কৃষ্ণনগর, 23 জুন : আসছে দুর্গাপুজো ৷ হবে তো ? কোরোনা আতঙ্ক কাটার লক্ষণ নেই ৷ এরই মধ্যে আমফানের দাপট ৷ মৃৎশিল্পীরা হাত গুটিয়ে বসে আছেন বাধ্য হয়ে ৷ বরাত নেই ৷ আগে বিদেশ থেকেও বরাত আসত ৷ এবার সেই বরাতও কম ৷ কলকাতার কয়েকজন শিল্পীর গড়া হাতে গোনা কয়েকটি দুর্গা প্রতিমা পাড়ি দিয়েছে বিদেশে ৷ দুগ্গা দুগ্গা ৷ যদি এবার ঘরের বরাত হাতে আসে !ঝড়, ঝঞ্ঝা, বিপদ ৷ কুমোরপাড়ার এযেন নিত্য সঙ্গী ৷ কিন্তু এবার সব কিছু ছাপিয়ে গিয়েছে কোরোনা আতঙ্ক ৷ আদৌ পুজো হবে তো ? বারোয়ারি পুজো কর্তারা দুশ্চিন্তায় আছে ৷ আশঙ্কা, বরাত দিলে টাকা জলে যাবে না তো ?
কলকাতার কুমোরটুলিতে কৃষ্ণনগরের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম ৷ 1690 সালে জব চার্নক আসার কয়েক বছর পর সুতানুটির পাশে কলকাতা গ্রামে তৈরি হয়েছিল ইস্টইন্ডিয়ার কুঠি ৷ সেসময় কুমোরপাড়া থেকে তৈরি হত কেবল নিত্য ব্যবহার্য মাটির কলসি-হাঁড়ি ৷ তখন বাংলার নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগর থেকে কিছু শিল্পীও চলে আসে কলকাতায় ৷ এরা প্রত্যকেই মাটির পুতুল তৈরি করতে পারত ৷ এই দেখে কুমোরপাড়ার আরও কেউ কেউ কৃষ্ণনগরের পুতুল কারিগরদের কাছে গিয়ে পুতুল তৈরির কলাকৌশল শিখে এল ৷ কলকাতার কুমোরপাড়ায় তখন নতুন প্রাণ সঞ্চার হল ৷ এই শিল্পীদের হাত ধরেই আজকের এই মূর্তি গড়ার কাজ শুরু হয় ৷ আজ সেই কৃষ্ণনগরেই শিল্পীদের মন ভালো নেই ৷ প্রতিমার বরাত না আসায় সংসারে অর্থের টান ৷ দেশ পেরিয়ে বিদেশেও পাড়ি দেয় কৃষ্ণনগরের কুমোরটুলির তৈরি প্রতিমা। প্রতি বছর এই সময় চূড়ান্ত ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে কাজ করে মৃৎশিল্পীরা। কিন্তু, এবছর ফাঁকা ৷ হাতে কাজ নেই ৷
লকডাউনের আগে যে কটা প্রতিমা তৈরির অর্ডার এসেছিল তাও বাতিল করে দিচ্ছে। কাজ বন্ধ হয়ে চূড়ান্ত দুরাবস্থায় দিন কাটছে শিল্পীদের। কৃষ্ণনগর কুমোরটুলি প্রায় 700 পরিবার এই প্রতিমা তৈরি করে সংসার চালায় । সারাবছর ঠাকুরের মূর্তি তৈরি করেই তাদের যেটুকু আয় হয় তা দিয়ে সংসার চলে। কিন্তু তিন মাস ধরে কাজ বন্ধ হয়ে থাকার ফলে মালিকরা শ্রমিকদের আর টাকা দিতে পারছে না। সেই কারণে কোনও কোনও শ্রমিক এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যোগ দিয়েছে । কেউ চা বিক্রি করছেন, কেউ বা সবজি বিক্রি করছে, কেউ আবার মাছ ৷ শ্রমিকদের মজুরি ছিল 300 থেকে হাজার টাকা পর্যন্ত। কিন্তু এখন আর কাজ দিতে পারছেনা মালিকরা । যেসব শিল্পীরা এখনও কাজ করছে তাদের গড় আয় অনেকটা কমে গিয়েছে। প্রতিদিন প্রায় 200 টাকা মজুরিতে বাধ্য হয়ে কাজ করতে হচ্ছে।
কৃষ্ণনগর কুমোরটুলির শিল্পী পরিমল পাল বলেন, "পরিস্থিতি খুব খারাপ, এর থেকে খারাপ পরিস্থিতি কোনওদিন হয়নি । ঠাকুরগুলো সব পড়ে রয়েছে। এগুলো লকডাউনের আগে তৈরি করা হয়েছিল। প্রতিমা পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে ৷ প্রতিবছর প্রচুর ঠাকুরের অর্ডার আসত ৷ কিন্তু, এবছর কিছুই নেই। প্রথমে কিছু অর্ডার এসেছিল ৷ কিন্তু, এখন সেগুলো বাতিল হয়ে যাচ্ছে এবং টাকা ফেরত চাইছে। এই অবস্থায় আমাদের সংসার কোনওরকমভাবে চলছে। আমরা তো অন্য কাজও জানি না সেই কারণে অন্য পেশায় যেতে পারছি না। তাছাড়া অন্য ব্যবসা করতে গেলে প্রচুর টাকার প্রয়োজন কিন্তু অত টাকা আমাদের কাছে নেই।"
আর এক প্রতিমা শিল্পী সুব্রত পাল বলেন, ''সারা বছর বড় পুজোর উপর আমাদের নির্ভর করে সংসার চলে। কিন্তু ঠাকুর যদি না চলে আমরা খাব কি। আমরা কিভাবে বাঁচব ? সরকার কোনও সময় আমাদের দিকে তাকায় না।"
এই অবস্থায় কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত কুমোরটুলির শিল্পীরা আগামী দিনে এই শিল্পটিকে ধরে রাখতে পারবে কি না তা নিয়ে আশঙ্কায় ভুগছে। তার কারণ, যারা প্রতিমা তৈরি করে তার সিংহভাগ অন্য পেশায় যুক্ত হয়ে যাচ্ছে ৷ এই অবস্থায় সরকার যদি কিছু সাহায্য না করে তাহলে হয়তো আগামী দিনে হারিয়ে যেতে পারে কৃষ্ণনগরের এই শিল্প ৷