ঘাটাল, 4 জুলাই : দুই মা । একজন যিনি ছোট্ট মেয়েটাকে 12 বছর ধরে কোলেপিঠে করে মানুষ করছেন । আর অন্যজন, যিনি তাঁকে জন্ম দিয়েছেন । কিন্তু কার অধিকার বেশি মেয়ের উপর ? কার সঙ্গে থাকবে সে ? এই টানাপোড়েনের মধ্যে 12 বছর আগে কুড়িয়ে পাওয়া মেয়েটার ঠাঁই হয়েছে সরকারি হোমে ।
শুরুটা হয়েছিল 12 বছর আগে । 2008 সাল । এক গ্রীষ্মের দুপুর । চাঁদিফাঁটা রোদ্দুর । ঘাটাল - চন্দ্রকোনা রাজ্য সড়ক দিয়ে ছুটে চলেছে একের পর এক দূরপাল্লার গাড়ি । রাস্তার ধার দিয়ে ছাতা মাথায় হেঁটে যাচ্ছিলেন ঘাটালের অজবনগর গ্রামের বাসিন্দা দেবু দোলুই । সংসারের একমাত্র রোজগেরে তিনিই । শহর থেকে কাজ সেরে ফিরছিলেন । চোখে মুখে ক্লান্তি । হঠাৎ কান্নার আওয়াজে চোখ যায় রাস্তার ধারে একটি গাছের তলায় ।
কিছুটা কৌতুহল বশে এগিয়ে যান গাছতলার দিকে । একটি ছোট্ট ফুটফুটে মেয়ে পড়ে রয়েছে । কাঁদছে । প্রথমটায় ভেবেছিলেন, নিশ্চয়ই সঙ্গে কেউ আছে । চোখ তুলে আশপাশটা দেখলেন দেবু । কোথাও কাউকে দেখা যায় কিনা । কিন্তু না, কোথাও কেউ নেই । শুধু গাড়িগুলির দ্রুতগতিতে হুশ-হুশ করে বেরিয়ে যাওয়ার আওয়াজ, হর্ন, আর তারস্বরে কান্না ।
একরত্তি মেয়েটাকে দেখে মায়া হয় দেবুর । আগে পড়ে কিছু না ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন । দেরি না করে সদ্যোজাত মেয়েটিকে কোলে তুলে নিয়ে সোজা বাড়ি । দেবুর স্ত্রী ছবি দোলুইও মেয়েটিকে কোলে তুলে নেন ।
আরও পড়ুন : কিশোর-কিশোরীর বিয়ে, পুলিশ দেখেই চম্পট বর ও কনের বাবা-মার
প্রথম দিকে দেবু ও ছবি নিজেদের উদ্যোগেই খোঁজখবর করার চেষ্টা করেন সন্তানটি কার । কিন্তু একরত্তির বাবা-মায়ের খোঁজ পাওয়া যায়নি । এরপর ছবি ও দেবুর সংসারে বড় হতে থাকে তাঁদের কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে । নামও রাখা হয় পিউ দোলুই । এক বছর পর তাঁরা প্রশাসনিক দফতরে গিয়ে পিউয়ের জন্ম শংসাপত্র থেকে শুরু করে আধার কার্ড... সবকিছুই তৈরি করিয়ে নেন । স্কুলেও পড়া শুরু করে পিউ ।
এভাবেই ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে পিউ । সুখের সংসার কাটছিল দোলুই দম্পতির । নিজের মেয়ের মতো করেই আদর-যত্ন-শাসনে মানুষ করছিলেন পিউকে । কিন্তু সমস্যা শুরু হয় মাসখানেক আগে । ঘাটাল থানার খড়ার পৌরসভার বাসিন্দা রকি সামন্ত ও তাঁর স্ত্রী ইতু সামন্ত পৌঁছে যান দেবুর বাড়িতে । তাঁদের বক্তব্য, পিউ নাকি তাঁদেরই মেয়ে । পিউ যখন খুব ছোট, তখন তাঁর জন্মদাত্রী মা ইতু সামন্তর মানসিক সমস্যা দেখা দেয় । সেই সময় ইতু সামন্ত তাঁর মেয়েকে রাস্তার ধারে ফেলে চলে গিয়েছিলেন । এখন তাঁরা তাঁদের হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চান । কিন্তু প্রমাণ কিসের যে পিউয়ের আসল মা ইতুই ? প্রমাণ দিতে প্রয়োজনে ডিএনএ পরীক্ষা করাতেও রাজি সামন্ত গিন্নি । সঙ্গে ঘাটাল থানা থেকে পুলিশও এসেছিল ।
আরও পড়ুন : কোনও সহৃদয় কি বাড়িয়ে দেবেন সাহায্যের হাত ? আশায় অঙ্কুশের বাবা-মা
মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে ছবি দোলুইয়ের । যাকে নিজের কোলেপিঠে করে এতদিন ধরে বড় করছেন, যাকে নিজের মেয়ের মতো করে আগলে রাখেন, তাঁকে ছাড়া দিন কাটাবেন কীভাবে ! অন্যদিকে ইতু সামন্তর বক্তব্য, তিনি জন্ম দিয়েছেন । তাই পিউ থাকবে তাঁরই কাছে । শুরু হল বিবাদ । পিউয়ের উপর অধিকার কার বেশি, তা প্রমাণ করার সংগ্রাম । এদিকে পুলিশ দোলুইদের আইন-কানুন বুঝিয়ে পিউকে নিয়ে যায় তাঁদের বাড়ি থেকে । আর তখন থেকেই বছর বারোর ছোট্ট মেয়েটার ঠাঁই হয়েছে মেদিনীপুরের সরকারি হোমে ।
দুই পক্ষই হোমে আবেদন জানিয়েছে, পিউকে যেন তাঁদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয় । আজ সেই সংক্রান্ত বিষয়ে দোলুই ও সামন্তদের ডেকে পাঠিয়েছিল হোম কর্তৃপক্ষ । কিন্তু কোনও মীমাংসা এখনও হয়নি । দুই মায়ের টানাপোড়েনে হোমেই দিন কাটছে পিউয়ের ।