 জুন : পুঁথিগত বিদ্যা বিশেষ তাঁর নেই । কারও পাকা হাতের তালিমও তিনি কখনও পাননি। তবু ছেলেবেলা থেকে রং-তুলির মায়ায় জড়িয়ে পড়েছিলেন । চাল-ডালের উপর আঁকা অনুচিত্রে তারিফ কুড়িয়েছেন । শিল্পের জাদুতে চোখে তাঁর বিশ্বজয়ের স্বপ্ন। গিনেস রেকর্ডের হাতছানি বুকে নিয়ে আজও ক্যানভাসের মায়াজালে ডুবে আছেন অশোকনগরের বাসুদেব পাল।
উত্তর 24 পরগনার অশোকনগর থানার কচুয়া-ঘোষপাড়া । বাসুদেবের ঠিকানা । বয়স 43 । ঘরে সঙ্গী স্ত্রী সীমা ও 14 বছরের ছেলে শুভদীপ । ছোট্ট এক কামরার ঘর । বাসুদেব যেন সেই জীর্ণঘরে বাদশা জাহাঙ্গির । সীমা নুরজাহান । হররোজ চাঁদনি রাতে বাসুদেবের চোখে কত স্বপ্ন ভাসে ! গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড থেকে ডাক আসবে । একদিন, দু'দিন, তিনদিন। কিন্তু, ডাক আসে না । বাসুদেবের রং-তুলি তবু অবিচল । ঝাপসা চোখে কত আঁকিবুঁকি । কোন সে ছেলেবেলায় বাবা মারা গিয়েছিলেন । অভাবের সংসারে লেখাপড়া বিশেষ হল না । মাধ্যমিকের গণ্ডী পার হওয়ার আগেই কাঁধে তুলে নিতে হল সংসারের জোয়াল । দিনমজুরি-এটা-ওটা-সেটা । পেটের দায়ে নানা কাজ । দাদা গোপাল পাল দারুণ ছবি আঁকতেন । বাসুদেবের মনেও রং লাগল । দাদার রং-তুলি নিয়ে ছবি আঁকার চেষ্টা করলেন । পিঠ চাপড়ে সেদিন দাদাই বলেছিলেন, "সাবাশ, চালিয়ে যা।"
সেই শুরু । তারপর জীবনের অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজও সচল বাসুদেবের শিল্পসাধনা । ঘরানা বদলে তিনি আজ মহল্লায় অনুচিত্র শিল্পী হিসেবে পরিচিত । চালের উপরে এঁকেছেন রবি ঠাকুর, মাদার টেরেসা, শ্রীরামকৃষ্ণ, সারদা মা, বিবেকানন্দের ছবি । মুসুর বা মটরের ডালের উপর নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ছবি । খালি চোখে অবশ্য দেখা যায় না । আতস কাচ ধরলেই জ্বলজ্বল করে । আরও আণুবীক্ষণিক ছবি তিনি এঁকেছেন । চুলের উপর লিখেছেন দেশের নাম ।
বাসুদেবের অনুচিত্র বিভিন্ন প্রদর্শনীতে যায় । শিল্পরসিকদের তারিফও কুড়োয় । কিন্তু পেট ভরে কি? ভরে না। বাসুদেব রুটিরুজির তাগিদে বাড়িতে ছাপার কাজ করেন। স্ত্রী সীমা তাতে সহযোগিতা করেন। আপনি এত ভালো ছবি আঁকেন। কোনও সরকারি স্বীকৃতি পেয়েছেন কি? জবাবে তিনি বলেন, ''সে অনেক কথা। রাজ্যের বিভিন্ন প্রদর্শনীতে আমার ছবি যায়। অসমেও গিয়েছে । বিভিন্ন জায়গা থেকে শংসাপত্রও পয়েছি ৷ কিছুদিন আগে ইন্ডিয়ান বুক অফ রেকর্ডসে আমার নাম উঠেছে ৷ "
প্রত্যয়ী বাসুদেব বলেন, "আমি হাল ছাড়িনি । গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড কর্তৃপক্ষকে দু'বার চিঠি লিখেছি । জবাব আসেনি । আমি জানি একদিন না একদিন আমি লক্ষ্যে পৌঁছবই । আজ না হলে কাল । কাল না হলে পরশু । আলোর দেখা মিলবেই ।"
স্বামী ছবি আঁকেন। ঘরে সুখের আলো জ্বলেনি। স্ত্রী সীমার মাঝেমাঝে খুব মন খারাপ হয়। তবু তিনিও স্বামীর সঙ্গে গিনেস জয়ের স্বপ্নের জাল বোনেন। সীমা বলেন, "প্রথম দিকে আমার খুব রাগ হত । সংসারই যদি আলোয় না ভরল, ছবি এঁকে কী হবে ? অনেক পরে বুঝেছি, রং-তুলিতেই ওর প্রাণ । আমার বিশ্বাস, একদিন ও অনেক বড় শিল্পী হবে । অনেক বড় ।"
নিশুত রাতে অশোকনগরের ঝিলপাড়ে ঝিঁঝিঁপোকার বিরামহীন ডাক । আলো নিভে গিয়েছে শহর-বন্দর-রেল স্টেশনে । নির্জন বারান্দায় শিল্পীর তুলির ডগায় রং । চোখে কোণে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন । বাসুদেব যেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়য়ের 'শিল্পী' গল্পের মদন তাঁতি । সীমা তাঁর বউ । শূন্য তাঁতঘরে মদনের মতো এক চিলতে আলো খোঁজেন বাসুদেব । চাঁদ সাড়া দেয় না ।