দুর্গাপুর, 30 অগাস্ট : দুর্গাপুর । দেশ ও রাজ্যের অন্যতম প্রধান শিল্পাঞ্চল ৷ সম্প্রতি কোরোনা আতঙ্ক গ্রাস করেছে শিল্পশহরের মালিক, শ্রমিক উভয়পক্ষকে ৷ মার্চ মাসে দেশজুড়ে লাগু হয়েছিল লকডাউন ৷ যার জেরে চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে শিল্পশহরের বেসরকারি কারখানার মালিকদের ৷ আনলক পর্বে ধীরে ধীরে কারখানা খুললেও কোরোনা আতঙ্ক কাটেনি ৷
পঞ্চাশের দশকে শাল, পিয়ালের জঙ্গল কেটে গড়ে উঠেছিল দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চল ৷ রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের আমলে রাজ্য সরকারের উদ্যোগে সর্বপ্রথম তৈরি হয় DPL (দুর্গাপুর প্রোজেক্ট লিমিটেড) ৷ দামোদরের জল, রানিগঞ্জ, বিহার, ঝাড়খণ্ডের কয়লা এবং ওড়িশা থেকে আকরিক লোহা আমদানির সুবিধার জন্যই পরবর্তীকালে এই শহর ও সংলগ্ন এলাকায় একের পর এক সরকারি, বেসরকারি উদ্যোগে ছোটো, বড়, মাঝারি কারখানা গড়ে উঠতে শুরু করে ৷ DSP, SSP, হিন্দুস্থান ফার্টিলাইজ়ার কর্পোরেশন, MAMC, BOGL-এর মতো বড় বড় কারখানা তৈরি হয় । এই সব কারখানায় শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেকেই রোজগারের তাগিদে আসতে শুরু করে ৷ রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানার মধ্যে অনেকগুলি বন্ধ হয়ে গেলও পরবর্তীকালে বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠে ছোটো ছোটো কারখানা বিশেষ করে স্পঞ্জ আয়রন ও FERO ALLOY-এর কারখানা ৷ পানাগড়, গোপালপুর, বামুনাড়া, EPIP প্লট, রাতুড়িয়া-অঙ্গদপুর, হেতেডোবা শিল্পতালুকগুলিতে সব মিলিয়ে এখন 108টি-র মত ছোটো-বড় বেসরকারি কল কারখানা রয়েছে । প্রায় 40 হাজার শ্রমিক সেখানে কাজ করেন ।
কোরোনা সংক্রমণের জেরে মার্চ মাসে দেশজুড়ে লাগু হয় লকডাউন ৷ লকডাউনের সময় সরকারি স্বাস্থ্যবিধি মেনে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল অধিকাংশ কারখানা ৷ যার জেরে চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে মালিকপক্ষ ৷ কারণ উৎপাদন বন্ধ থাকলেও শ্রমিকদের বেতন দেওয়া থেকে শুরু করে বিদ্যুতের বিল ও আনুষাঙ্গিক সমস্ত খরচই বহন করতে হয়েছে । স্থানীয় এক বেসরকারি স্পঞ্জ আয়রন কারখানার মালিক মনোজ আগরওয়াল বলেন, "প্রচুর ক্ষতি হয়েছে ৷ আমার কারখানায় একদিনে খরচ হয় এক থেকে দেড় লাখ টাকা ৷ এক মাসে আমার ক্ষতি হয়েছে 40 লাখ টাকা ৷ আমার চেয়ে বড় কারখানার মালিকদের কারও দু'কোটি, কারও চার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে ৷ তবে কম-বেশি ক্ষতি সবারই হয়েছে ৷ "
আনলক পর্বে এক এক করে কারখানা চালু হয়েছে ৷ কিন্তু কোরোনা আতঙ্কে জেরবার মালিক-শ্রমিক উভয়পক্ষই ৷ মনোজবাবু বলেন, কারখানার কোনও শ্রমিক সংক্রমিত হলেই স্থানীয় প্রশাসনের তরফে 10 থেকে 14 দিনের জন্য কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে ৷ ফলে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে ৷ অন্য এক বেসরকারি কারখানার মালিক অশ্বিনী শর্মা বলেন, "এক, বাজারের অবস্থা খুব খারাপ ৷ দুই, কাঁচামাল ঠিকমতো পৌঁছাচ্ছে না ৷ কারণ গাড়ি বা লরি কম চলছে ৷ এছাড়াও বাইরের যে সমস্ত গাড়ি আসছে তাতে কোনও কোরোনা আক্রান্ত রয়েছে কি না সেই আতঙ্ক রয়েছে ৷ প্রতিটি গাড়িকে স্যানিটাইজ় করতে হচ্ছে ৷ প্রতিটি গাড়ির চালক ও খালাসিকে স্যানিটাইজ় করে তবে ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে ৷ এছাড়া দক্ষ শ্রমিকেরও অভাব দেখা দিয়েছে ৷"
পেটের তাগিদে কাজে যোগ দিয়েছেন শ্রমিকরা ৷ কারখানার তরফে সবরকম স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে তাও কোরোনা আতঙ্ক পিছু ছাড়েনি ৷ স্থানীয় এক শ্রমিক সৈয়দ হাসান উজ্জামান বলেন, "সবাই আতঙ্কে আছি ৷ তার মধ্যেই যতটা সম্ভব নিজেকে সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করছি ৷ বাড়ি গিয়ে জামাকাপড় কেচে ফেলছি ৷ সময়ে সময়ে স্যানিটাইজ়ার ব্যবহার করছি ৷ " শেখ মহাব্বত আলি নামে আরও এক শ্রমিক বলেন," ভয় লাগছে ৷ কিন্তু পেট তো চালাতে হবে ৷ তাই কাজ করতে হবে ৷ "
এই পরিস্থিতিতে শিল্পমহলকে পুনরায় চাঙ্গা করতে প্রয়োজন সরকারি সহযোগিতা । জানালেন দুর্গাপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ়ের সভাপতি কবি দত্ত ৷ বলেন, "ব্যবসা না হলে আয় কোথায় ? ব্যবসায়ীরাও তো মানুষ ৷ ইন্ডাস্ট্রিজ়গুলো সমাজের স্নায়ুকেন্দ্র ৷ এগুলো যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে সবাই সমস্যায় পড়বে ৷ তাই সরকারকে বুঝতে হবে ৷ আমাদের সঙ্গে যদি সহযোগিতা না করা হয় তাহলে এই এত কর্মী, বিনিয়োগ, ব্যাঙ্ক লোন, কোথায় যাব আমরা ? " মালিকদের একাংশও পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারি সহযোগিতার আবেদন জানিয়েছেন ৷
তবে কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, এখন সেই অপেক্ষায় শ্রমিক, মালিক উভয়পক্ষ । অশ্বিনীবাবু বলেন, "100 শতাংশ না হলেও 70 শতাংশ কাজ চালাচ্ছি ৷ প্যানডেমিক পরিস্থিতি কবে যাবে তার অপেক্ষা করছি ৷ তাড়াতাড়ি ভালো দিন আসুক ৷"