কাঁথি, 9 জুলাই : তিন বছর আগের একটি অস্বাভাবিক মৃত্য়ুর ঘটনায় নাম জড়াল রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর (Suvendu Adhikari) ৷ মৃতের স্ত্রীর করা অভিযোগপত্রে নাম রয়েছে তাঁর ৷ সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে আরও তিন ব্যক্তির ভূমিকা নিয়ে ৷ যাঁদের মধ্যে অন্যতম রাখাল বেরা (Rakhal Bera) ৷ প্রতারণা সংক্রান্ত অন্য একটি মামলায় যাঁকে আগেই গ্রেফতার করা হয়েছে ৷ সূত্রের খবর, এই রাখাল বেরা নাকি শুভেন্দু অধিকারীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ৷ বিষয়টি নিয়ে আসরে নেমেছেন তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষও (Kunal Ghosh) ৷ শুক্রবার সকালে বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষকে (Dilip Ghosh) ট্যাগ করে টুইটারে (Twitter) একটি পোস্ট করেছেন তিনি ৷ তাতে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকা নিয়ে কটাক্ষ যেমন রয়েছে, তেমনই জানতে চাওয়া হয়েছে রাখাল বেরার পরিচয়ও ৷
আরও পড়ুন : দিল্লিকে ভুল বোঝানো বিরোধী দলনেতাকে আয়নায় মুখ দেখার পরামর্শ সৌমিত্রর
গত বুধবার (7 জুলাই, 2021) পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন সুপর্ণা কাঞ্জিলাল চক্রবর্তী নামে এক মহিলা ৷ তাঁর স্বামীর নাম শুভব্রত চক্রবর্তী ৷ 2018 সালের 14 অক্টোবর কলকাতার অ্য়াপোলো হাসপাতালে মৃত্য়ু হয় শুভব্রতর ৷ সুপার্ণা তাঁর অভিযোগপত্রে জানিয়েছেন, মৃত্য়ুর ঠিক একদিন আগে অর্থাৎ 2018 সালে 13 অক্টোবর গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন শুভব্রত ৷ রাজ্য পুলিশের কর্মী শুভব্রত তাঁর জীবনের শেষ 6-7 বছর শুভেন্দু অধিকারীর দেহরক্ষী হিসাবে কর্মরত ছিলেন ৷
সুপর্ণার দাবি, তাঁদের বিবাহিত জীবনে কোনও অশান্তি ছিল না ৷ তাঁদের দু’টি মেয়েও রয়েছে ৷ স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে সুখী ছিলেন শুভব্রত ৷ তবে কর্মসূত্রে কাঁথিতেই থাকতে হত তাঁকে ৷ স্ত্রীর সঙ্গে রোজ ফোনে কথা হত ৷ রোজকার মতো 2018 সালের 13 অক্টোবরও সকাল 10 টা বেজে 16 মিনিটে সুপর্ণাকে ফোন করেন শুভব্রত ৷ তাঁর কথায় সেই সময় কোনও অস্বাভাবিকতা ছিল না বলেই দাবি সুপর্ণার ৷ কিন্তু এর ঠিক একঘণ্টা পরই (সকাল 11 টা বেজে 20 মিনিট নাগাদ) সুপর্ণা তাঁর জা-য়ের কাছ থেকে জানতে পারেন কিছু একটা অঘটন ঘটেছে ৷ এর কিছুক্ষণ পর তিনি জানতে পারেন, তাঁর স্বামী অসুস্থ এবং কাঁথি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৷
আরও পড়ুন : ভোট-পরবর্তী অশান্তিতে ভাঙে পানিহাটির শ্যামাপ্রসাদের মূর্তি, পুনঃস্থাপন শুভেন্দুর
সূত্রের খবর, ওই দিন (13 অক্টোবর, 2018) স্ত্রীর সঙ্গে ফোনে কথা বলার পরই গুলিবিদ্ধ হন শুভব্রত ৷ শুভেন্দু অধিকারীর পারিবারিক বাসভবন শান্তিকুঞ্জের পাশেই পুলিশের একটি বারাক রয়েছে ৷ সেখানেই থাকতেন তিনি ৷ ঘটনাটি ঘটে ওই বারাকেই ৷ শুভব্রতর স্ত্রী সুপর্ণা জানিয়েছেন, এরপর রাত পর্যন্ত কাঁথি হাসপাতালেই রাখা হয় তাঁর মুমূর্ষু স্বামীকে ৷ শেষমেশ 13 তারিখ রাতে কলকাতার অ্য়াপোলো হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা শুভব্রতকে ৷ পরদিন (14 জুলাই, 2018) সেখানেই মৃত্যু হয় তাঁর ৷ সরকারিভাবে দাবি করা হয়, রাজ্য পুলিশের 42 বছরের ওই কর্মী আত্মহত্যা করেছেন ৷
শুভব্রতর স্ত্রী সুপর্ণার প্রশ্ন, রোগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়াতেও কেন তাঁকে উন্নত চিকিৎসা পরিষেবা দিতে এতটা সময় লাগানো হল ? ঘটনার সময় শুভেন্দু রাজ্য়ের শাসকদলের প্রভাবশালী নেতা ও মন্ত্রী ছিলেন ৷ তাঁর দেহরক্ষী হয়েও কেন দ্রুত সেরা চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া হল না শুভব্রতকে ? তবে কি ইচ্ছাকৃতভাবেই চিকিৎসায় দেরি করা হয়েছিল ? ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি করেছেন মৃতের স্ত্রী ৷ সর্বোপরি তাঁর দাবি, স্বামীর আত্মহত্যার তত্ত্ব মানতে পারছেন না তিনি ৷
আরও পড়ুন : তৃণমূলকে এক ইঞ্চিও ছাড় নয়, বিধায়কদের প্রশিক্ষণ শিবিরে কড়া বার্তা দিলীপ-শুভেন্দুর
রহস্য আরও আছে ৷ ভাইয়ের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা জানার পরই হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিলেন শুভব্রতর দুই দাদা ৷ সেখানে তাঁদের একজন চিকিৎসকের সামনেই পুলিশকে তাঁর বয়ানে জানান, তাঁর ভাই আত্মহত্যা করতে পারেন বলে তিনি বিশ্বাস করেন না ৷ এরপরই আসরে নামেন রাখাল বেরা নামে এক ব্যক্তি ৷ তিনি শুভব্রতর দাদাকে বলেন, চিকিৎসকের সামনে তাঁর মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়েছেন শুভেন্দু ৷ এমনকী, তাঁর মন্তব্যের জন্যই নাকি সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক শুভব্রতর দেহের মনয়নাতদন্ত করতে চাননি ৷ পরে পুলিশের অন্য এক আধিকারিক নতুন করে শুভব্রতর দাদার বয়ান নেন ৷ এরপরই শুভব্রতর দেহের ময়নাতদন্ত করা হয় ৷ প্রশ্ন উঠছে, তবে কি ইচ্ছাকৃতভাবেই মৃতের দাদার বয়ান বদলানো হয়েছিল ? এর জন্য কি পুলিশের উপরও কোনও চাপ ছিল উপর মহলের তরফে ?
সুপর্ণা তাঁর অভিযোগপত্রে আরও দু’জন ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেছেন ৷ তাঁরা হলেন হিমাংশু মান্না এবং স্বদেশ দাস ৷ চলতি বছরের মে মাসে (সম্ভবত 15 জুন 2021) হঠাৎই সুপর্ণার বাড়িতে আসেন তাঁরা ৷ জানতে চান, শুভব্রতর মৃত্য়ু নিয়ে পরিবারের সদস্যদের কাছে কারও কোনও ফোন এসেছিল কিনা ! দুই আগন্তুকের এই উপস্থিতি গোটা ঘটনায় রহস্য বাড়িয়েছে বলেই মনে করছেন শুভব্রতর বিধবা স্ত্রী ৷
আরও পড়ুন : শুভেন্দু-দিলীপের বিরুদ্ধে বলেও শৃঙ্খলা ভাঙেননি সৌমিত্র, সাফাই বঙ্গ বিজেপির সহসভাপতির
সুপর্ণা জানিয়েছেন, স্বামীর মৃত্য়ুর ঘটনা প্রথম থেকেই রহস্যময় ঠেকেছিল তাঁর কাছে ৷ শুভেন্দু অধিকারীর মতো একজন প্রভাবশালীর নিরাপত্তারক্ষী হয়েও কেন চিকিৎসা পেতে দেরি হল শুভব্রতর, তা আজও বুঝে উঠতে পারেননি তিনি ৷ তাছাড়া, ঘটনা ঘটার পর রাখাল বেরার অতিতৎপরতাও তাঁকে ভাবিয়েছে ৷ পরবর্তীতে হিমাংশু মান্না এবং স্বদেশ দাসের আগমনও রহস্যজনক মনে হয়েছে তাঁর ৷ সবথেকে বড় কথা, তাঁর স্বামী আত্মহত্যা করতে পারেন বলে বিশ্বাস করেন না সুপর্ণা ৷ তবে শুভেন্দু অধিকারীর প্রভাব, প্রতিপত্তির ভয়েই এতদিন এ নিয়ে মুখ খোলার সাহস করেননি তিনি ৷ কিন্তু এখন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলেছে ৷ সেই কারণেই সুবিচারের আশায় পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছেন তিনি ৷